ভ্রমণ পিপাসু :- ঐতিহাসিক জেলা মালদা পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে একটি অন্য জায়গা দখল করে আছে। মালদা জেলার গৌড় এবং পান্ডুয়া প্রাচীন কাল থেকে সুলতানী আমল পর্যন্ত বাংলার রাজধানী ছিল। একদম বলতে গেলে গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের আমল থেকে পাল সেন যুগ হয়ে মধ্যযুগে ইলিয়াসশাহী এবং হুসেনশাহী শাসনে এই জেলা ছিল গোটা বাংলার রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই গোটা মালদা জুড়েই এরকম বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ভ্রমণের দিক থেকে বাঙালিদের কাছে মালদা মানেই দুটো নাম সবার আগে উঠে আসে এক তো গৌড় এবং দ্বিতীয় আদিনা। এই দুই এলাকায় প্রচুর প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন যেগুলো ASI এবং রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তত্ত্বাবধানে আছে, যেগুলো দেখার জন্য আমাদের রাজ্য ছাড়াও, দেশ এবং দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক এসে থাকে। বেশিরভাগ পর্যটকরাই যে গৌড় এবং আদিনা টার্গেট করে আসে এবং ঘুরে, এরকম খুব কমই বাইরের পর্যটক থাকে যারা এই দুটি জায়গা বাদে জেলার অন্য অন্য জায়গা গুলোতে ভ্রমনে যায়। এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে. গৌড় এবং আদিনাই মালদা জেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং পছন্দের পর্যটনস্থল, কারণ এরকম ঐতিহাসিক নিদর্শন আমাদের রাজ্যের বাকি জেলায় খুব কমই দেখতে পাবেন।
১. ভাটরা বিল এবং যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল :- স্যোসাল মিডিয়ার ক্ষমতা কতটা বেশি, তা এই ভাটরা বিলকে দেখে আন্দাজ করা যায়। কয়েকবছর আগে যে যাওয়ার নামটা হাতে গোনা কয়েকজন জানতো, তা আজ স্যোসাল মিডিয়ার কল্যাণে এত জনপ্রিয় হয়েছে যে, এখন সেখানে বিকেল হলেই মেলা বসে যায়, আর ছুটির দিন গুলোতে তো তিল ধারণের জায়গা থাকে না।
মালদা জেলার দুটি বিল একটি ভাটরা এবং যাত্রাডাঙ্গা নিয়ে এখন আলোচনা করবো। এই বিলকেই অনেকেই একই বিল মনে করেন, কিন্তু দুটি বিল একদমই আলাদা, এবং অবস্থান খুব একটা পাশাপাশি ও না। এই দুটি বিলের মধ্যে একটি মিল আছে সেটা হল, দুটি বিলই একই দিকে অবস্থিত এবং বর্ষার সময়ে টাঙ্গন নদীর জলে পুষ্ঠ। বছরের অন্য সময়ে এই বিল গুলি আকারে খুবই ছোটো থাকে, এবং বেশিরভাগ এলাকায় কৃষিকাজ করা হয়। কিন্তু বর্ষাকালে পার্শ্ববর্তী টাঙ্গনের জলে এই এলাকা ফুলে ফেঁপে ওঠে, তখন এই এলাকায় মাছের ও একটা বিশাল আমদানি হয়। এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা কিন্তু মাছশিকার, যারা বিল গুলোর ওপরের বিশেষভাবে নির্ভরশীল। মাছ চাষ ছাড়াও কৃষিকাজ এবং বর্তমানে পর্যটনের দৌলতে অনেকেরই কর্মসংস্থান হচ্ছে।
ভাটরা বিল বেশী জনপ্রিয় হলেও এই যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল কিন্তু ভাটরা থেকে আরো বেশি সুন্দর। কিন্তু খুব লোকই এখানে আসে। আপনি যাত্রাডাঙ্গাতে আসলে দেখতে পাবেন বিলের মাঝ বরাবর পাকা রাস্তা এবং দুপাশ দিয়ে জলরাশি, এর আসলরূপ দেখতে হলে ভরা বর্ষায় এখানে আসতে হবে, খুবই সুন্দর লাগবে আপনাদের দু পাশ বরাবর জল এবং মাঝ দিয়ে আপনি হেঁটে যাচ্ছেন, এটা কিন্তু আপনারা ভাটরা তে পাবেন না।
কেমন করে যাবেন :- ভাটরা বিল যাওয়ার জন্য আপনাদের মালদা বাইপাস হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই হাতের বাঁদিকে দুটি রাস্তা পর পর নেমে গেছে, এই দুটি রাস্তা দিয়েই যাওয়া যায় এখানে। যারা রায়গঞ্জের দিক থেকে আসবেন তাদের হাতের বাঁ দিকে এবং যারা উল্টোদিক থেকে আসবেন তাদের ডানদিকে কয়েক কি.মি যেতে হবে।
আর যারা যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল যেতে চান তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যারা যারা রায়গঞ্জ বা বালুরঘাটের দিক থেকে আসবেন তারা গাজোল পেরিয়ে, নারায়ণপুর ওভারব্রিজ পার করেই বিএসএফ ক্যাম্প বাজার মোড় থেকে হাতের বাঁ দিকে যেতে হবে প্রায় ৪ কি.মি ।একইরকম ভাবে যারা মালদা দিক থেকে আসবেন তারা একইরকম ভাবে নারায়ণপুর বিএসএফ ক্যাম্প মোড় থেকে ডান দিকে যেতে হবে, ওখানে যে কাউকে বলবেন রাস্তা দেখিয়ে দেবে, তাছাড়া গুগল ম্যাপ তো আছেই।
২. জগজীবনপুর বৌদ্ধবিহার :- মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের বাংলাদেশ বর্ডারের খুব কাছেই একটি ছোট্ট অজানা অচেনা একটি গ্রাম জগজীবনপুর। কয়েকবছর আগেও হয়তো এই গ্রাম নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা ছিলনা। কিন্তু 1987 সালে এই গ্রামের ভাগ্য পাল্টাতে চলেছিলো। গ্রামেরই এক কৃষক চাষের জন্য কোদাল দিয়ে জমি খোরার সময়ে কিছু ধাতব কিছু একটা পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে জানা যায় এটি পাল রাজা মহেন্দ্রপালের তাম্রশাসন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। তারপর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রচেষ্টায় এখানে তিন ধাপে এখানে খনন কার্য চলে, এবং একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন বেরিয়ে আসে, যাকে জগজীবনপুর মহাবিহার হিসেবে ডাকা হলেও এর নাম নন্দদির্ঘীকা উদ্রঙ্গ মহাবিহার, এই বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে পাল আমলের ও রাজ বংশের অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়।
বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে এখানে সংস্কার কার্য চলছে, কাজ অনেকটাই শেষের পথে, একটা মিউজিয়াম মত এখানে করা হয়েছে, যেখান সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা অনেক প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী আপনাদের অপেক্ষায় বসে আছে, তাই আমি বলবো অবশ্যই এখানে একবার হলেও আসুন ভারতের প্রাচীন ইতিহাসকে কাছ থেকে উপভোগ করুন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আপনাদের জন্য ডালি সাজিয়ে বসে আছে। আর জগজীবনপুর মহাবিহার সমন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলে সমস্ত কিছু আমার এই ভিডিও তে বলা আছে এক ক্লিকেই দেখে নিতে পারেন নিচে লিঙ্ক থাকলো।
৩. সিঙ্গাবাদ ভারতের প্রথম ও শেষ স্টেশন : - মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকেরই আরো একটি জায়গা, আদতেও এটা কোনো পর্যটনস্থল না, কিন্তু জায়গাটির একটি আলাদা বিশেষত্ব Historical Importance থাকার জন্য এখানে আপনার একবার ভিজিট করা উচিৎ। জায়গাটি হল একটি প্রান্তিক স্টেশন একদম একদম বাংলাদেশ বর্ডার এলাকায়। এটি একাধারে দেশের লাস্ট এবং ফাস্ট স্টেশন।
আগে পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই রেল স্টেশন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় নেতাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামী এই লাইন হয়েই পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন। মালদা টাউন স্টেশন তৈরি হওয়ার পূর্বে ওল্ড মালদা স্টেশন থেকে সিঙ্গাবাদ হয়েই ট্রেন ছুটটো পূর্ববঙ্গে। দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর এটি ভারতের অন্তিম স্টেশন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আবার বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসলে প্রথম স্টেশন পড়বে এটিই। এই ফাস্ট এবং লাস্ট স্টেশন কথাটি স্টেশন বোর্ডে জলজল করছে, সেটা দেখতে পাবেন, যদিও এরকম স্টেশন ভারতে অনেকই আছে। বর্ডারের ওপারেই আছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুর স্টেশন। এখন বর্তমানে একটিমাত্র ট্রেন তাও আবার মালগাড়ি দু দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। তাই স্টেশনটি শুনশান ও জনমানব শূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
কেমন করে যাবেন :- এখানে আসার সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম হল বাইক বা নিজস্ব কোনো গাড়ি। তাছাড়া এখানে পৌঁছনো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বুলবুলচন্ডী পর্যন্ত রাস্তা খুবই ভালো এরপর থেকেই রাস্তা একদমই খারাপ। এখানে আসতে হলে আপনাকে ওল্ড মালদার সাহাপুর মোড় বা ডিস্কো মোড় থেকে নালাগোলা গামি রাস্তা হয়ে সোজা যেতে হবে আইহো তে। আপনি মালদা বাইপাস থেকেও এই রাস্তায় চলে আসতে পারবেন। আইহো মোড় থেকে হাতের ডানদিকে একদম এক রাস্তা যা পৌঁছে দেবে বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া সিঙ্গাবাদ, বর্ডার থেকে ৫০০ মিটার আগেই এই স্টেশন। সিঙ্গাবাদ এর ওপরে করা আমার লেখা এই ব্লগটি পড়ে নিতে পারেন এখানে বিস্তারিত ভাবে সমস্ত কিছু বলা আছে -
৪. চাঁচল রাজবাড়ি : - মালদা জেলায় যদি রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির সংখ্যা কম। তার মধ্যেই সবচেয়ে সুন্দর আকর্ষণীয় রাজবাড়ি যদি বলতে চান তবে সেটা চাঁচলের রাজবাড়ি।বর্তমানে রাজা না থাকলেও প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই রাজবাড়ি এখনো মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এতো পুরোনো হওয়া সত্বেও এর ভব্যতা কোনো অংশে কমেনি। চাঁচল রাজবাড়িটি তৈরি হয়ে রাজা শরচ্চন্দ্র রায় চৌধুরীর আমলে। তিনি সেই সময় এই রাজবাড়িটি তৈরি করার দায়িত্ব দেন ব্রিটিশ সংস্থা মার্টিন ও বার্ণ কোম্পানিকে। সেইসময় এই কোম্পানিটি আমাদের দেশে বেশ কিছু প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তার মধ্যে কিছু রাজবাড়িও ছিল। মার্টিন ও বার্ণ কোম্পানি ব্রিটিশ এবং
দেশীয় শিল্পের মেলবন্ধনে এই রাজবাড়িটি র তৈরি করেন।
এই রাজবাড়িটির পরিচালন ভার বর্তমানে রাজ্য সরকারের আন্ডারে। সরকারের নির্দেশ অনুসারে রাজবাড়ি ট্রাস্টি বোর্ড এখন এই রাজবাড়ির সমস্ত কিছু পরিচালন করে থাকে। এই রাজবাড়ি বর্তমানে বেশ কিছু ভাগে বিভক্ত। একটা অংশে চাঁচল সিদ্ধেশ্বরী ইন্সটিটিউট বা হাইস্কুল এবং প্রাইমারী স্কুল অবস্থিত। একটি অংশ চাঁচল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং নবতম সংযোজন হয়েছে চাঁচল কোর্ট যা এই রাজবাড়ির একটি অংশেই গড়ে তোলা হয়েছে। একটি অংশ এখনো সর্বসাধারনের জন্য ওপেন আছে সেটা হল রাজবাড়ির ঠাকুরদালান, এখানে এখনো নিত্য পূজা হয়ে আসছে। দুর্গা পূজা খুব সুন্দর ভাবে এখানে উদযাপিত হয় কিন্তু সেই আগের জৌলুস অনেকটাই ফিকে।
কেমন করে যাবেন :- চাঁচল রাজবাড়ি পৌঁছনো একদমই সহজ। তার আগে আপনাকে চাঁচল পৌঁছতে হবে। যারা মালদা বা বালুরঘাটের দিক থেকে আসবেন তারা গাজোলের কঁদুবাড়ি মোড় থেকে বাঁ দিকে সোজা যেতে হবে এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৩ কি.মি আর যারা রায়গঞ্জ থেকে আসবেন তারা ইটাহার চৌরাস্তা থেকে চূড়ামন হয়ে চাঁচল পৌঁছে যেতে পারেন। চাঁচলের একদমই রাস্তার পাশে এই রাজবাড়ি রাস্তা থেকেই দেখতে পাবেন, আর এখানে যদি আসার প্ল্যান করে থাকেন তাহলে অবশ্যই চেষ্টা করবেন দুর্গাপূজার সময়ে এখানে আসার।
৪. গৌড় সার্কিট :- গৌড় নামটি শুনলেই ইতিহাসের পাতায় পড়া অনেক স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। মালদা জেলার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় এবং পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে অন্যতম পরিচিত পর্যটনস্থল ও ঐতিহাসিক স্থান। এই গৌড় ছিল বাংলার একদা রাজধানী, লক্ষণ সেনের আমলে যা লক্ষণাবতী নামে পরিচিত ছিল। রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ এই গৌড়েরই প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। গঙ্গার পূর্ব পারে অবস্থিত প্রাচীন দুর্গনগরী গৌড়ের বেশিরভাগের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়, কিছু অংশ পড়ছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলায়। চলুন তাহলে এক এক করে দেখেনি ঐতিহাসিক দুর্গনগরী গৌড়ের কিছু দর্শনীয় স্থান -
১. দাখিল দরওয়াজা :- ১৪২৫ সালে নির্মিত দাখিল দরওয়াজা। এটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। ছোট লাল ইট এবং পোড়ামাটি দিয়ে তৈরি, এই কাঠামোটি ২১ মিটারেরও বেশি উঁচু এবং ৩৪.৫ মিটার চওড়া। এর শীর্ষে চার কোণে রয়েছে পাঁচতলা উঁচু টাওয়ার। দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারটি ছাড়াও এটি চারপাশের বাঁধের মধ্য দিয়ে খোলে। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে, একটি ২০ মিটার উঁচু প্রাচীর একটি পুরানো প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। অতিথি আপ্যায়ন বা কোনও শুভ কাজ উজ্জাপনের জন্য আগে এখান থেকে কামান নিক্ষেপ করা হত। তাই গেটটি সালামি দরওয়াজা নামেও পরিচিতি লাভ করে।
২. ফিরোজ মিনার :- দাখিল দরওয়াজার এক কিলোমিটার দূরে রয়েছে ফিরোজ মিনার। গৌড়ের অন্যতম প্রধান আকর্ষন হলো দিল্লির কুতুব মিনারের আদলে তৈরি ফিরোজ মিনার। হাবসি সুলতান সইফ উদ্দিন ফিরোজ শাহ তার গৌড় বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে ১৪৮৫-১৪৮৯ সালের মধ্যে এই মিনারটি নির্মান করেছিলেন । তুঘলকি স্থাপত্যশৈলীতে ৮৪ শঙ্খ প্যাচ সিরি বিশিষ্ট এই পাঁচতলা মিনারটি চিরাগদানি মিনার নামেও পরিচিত। কথিত আছে মিনার নির্মাণের পর স্থপতি পিরুকে মিনার থেকে দেওয়া হয়।
৩. বড়সোনা মসজিদ :- বারদুয়ারী বা বড় সোনা মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম স্মৃতিসৌধ। ইট এবং পাথরের তৈরি বিশাল আয়তাকার কাঠামোযুক্ত বৃহত্তম স্মৃতিসৌধের নামের অর্থ দ্বাদশ দরজা হলেও এখানে আসলে এগারোটি দরজা রয়েছে। উচ্চতায় ৫০.৪ মিটার, প্রস্থে ২২.৮ মিটার এবং দৈর্ঘ্য ১২ মিটার পরিমাপের এই বিশাল মসজিদটির নির্মাণ শুরু হয় আল্লাউদ্দিন হুসেন শাহ সময় থেকে। ১৫২৬ সালে নির্মাণ শেষে হয় তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরত শাহের আমলে। ইন্দো-আরবি স্থাপত্যশৈলীর এবং পাথরের উপর খোদাই করা ভাস্কর্য এখানকার প্রধান আকর্ষণ।
৪. লুকোচুরি দরওয়াজা :- গৌড়ের আরো একটি দ্রষ্টব্যস্থান হল লুকোচুরি দরওয়াজা। নামটা শুনেই বোঝা যাচ্ছে নামটা আজকেরকার দিনে দেওয়া। এখানেই নাকি বেগমের সাথে লুকোচুরি খেলতেন সুলতান। এখানে একটি নহবতখানাও ছিল। এই তোরন মুঘল স্থাপত্য রীতিতে তৈরি। শাহজাহানের পুত্র সুজা এবং তার পৃষ্ঠপোষক পীর নিয়ামতুল্লাহ এই তোরন দিয়েই গৌড়ের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাতায়াত করতেন।
৫. কদম রসুল মসজিদ :- কদম কথার অর্থ পা, এবং রসূল কথার অর্থ পয়গম্বর হজরত মহম্মদ। অর্থাৎ যে মসজিদে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের পায়ের চিহ্ন রাখা আছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী মদিনা থেকে পয়গম্বর হজরত মহম্মদের পায়ের ছাপ নিয়ে এসেছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ। মসজিদের চার কোণে চারটি কালো মার্বেল পাথরের মিনার রয়েছে। এর উল্টো দিকেই রয়েছে ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি দিলওয়ার খাঁ এর ছেলে ফতে খাঁ এর সমাধি।
৬. চিকা মসজিদ :- গৌড়ের আরেকটি দর্শনীয় নিদর্শন হল চিকা মসজিদ। সুলতান ইউসুফ শাহ ১৪৭৫ সালে চিকা মসজিদটি নির্মাণ করেন। নামটি এর উৎপত্তি থেকেই বোঝা যায় যে এটিতে প্রচুর পরিমাণে চিকা বা বাদুড় আশ্রয় করত। এটি একটি একক গম্বুজযুক্ত গৃহ। বর্তমানে যদিও এটি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মসজিদে রয়েছে হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের চিহ্নও। দেওয়ালগুলিতে অপূর্ব শৈলাতে খোদাই করা নকশা, দরজা এবং লিনটেলের পাথরের উপর হিন্দু মূর্তির চিত্রগুলি এখনও আংশিকভাবে দৃশ্যমান।
৭. চামকাটি মসজিদ :- মালদা জেলার গৌড়ে অবস্থিত এ মসজিদের নামকরণ হয়েছে সম্ভবত চামকাটি সম্প্রদায়ের নামে। এদের বসবাস বর্তমানে আপনারা দেখতে পাবেন পুরাতন মালদার চালিশপাড়া এলাকায়। এই সম্প্রদায় যারা প্রবল ধর্মীয় উদ্দীপনার বশে ছুরি দিয়ে নিজেদের দেহ জখম করতো এবং সে কারণে তাদেরকে চামকাটি (ত্বক কর্তনকারী) বলা হতো।
মসজিদটি প্রাচীন ইট দ্বারা নির্মিত একটি বর্গাকার মসজিদ। মসজিদের ওপরে আছে একটি গম্বুজ। মসজিদের নামাজ কক্ষে পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে, পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে।
৮. বল্লাল বাটি :- গৌড় যে প্রাচীন কাল থেকেই বাংলার রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু ছিল তার একটি প্রকৃষ্ঠ উদাহরন হল গৌড়ের বল্লাল বাটি। 2003 সালে এই স্থানটির সন্ধান পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে সেন রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদের অবশেষ ছিল এখানে। আবার কারো কারো মতে এটি একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। যদিও এই স্থানটি অস্বীকার হওয়ার খুব বেশী দিন হয়নি তাই এর ইতিহাস নিয়ে খুব একটা সঠিক ভাবে জানা যায়নি।
৯. ২২গজি প্রাচীর :- গৌড়ের বল্লাল বাটি লাগোয়া এই ২২ গজি প্রাচীর যার বর্তমানে অল্প কিছুই অবশিষ্ট আছে। এই প্রাচীরটির উচ্চতা ২২ গজ হওয়ায় এর নাম ২২ গজি প্রাচীর পড়েছে। এই প্রাচীরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন ইলিয়াসশাহী বংশের সুলতান রুকনুদ্দিন বারবাস শাহ। তার পিতা সুলতান নাসির উদ্দিন মামুদ শাহের আমলে দুর্গ নগরী গৌড়েল ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এটি সাধারণত গৌড়ের দুর্গের অভ্যন্তরে রাজপ্রাসাদের চৌহদ্দি প্রাচীর।
১০. লোটন মসজিদ :- মালদার গৌড়ের আরো একটি দর্শনীয় স্থান হলো এই লোটন মসজিদ, গৌড়ের তাঁতি পাড়াতে। সেইজন্য এর নাম হয়েছে তাঁতিপাড়া মসজিদ ।এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটি সম্ভবত হুসেনশাহী শাসনে নির্মিত।
সম্পূর্ণরূপে ইট দ্বারা নির্মিত এ ইমারতের অভ্যন্তরে প্রতিপার্শ্বে ১০.৩৬ মিটার আয়তনের একটি বর্গাকার নামাযঘর
৫. রামকেলি মন্দির, গৌড় :- প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো মালদা জেলার রামকেলি নাম অনেকেই হয়তো শুনেছেন। বৈষ্ণবদের গুপ্ত বৃন্দাবন হিসেবে পরিচিত এই রামকেলি মন্দিরে স্বয়ং চৈতন্যদেব এসেছিলেন এবং তার পদযুগলের চিহ্ন এখনো এখানকার একটি মন্দিরে রাখা আছ। তাই মালদা ভ্রমণের পরিকল্পনা করলে অবশ্যই আপনাদের একবার এই রামকেলি ধাম দর্শন করে যাওয়া উচিৎ। তবে আলাদা ভাবে শুধু এই মন্দির দেখতে আসার কোনো প্রয়োজন নেই আপনারা গৌড় ভ্রমনে সাথে সাথে এই মন্দিরটিও একসাথে দেখে ফেলতে পারবেন।
রামকেলির ইতিহাস ৫০০ বছরের বেশি পুরোনো । ইতিহাসে জানা গেছে চৈতন্য মহাপ্রভু নীলচল যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময়ে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ই জুন জৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিন তৎকালীন বাংলার রাজধানী এই গৌড়ের রামকেলিতে পদার্পন করেছিলেন, এবং একটি তমাল গাছের নিচে বসে ৩ দিন জাবত ধ্যান করেছিলেন, এখানেই শ্রী । চৈতন্যদেবের আগমনের খবর তখন যায় বাংলার নবাব আলাউদ্দিন হুসেন শাহ( বাংলার আকবর) এর কাছে। গৌড় ছিলো তখন গোটা বাংলা-বিহার-ওড়িশারার রাজধানী। চৈতন্যদেবের আগমনের খবরেই তার রাজসভার দুজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দবিরখাস ও সাকির মল্লিক কে চৈতন্যদেবের কাছে পাঠান। এই দবির খাস ও সাকির মল্লিকই পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের কাছ থেকে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা লাভ করে রূপ গোস্বামী এবং সনাতন গোস্বামী নামে পরিচিতি লাভ করেন। চৈতন্যদেবের আগমন উপলক্ষে এখানে প্রতি বছর জৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিন থেকে বিরাট রামকেলির মেলা বসে।
৬. সাগরদিঘি :- মালদার সাদুল্লাপুরে অবস্থিত সাগরদিঘী বা সাগরদিঘী ইকোপার্ক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি প্রকল্প, যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষের তৈরি বৃহত্তম মৎস্য চাষ ও প্রজনন কেন্দ্র। বর্তমানে এটিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ইকোপার্ক হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে একদিকে মৎস প্রজনন কেন্দ্র এবং পর্যটনের বিকাশ একসাথে করা যায়। মালদা শহরের খুব কাছেই অবস্থিত এই নিরিবিলি এই জায়গাটা, একবারে হলেও অবশ্যই ঘুরে যেতে পারেন এখান থেকে টিকিট মাত্র ৫টাকা।
এই সাগরদিঘীর সাথে জড়িয়ে আছে সেন বংশের নাম, সেন রাজা লক্ষণ সেনের আমলে এই দিঘি প্রথম খনন করা হয়। পরবর্তীকালে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে আরো কিছু দিঘী পাশে খনন করা হয়। বর্তমানে এখানে সর্বমোট ২৩টি পুকুর আছে যেখানে মাছ চাষ হচ্ছে। এখানে আসলে দেখতে পাবেন প্রতিটি পুকুরেই একটা আলাদা নাম আছে, সেই নামগুলো কোনো না কোনো এক নদীর নামে এই নামকরণ টা আমার কাছে খুব আকর্ষনীয় লেগেছে। এক বিশাল এলাকা নিয়ে এই সাগরদিঘী গঠিত। যেখানে একসাথে পুকুর গুলি ছাড়াও দেখতে পাবেন কর্মচারীদের থাকার জন্য অনেকগুলো কোয়াটার এবং পর্যটকদের বিনোদন এবং বসে রেস্ট নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা।
কেমন করে যাবেন :- সাগরদিঘী বা বড় সাগরদিঘী বা ইকো ট্যুরিজম পার্ক বিভিন্ন নামে পরিচিত এই জায়গা ইংরেজবাজার পঞ্চায়েত সমিতির সাদুল্লাপুরে অবস্থিত। এটি পরিচালনা ও ইংরেজবাজার পঞ্চায়েত সমিতিরই করছে। মালদা শহর থেকে এই যাওয়ার দুরত্ব মোটামোটি ৫ কি.মি মতো । মালদা বাইপাস মোড় বা বাঁধাপুকুর ডান দিকে সাদুল্লাপুর রোড হয়ে প্রায় ৩ কি.মি গেলে এই সাগরদিঘী পড়বে, রাস্তার একদম পাশেই, আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন লকডাউন প্রায় বন্ধ মত ছিল, তাই টিকিট ছাড়াই আমরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলাম এখন হয়তো ওপেন হয়ে গেছে টিকিট মুল্য ৫ টাকা।
৭. মানিকচক-রাজমহল গঙ্গাঘাট ও মানিকচক ভূতনী ব্রিজ :- মালদা জেলার মানিকচক। এই এলাকা গঙ্গা এবং ফুলহার নদী দ্বারা বন্যা এবং ভাঙনপ্রবন এলাকা। এখানে অবস্থিত গঙ্গাঘাট, যা অন্য ঘাটগুলি থেকে একটু হলেও আলাদা। আর সাথে সাথে এখানেই আছে পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় দীর্ঘতম সেটা ভূতনী ব্রিজ। যা যোগাযোগ স্থাপন করেছে ভূতনীর চরের, যা অবস্থিত ফুলহার নদীর ওপরে। এই ভূতনী চরটি ভারতের বৃহত্তম নদীদ্বীপ গুলোর মধ্যে একটি।
মানিকচকের এই ফেরিঘাট অন্য অন্য ঘাট গুলো থেকে কেনো আলাদা, তার কারণ হলো, ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হওয়ার পূর্বে এই ঘাটই ছিল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম। নদী ঘাটের ওপারেই আছে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল শহর, গঙ্গানদী এখানে বিশাল, নদী পার করে ওপারে যেতে আপনার প্রায় ১ ঘন্টা সময় লেগে যাবে। ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি হওয়ার পূর্বে এই ঘাট থেকে বাস, লরি, বিভিন্ন ছোটো বড় যানবাহন, বড় বড় ফেরিগুলো করেই ওপারে পৌঁছোতো তারপর সড়কপথে দক্ষিণবঙ্গে যেতো। এখনো এখানে আসলে এইসব বড় বড় ফেরিগুলো দেখতে পাবেন যাদের মাধ্যমে এখনো আগের মত যোগাযোগ ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে আসছে।
মানিকচকের ভূতনীর চর অবস্থিত গঙ্গা এবং ফুলহার নদীর মধ্যবর্তী অংশে, এখানেই গঙ্গা এবং ফুলহার নদীর সঙ্গম হয়েছে। ভূতনী একটা বিশাল এলাকা, লোক সংখ্যা প্রায় লাখখানেক, এতো বড় এলাকা হওয়ার সত্ত্বেও মুল ভূখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগকারি কোনো ব্রিজ ছিল না, বছরের অন্য সময়ে যাতায়াত করা গেলেও বর্ষাকালে অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে উঠতো। ফুলহার নদী বিসাল আকার ধারণ করতো। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ৭০ বছর পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্রিজের উদ্বোধন করেন, বিশাল লম্বা এই ব্রিজটি খুলে যাওয়ায় এলাকার লোকেদের খুবই সুফল হয়েছে।
৮. বাংলাদেশের কাছে টাঙ্গন ও মহানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল : - মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের বুলবুলচন্ডী আইহো নামক স্থানে আসলে আপনি এক অদ্ভূত জিনিস দেখতে পাবেন, মহানন্দা ও টাঙ্গন নদীর সঙ্গমস্থল এবং পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশ বর্ডার। মহানন্দা নদীর ওপাশেই বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা, মানে আপনি এতকাছ থেকে বাংলাদেশ খুবই কম জায়গায় দেখতে পাবেন, দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি বর্ডারে খুব কাছ থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। এখানে দু দিকে ইন্ডিয়া এবং একদিকে বাংলাদেশ জায়গাটিও খুব নির্জন নিরিবিলি এবং সুন্দরও। অনেকটা সময় এখানে কাটাতে পারবেন, এখান থেকে দাঁড়িয়েই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের কৃষকরা কাজ করছে। এরকম জায়গা যদি পছন্দ করেন তাহলে একবার হলেও এখান থেকে ঘুরে যাবেন।
কেমন করে যাবেন :- আপনাকে ওল্ড মালদার শাহাপুর মোড় থেকে বুলবুলচন্ডীর রাস্তা ধরতে হবে, তাছাড়া মালদা বাইপাস হয়েও এই রাস্তা আসা যায়। বুলবুলচন্ডী পার করে টাঙ্গন ব্রিজ ক্রস করলেই পৌঁছে যাবেন আইহো তে, এই আইহো মোড় থেকে ডান দিকে কিছুদূর গেলেই এই জায়গাটি পেয়ে যাবেন, যে কাউকে বললেই বলে দেবে এই জায়গাটির কথা। যদিও এখানে অনেকগুলো বর্ডার পোস্ট আছে কিন্তু এই জায়গার বর্ডারটি বেশ আকর্ষণীয়, সেই জন্য এই জায়গাটির কথা আমাদের সাজেস্ট করলাম। এখানে বাইক নিয়েও আসতে পারেন অথবা বাসে ও আসতে পারেন বাইক নিয়ে আসলে একটু সুবিধা। বাসে আসলে নালাগোলা যাওয়ার যেকোনো বাসে আপনাকে আইহোতে নেমে বাকি অংশের জন্য হেঁটে বা টোটো করতে হতে পারে।
৯. একলাখী সমাধি সৌধ :- মালদার আদিনার ঠিক আগেই একলাখীতে অবস্থিত একটি সমাধি সৌধ যার এক নাম আছে গোলঘর, এটি সমন্ধে কিন্তু অনেককেই অজানা, তার সাথে সাথে এর ইতিহাস।
এই একলাখী সমাধি সৌধ টি তৈরি করান সুলতানী আমলের বাংলার একমাত্র হিন্দু রাজা গণেশ তার ছেলে যদুর জন্যে। এখানে তার ছেলে যদু বা জালালউদ্দিন এবং তার স্ত্রীর সমাধি আছে। রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার, তারপর তিনি নিজ ক্ষমতায় রাজা হয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসেছিলেন। তার ছেলে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পিতা কে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। রাজা গণেশ এবং তার ছেলে জালালউদ্দিনের পুরো ইতিহাস জানার জন্য আপনারা আমার এই ভিডিও টি দেখতে পারেন...
কেমন করে যাবেন :- এই একলাখী সমাধি সৌধে আসা খুব সহজ, একলাখী এসে মোটামোটি ৩০০ ভেতরে আসতে হবে। অথবা যে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন গোলঘর কোথায় আপনাকে দেখিয়ে দেবে। মালদার দিক থেকে গেলে আদিনার ঠিক আগেই এই একলাখী জায়গাটি পড়বে।
১০. সোনা মসজিদ / কুতুবশাহী মসজিদ :- মালদার জেলার আদিনার কাছে আরো একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, যেটা সম্পর্কে আমরা প্রায় অনেকেই জানি না। এটি হল সোনা মসজিদ যাকে কুতুবশাহী মসজিদ হিসেবেও ডাকা হয়। মালদার একলাখী সমাধি সৌধের পেছনেই এই জায়গাটি।
এমনিতেই আরো দুটো সোনা মসজিদ এই গৌড়ে ছিল একটি বড় সোনা মসজিদ এবং দ্বিতীয়টি বাংলাদেশে অবস্থিত ছোটো সোনা মসজিদ, আর আদিনার কাছে একলাখীতে অবস্থিত এই মসজিদটি কে সোনা মসজিদ হিসেবে ডাকা হয়। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত সুফিসাধক নূর কুতবুল আলমের বংশধরেরা এই মসজিদের নির্মান করান। গৌড়িও ইট ও পাথরে তৈরী এই মসজিদটি দেখতে অনেকটা গৌড়ের বড় সোনা মসজিদের মত। একদা এই মসজিদের মিনার ও বহির্ভাগ সুবর্ণমন্ডিত ছিল তাই নামকরণ হয়েছে সোনা মসজিদ। একলাখী সমাধি সৌধ দেখার পর পাশ দিয়ে রাস্তাটি ঠিক পেছনের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তা বরাবর গেলেই এই মসজিদটি দেখতে পাবেন।
১১. আদিনা মসজিদ :- একসময় এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ মসজিদ ছিল মালদা জেলার পাণ্ডুয়াতে অবস্থিত আদিনা মসজিদ। ১৩৩৯ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াসশাহী বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান সিকান্দার শাহ এই মসজিদের নির্মান করেন। মসজিদটি সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে অবস্থিত উমাইয়া মসজিদের আদলে নির্মাণ করা হবে।
মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫২৪ ফুট লম্বা ও ৩২২ ফুট চওড়া। এতে ২৬০টি থাম ও ৩৮৭টি গম্বুজ আছে। মসজিদের নকশা বাংলা, আরব, ফার্সি ও বাইজেন্টাইন স্থাপত্য অন্তর্ভুক্ত। অনেকের মতে মসজিদটি পূর্ববর্তী হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সেই মন্দিরের অংশগুলো নিয়ে নির্মাণ করা হয়, মসজিদে দেওয়ালে এবং বিভিন্ন অংশে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, বিভিন্ন চিহ্ন স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। এই মসজিদে একসাথে বসে কয়েকশো মানুষ নামাজ পড়তে পারতো।
১২. মাগুরা স্লুইস গেট:- জেলার আরো একটি অজানা এবং সুন্দর জায়গা গুলোর মধ্যে একটি হলো মাগুরা স্লুইস গেট। এই জায়গা গুলো আমাদের রাজ্যে অনেক থাকলেও পুরো গৌড়বঙ্গের এরকম জায়গা খুব কম দেখা যায়। এই জায়গাটি ও স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে, যার ফলে ভ্রমন পিপাসু মানুষের দলে দলে আগমন ঘটছে এখানে। মহানন্দা নদীর পার্শ্ববর্তী রাস্তায় এক স্লুইস গেটটি অবস্থিত। আশেপাশের এলাকার জল এই স্লুইস গেটের মাধ্যমেই মহানন্দা নদীতে গিয়ে মেসে। জায়গাটি কিন্তু বেশ সুন্দর, তার টানেই প্রচুর মানুষ এখানে আসে দেখার জন্য। দেখার পাশাপাশি স্নান, ছবি ভিডিও এগুলো ও চলতে থাকে সমান তালে। কিন্তু গতবছর এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যায়, এখানে স্নান করার সময় একজন বা দুজন পর্যটক স্রোতে ভেসে গিয়ে মারা যায়, যার পর থেকে প্রশাসন এখানে নিচে নামা এবং স্নান করার কঠোর ভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখন আপনারা এখানে যেতে পারবেন কিন্তু নিচে নামা একদমই নিষিদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে এই নিষেধাজ্ঞার কতটা এখন পালন হচ্ছে সেটা বলতে পারব না। কিন্তু আমি বলবো অবশ্যই যান, ভালো লাগবে ছবি ও ভাল আসবে কিন্তু সতর্ক থাকবেন, জল বেশি থাকলে নামার দরকার নেই।
কেমন করে যাবেন :- এই মাগুরা স্লুইস গেটটি রতুয়া ২ নং ব্লকের পুখুরিয়া থানার অন্তর্গত। কিন্তু গাজোল থেকে এটি খুবই কাছে, গাজোলের কদুবাড়ি মোড় থেকে এর দুরত্ব মাত্র ১২ কি.মি, রায়গঞ্জ থেকে ৫৮ এবং মালদা থেকে ৪০ কি.মি। গাজোলের কদুবাড়ি মোড় থেকে চাঁচল গামি রাস্তা দিয়ে আলাল ব্রিজ, ব্রিজ ক্রস করে ডানদিকে কিছুটা গেলেই এই জায়গাটি পড়বে। আপনি বাসে কদুবাড়িতে নেমে, ছোটো বড় যেকোনো গাড়ি করে আলালে নেমে ওখান থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারবেন।
১৩ . প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার :- ইংলিশবাজার শহরের একদম কাছে এই প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার টি অবস্থিত। ইংলিশ বাজার শহরের খুব কাছে হওয়া সত্বেও কিন্তু এই প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ারটি সম্পর্কে অনেককেই অজানা থেকে গেছে। যেটির অবস্থান মালদার নিমাইসরাই ঘাট এলাকায় একদম মহানন্দা এবং কালিন্দী নদীর সঙ্গমস্থলে। নদীর ওপারেই আছে ওল্ড মালদার মঙ্গলবাড়ি।
যদিও এই প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার টির ইতিহাস সমন্ধে আমরা বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। তা সত্বেও বলা যেতে পারে যেহেতু এটি দুটি নদীর পাশে গড়ে তোলা হয়েছিলো সেহেতু এটি শত্রুর আক্রমণের পূর্বাভাস এবং পাহাড়ার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল, অনেকটা সমুদ্রের পাশে যেমন লাইট হাউস তৈরি করা হয়। এর প্রতিষ্ঠা সময় সম্পর্কে কোথাও কোনো কিছুই আমরা পাই নি, সেখানে পাহারারত রক্ষীরাও এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারলেন না। এতদিন এই জায়গাটি অবহেলায় পড়ে ছিল, বেশ কিছু বছর ধরে Archeological দফতর থেকে এখানে চারদিকে ঘিরে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর ইতিহাস না জানা গেলেও এখানে ঘুরতে আসার পক্ষে আদর্শ। ওপরে ওঠার পর পুরো প্রায় ইংরেজবাজার শহরকেই দেখা যায়, পাশে মহানন্দা এবং কালিন্দী, ওপারে ওল্ড মালদা শহরকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।
কেমন করে যাবেন :- যারা মালদা বা মালদার দিক থেকে আসবেন, তারা মালদা স্টেশনের পাশে দিয়ে রাস্তা বরাবর প্রায় ৩ কি.মি যাওয়ার পর নিমাইসরাই বাজার থেকে ডান দিকে কিছুদূর গেলেই এই নিমাইসরাই ঘাটটি পড়বে, পাশেই অবস্থিত এই টাওয়ারটি। আর যারা রায়গঞ্জ বা বালুরঘাটের দিক থেকে আসবেন তাদের মঙ্গল বাড়ি থেকে নদী ঘাট পেরিয়ে এখানে চলে আসতে পারেন, অথবা ৪২০ মোড় থেকে থেকে একটু ঘুরে এই নিমাইসরাই ঘাটে চলে আসতে পারেন।
১৪. জহুরা কালি মন্দির :-তিনশো বছরের পুরোনো মালদার প্রাচীন জহুরা কালী মন্দির যেখানে পুজো দিলেই ভক্তদের মনস্কামনা হয় পূরণ, এমনটাই বিশ্বাস এই মন্দিরের পুণ্যার্থীদের। যার টানে দূর দূরান্ত থেকে পূর্নাথীরা ছুটে আসে এই মন্দিরে হমালদা জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত ও জাগ্রত মন্দিরের সবচেয়ে অগ্রগন্য এই মন্দির, এটি আসলে একটি চন্ডী মন্দির।
এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব ৩০০ বছর বলা হলেও স্থানীয়দের মতে এই মন্দিরের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের ও বেশী পুরনো। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের আমলে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা বলে মনে করা হয়। আরো একটি মতে প্রায় ৩০০ বছর আগে উত্তরপ্রদেশ থেকে আগত ব্রাহ্মণ তিবাড়ী পরিবার স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজোর সূচনা করেন, বংশানুক্রমিক ভাবে এই পরিবারের বংশধরেরাই এখন এই মন্দিরের পূজার কাজ করে চলছে। এখানে কোনো মূর্তি পুজো হয়না, এখানে মায়ের মুখোস তৈরি করে পুজো করা হয়, যে মুখোস মালদা শহরেরই একটি পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে করে চলছে। এই মন্দিরটির অবস্থান মালদা বা ইংরেজবাজার শহর থেকে মাত্র ৮-৯ কিমি দূরে বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া রায়পুর গ্রামের আমবাগানের মাঝে, মন্দির থেকে জায়গাটির নাম পরিচিত হয়েছে জহুরাতলা নামে। দেশভাগের পূর্বে ওপার থেকেও প্রচুর মানুষ এই পুজোয় অংশগ্রহণ করতে আসতো।
এই মন্দিরের পুজোর কিছু নিয়ম রীতি আছে, প্রথমত এই মন্দিরে মায়ের মুখোস গড়ে পুজো করা হয় সেটা আমি আগে বললাম। দ্বিতীয়ত সব কালি পূজাই রাতের বেলায় সম্পণ্য হলেও এই জহুরা কালি পূজা কিন্তু একদম উল্টো পথে হেঁটে দিনের বেলায় হয়ে থাকে। এবং পুজো কেবলমাত্র মঙ্গল ও শনিবারেই হয়ে থাকে, তাই মায়ের দর্শন পেতে হলে আপনাকে এই দুদিনের মধ্যেই আসতে হবে। এমনিতেই সারাবছর পুজো হলেও বৈশাখ মাসে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। সেইজন্য পুজো উপলক্ষে বৈশাখ মাসে এই দুদিন এখানে বিরাট মেলাও বসে। হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয় এই সময়ে ।
এখানে আসা খুবই সহজ আপনারা যদি কয়েকজনের গ্রুপে আসতে চান তাহলে মালদা শহর থেকে একটা টোটো রিজার্ভ করে নিয়ে সহজে চলে আসতে পারেন। দুরত্ব মাত্র ৮ কি.মি। বাইক নিয়ে বা পার্সোনাল গাড়ি নিয়ে আসতে চাইলে মালদা শহর থেকে বিপিন ঘোষ রোড ধরে এখানে পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় ৩০ মিনিট। এই জহুরা কালি মন্দিরের পাশেই কিছুদূরে আরো একটি প্রাচীন মন্দির আছে যেটি একটি সূর্য মন্দির, অনেকে একে প্রাচীন জহুরা কালি মন্দির হিসেবেও মনে করে থাকে। আসলে অবশ্যই এই মন্দিরটিও দর্শন করে যাবেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন