ভ্রমণ পিপাসু :- পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বিভিন্নতা বিভিন্ন রকমের। ভ্রমণ পিপাসু এই সাইটে আমি আমাদের রাজ্যের বিভিন্ন জেলা গুলো প্রধান প্রধান আকর্ষন গুলো, এবং কি কারণে আমরা সেই জেলাকে চিনি সেগুলো তুলে ধরছি। তাই জেলা সিরিজের আজকের পর্বে আমি আলোচনা করবো শিল্পন্নত, নবগঠিত পশ্চিম বর্ধমান জেলা নিয়ে।
৭ এপ্রিল ২০১৭ সাল থেকে বৃহত্তর বর্ধমান জেলাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি শিল্প প্রধান পশ্চিম বর্ধমান জেলা আর, কৃষি প্রধান পূর্ব বর্ধমান জেলা। আজকের ব্লগটি এই শিল্প প্রধান পশ্চিম বর্ধমান জেলাকে নিয়ে। এই জেলার দুটো মহকুমা আসানসোল ও দুর্গাপুর দুটোই শিল্পের দিক থেকে আমাদের রাজ্যের মধ্যে অগ্রণী জেলা, তার সাথে সাথে খনিজ সম্পদেও সমৃদ্ধ। সেই কারণেই এই জেলায় সাংস্কৃতিক দিক থেকে এবং ভাষাগত ও ধর্মীয় দিক থেকে অনেক বিভিন্নতা করা যায়। সে দিকে আর কথা না বাড়িয়ে মূল বিষয় অর্থাৎ এই প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থান গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই ব্লগে আমি পশ্চিম বর্ধমান জেলার সেরা প্রায় ২০টি দর্শনীয় স্থান নিয়ে আলোচনা করবো, এবং তার সাথে সাথে সে জায়গা গুলো সমন্ধে কিছু ইনফরমেশন এবং আপনারা কেমন করে জায়গাগুলো ঘুরে আসতে পারেন সেটাও উল্লাহ করবো। এই জায়গা গুলোর মধ্যে কিছু কিছু জায়গা একদমই চির পরিচিত এবং কিছু জায়গা আছে একদমই অচেনা, নতুন, অফবিট বলতে পারেন, চলুন তাহলে জায়গা গুলো এক এক তুলে ধরা যাক.....
চুরুলিয়া গ্রাম :- পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি উত্তরে জামুড়িয়া থানার অন্তর্গত এই গ্রাম চুরুলিয়া, এই গ্রাম কি জন্য বিখ্যাত সেটা আমরা প্রায় সকলেই জানি। এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার জন্মভিটে যাকে কবিতীর্থ বলে এখন নজরুল অ্যাকাডেমিতে পরিণত করে দেওয়া হয়েছে, এছাড়াও এখানে দেখতে পাবেন কবির স্ত্রী প্রমিলা দেবার সমাধি। এখানে কবির নামে একটি কলেজ ও খোলা হয়েছে।
সরকারী উদাসীনতার শিকার এই গ্রাম, কবির জন্মদিন উপলক্ষে এখানে ৭ দিন ব্যাপী মেলার আয়োজন করা হলেও সারা বছর সরকারি উদ্যোগ খুব একটা চোখে পড়ে না। কবির বাড়ি, নজরুল অ্যাকাডেমিতে কবির জীবনের বাঁক নেয়া বিভিন্ন ঘটনার ইতিহাস সংবলিত বই, ম্যাগাজিন ও পেপার কাটিং এখানের লাইব্রেরিতে রয়েছে। নজরুল একাডেমিতে গবেষণা করার জন্য লাইব্রেরিতে কবির বিভিন্ন বই, তার সম্পাদিত বিভিন্ন ম্যাগাজিন রয়েছে।
এখানে পৌঁছতে হলে আপনাকে সর্বপ্রথম আসানসোল পৌঁছতে হবে আসানসোল বাস স্ট্যান্ড অজয় ঘাট পর্যন্ত যাওয়ার বাসে এরপর আপনাকে উঠে পড়তে হবে, অজয় ঘাটের কিছু আগে চুরুলিয়া বাজারে আপনাকে নেবে পড়তে হবে, তারপর আপনি পায়ে হেঁটে অথবা টোটো করে চলে আসুন এই জন্মভিটে।
গড়জঙ্গল :- দুর্গাপুরের খুব কাছেই কাঁকসা ব্লকের অন্তর্গত গড়জঙ্গল ঐতিহাসিক দিক থেকে এবং হিন্দু ধর্মের দিক থেকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। অজয় নদীর দক্ষিণ তীরে শাল গাছের দ্বারা বেস্টিত এই জঙ্গল রার বাংলার প্রাচীন ইতিহাস গচ্ছিত রয়েছে।
এই গড় জঙ্গলের একদম মাঝে অবস্থিত মেধস মুনির আশ্রম এই আশ্রমেই শ্রী শ্রী সপ্তসতী চন্ডীর রচয়িতাস্থল। এই আশ্রমেই রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য দেবীমাহাত্ম্য শিখেছিলেন মেধাস মুনির কাছ থেকে। এরপর রাজা সুরথ বসন্তকালে এখানে দূর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। শ্রী শ্রী চণ্ডী এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে এই দুর্গাপূজা, যা গড় জঙ্গলে আয়োজিত হয়েছিল যা ছিল পৃথিবীর প্রথম দুর্গাপুজো।রাজ সুরথ ছিলেন হিন্দু পুরাণে উল্লিখিত প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের যদুবংশী সম্রাট।মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এ তার উল্লেখ আছে। তিনি হিন্দু ধর্মের একজন প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিও ছিলেন। তার রাজধানী ছিল বলিপুরে যা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বোলপুর শহর। তিনি ছিলেন দেবী দুর্গার ভক্ত। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে তিনি মর্ত্যের অধিবাসীদের মধ্যে দেবী মাহাত্ম্য (শ্রী শ্রী চণ্ডী) প্রচার করেছিলেন এবং তিনি বঙ্গে দূর্গাপূজার প্রথম আয়োজক ছিলেন। যা পরে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
রাজা সুরথ এখানে ত্রিদেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের মধ্যে মহাকালী, মহাসরস্বতী, মহালক্ষী মেধস মুনির আশ্রম সংলগ্ন এলাকায় এই মন্দির গুলো তৈরি করা হয়েছিলো।
শ্যামরুপা মন্দির :- গড়জঙ্গলের কথা তো আপনারা আগের পয়েন্টেই বলেছি। সামন্তরাজা ইছাই ঘোষের গড় ছিল এই এলাকা তা থেকেই এই জায়গাটিকে গড় জঙ্গল বলা হয়ে থাকে। শালগাছ দিয়ে ঘেরা এই পুরো এলাকাটিতে এক শান্ত নিঝুম পরিবেশ বিরাজ করছে। এখানে আসলে কিন্তু আপনাদের একটা আলাদা ফিল হবে। এই জঙ্গলের মাঝেই আছে বেশ কয়েকটি প্রাচীন মন্দির সেরকমই একটি মন্দির হল শ্যামরূপা মন্দির। ইছাই ঘোষের আরাধ্যা দেবী ছিলেন এই শ্যামারূপা কালী মা । জনশ্রুতি যে রাজা লক্ষণ সেনও এই মায়ের মন্দির নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন। পূজারীর কথা অনুসারে, অতীতের জীর্ণ মন্দিরের উপর এই নতুন মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। কালী পূজাতে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। মা শ্যামরুপা স্বপ্নাদেশ দেন ইচ্ছাই ঘোষকে যুদ্ধে যেতে অষ্টমীর দিন,লাউসেনের সাথে তার যুদ্ধ হয়েছিলো, রাজা দেবীর কথা না শুনে সপ্তমীর দিন যুদ্ধে চলে যায়।দেবীর কথা অমান্য করার ফলে তিনি পরাজিত হয় এবং নিহত হন।
সেন আমলে এই মন্দিরের নিয়মিত নরবলি হতো, শোনা যায় এই নরবলি বন্ধ করার জন্য মা কালি এখানে কৃষ্ণ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন বা করা হয়েছিলো, যার পেছনে অবদান ছিল কবি জয়দেবের, তিনি ঠিক অজয় নদীর উল্টো দিকে বসবাস করতেন যেই জায়গাটিকে এখন জয়দেব কেঁদুলি বলা হয় ।
এই মন্দিরের আসে পাশে আরো কিছু প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। দুর্গাপুর থেকে জয়দেব যাওয়ার রাস্তা ধরে এই গড়জঙ্গলে পৌঁছতে হবে। বাসে ও আসতে পারেন বাস আপনাকে মেন রোডে নামিয়ে দেবে গড়জঙ্গল নামবো বললেই, এরপর আপনাকে ডানদিকে যেতে হবে পুরো শাল গাছের জঙ্গল। নিজস্ব গাড়ি, ভাড়া গাড়ি বা বাইক নিয়ে আসলে বেটার কারণ জঙ্গলের ভেতর যানবাহন খুবই কম চলে, মন্দিরের পাশে একটি ওয়াচ টাওয়ার ও আছে। আছে আরো কিছু প্রাচীন মন্দির। এখানে আসতে হলে আপনি দুর্গাপূজা, কালী পূজা বা বাসন্তী পূজার সময়ে এখানে আসার চেষ্টা করবেন।
মাইথন ড্যাম :- পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড সীমানায় বরাকরের কাছে দামোদর ও বরাকর নদীর সঙ্গমস্থলে এই ড্যামটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন একটি প্রকল্প। ডিভিসি নির্মিত এই মাইথন বাঁধ ও সংলগ্ন জলাধারের চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যে আপনাকে মুগ্ধ করবেই। এই জলাধারে নৌকা বিহারের দারুণ ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে শীতের রোদ গায়ে মেখে দিগন্ত বিস্তৃত জলে ভেসে বেড়ানো আর নৌকা বিহার উপভোগ করার মজাই আলাদা। আশেপাশে নাই বা থাকলো হিমালয়, কিন্তু ছোটনাগপুর মালভূমির ছোট ছোট টিলা এই জলাধারের সৌন্দর্য্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই ড্যামটির অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, এটি নদীর বামতীরে ভূগর্ভে অবস্থিত এবং এই ধরনের ভূগর্ভস্থ পাওয়ার স্টেশন ভারতে প্রথম। পাওয়ার স্টেশনএর মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ মেগাওয়াট। এই মাইথনে ড্যাম ছাড়াও আরো কিছু দেখার জায়গা আছে, আমি নিচে সেই জায়গা গুলো উল্লেখ করে দেবো। তাছাড়া মাইথনকে কেন্দ্র করে এখানে কতগুলো নতুন স্পট, পিকনিকের জায়গা ও তৈরি হয়েছে, এবং জায়গা গুলোও যথেষ্ট সুন্দর। সেগুলো ও আমি নিচে উল্লেখ করে দেবো।
কল্যাণেশ্বরী মন্দির :- আসানসোল শহর থেকে প্রায় ২০ কি.মি দূরে বরাবর শহর ও বরাকর নদীর একদম পাশেই বাংলা - ঝাড়খণ্ড বর্ডারে অবস্থিত প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো এই কল্যাণেশ্বরী মন্দির। যা আসানসোলের আরো একটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল।
অতীত কালে এই মন্দিরে মানুষবলির কথাও জানতে পারা যায়। তবে বর্তমান মন্দির, খুব বেশি পুরোনো নয়। এটি পঞ্চকোট রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়। কল্যাণেশ্বরী খুবই জাগ্রত দেবী বলে ভক্তদের কাছে পূজিত হন।
এই মন্দিরে আসলে আপনারা আসে পাশের আরো কয়েকটি জায়গা ও সাথে ঘুরে নিতে পারবেন। যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য হল মাইথন ড্যাম যা মাত্র ৫ কি.মি দূরেই অবস্থিত। আপনি এখানে যদি আসতে চান তাহলে ট্রেনে বরাকর স্টেশনে নেমে সবাই বরাকর স্টেশন থেকে এর দুরত্ব মাত্র ৭ কিমি । এ ছাড়াও আপনারা সড়কপথে এখানে আসতে চাইলে কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ধরে আসানসোল বা বরাকর এসে চলে আসুন এই মন্দিরে।
পাহাড়ি বাবার মন্দির :- কল্যাণেশ্বরী মন্দির দেখে পাশেই অবস্থিত পাহাড়ি বাবার মন্দির থেকে ঘুরে আসতে পারেন। পাহাড়টিকে বলা ভান্ডার পাহাড়, এই পাহাড়ের ওপরেই অবস্থিত অমরনাথ মন্দির যার প্রতিষ্ঠাতা শ্রী কালিকানন্দ মহারাজ। অনেক গুলো সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয়, যারা সক্ষম না তারা না ও যেতে পারেন, ওপরে মন্দিরটি ছাড়াও তেমন আর কিছুই নেই, ওপর থেকে চারদিকের ভিউটা আপনাদের ভালো লাগতে পারে।
সুশান্ত রায় Wax মিউজিয়াম & শিশমহল :- আসানসোল শহরের মাঝে একমাত্র মিউজিয়াম বলতে পারেন এই মিউজিয়ামটিকে। এর পেছনে যার হাত আছে তিনি হলেন সুশান্ত রায়, একজন ভাস্কর্য শিল্পী, তিনি তার বাড়িটিকেই বর্তমানে মিউজিয়াম রূপান্তরিত করে দিয়েছেন। এখানে তার হাতে তৈরি বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষদের মূর্তি খুব সযত্নে রাখা আছে, কলকাতার নিউ টাউনের যে Wax Museum আছে তার তুলনায় কোনো অংশে কম না আসানসোলের ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি এই মিউজিয়াম।
এখানে আপনি Wax Meuseum এর পাশাপাশি আরো একই সুন্দর জিনিস পেয়ে যাবেন সেটা হলো শিশমহল, কাচের তৈরি মহল। এই শিশমহলের নাম আমরা প্রথম শুনতে পাই মোঘল আমলে, সম্রাট শাহজাহান এক অসাধারন সুন্দর শিশমহল তৈরি করেছিলেন। গোটা পূর্ব ভারতে এরকম লোক শিশমহল কিন্তু আপনারা পাবেন তা, তাও আবার কারো ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি।
তাই আসানসোল আসলে অবশ্যই সুশান্ত রায়ের এই মিউজিয়াম থেকে অবশ্যই ঘুরে যেতে পারেন। আসানসোল শহরের হামিদনগরের মহিশিলা কলোনীর একদম রাস্তার ধারেই এই মিউজিয়াম টি। প্রবেশমুল্য - ১০০ টাকা এবং ছাত্রদের - ৫০ টাকা।
রাড়েশ্বর শিব মন্দির :- দুর্গাপুরের আড়া, শিবতলাতে অবস্থিত প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো এই রাড়েশ্বর শিব মন্দির। সেন বংশের আমলে সম্রাট বল্লাল সেন রাঢ়েশ্বর শিবমন্দির দ্বাদশ শতাব্দীতে তৈরি করেন। প্রতি বছর মহাশিবরাত্রি উপলক্ষে কাঁকসা ব্লকের এই রাঢ়েশ্বর শিব মন্দিরে ভক্তদের ঢল নামে । শিব মন্দিরকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকা উৎসবের চেহারা নেয়। সকাল থেকেই দূরদূরান্তের ভক্তরা মন্দিরে আসতে থাকেন। সন্ধ্যা নামতেই রাঢ়েশ্বর শিব মন্দিরে পুজো দিতে ভক্তদের ঢল নামে।
নগর শৈলীতে মাকড়াপাথর ও বেলেপাথরে নির্মিত এই রাড়েশ্বর শিবমন্দির গর্ভগৃহে প্রতিষ্ঠিত বিশাল শিবলিঙ্গের জন্য বিখ্যাত, প্রথম দিকে চুন সুরকির কাজে আবৃত আনুমানিক দ্বাদশ শতকে নির্মিত এই মন্দিরটির বহির্ভাগে বর্তমানে অনেকে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, সপ্তরথ মন্দিরটির মূল বৈশিষ্ট হইল এর শিখর ভাগ যার বহির্ভাগ এই অঞ্চলের সমসাময়িক মন্দিরগুলির ন্যায় গোলাকার না হইয়া তীক্ষ্ণ। এই মন্দিরে আসা খুবই সহজ দুর্গাপুর বা কাঁকসা থেকে চলে আসুন মুচিপাড়া বাস স্ট্যান্ডে এখান থেকে মন্দিরের দূরত্ব মাত্র ৩ কি.মি, বাস স্ট্যান্ড থেকে টোটো ধরে নাহলে দুর্গাপুর থেকেও এখানে সরাসরি চলে আসতে পারবেন। কলকাতা থেকে এখানে আসতে হলে দুর্গাপুর বা কাঁকসা স্টেশনে নামতে হবে, আর বাই রোড আসলে GT রোড ধরলে, মুচিপাড়া স্টেপেজে।
দুর্গাপুর ব্যারেজ :- পশ্চিম বর্ধমান জেলার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দুর্গাপুরে দামোদর নদের ওপরে এই ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন বা DVC এর একটি প্রকল্পে এই ব্যারেজটি নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৫৫ সালে যার প্রধান উদ্দেশ্য জলসেচ ব্যাবস্থা। এই ব্যারেজের দ্বারা দামোদর নদ ও তার উপনদী গুলির বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। এই ব্যারেজ থেকে কৃষি জমিতে জল সেচের জন্য সেচ খাল খনন করা হয়েছে যার দ্বারা বর্ধমান জেলা ও বাঁকুড়া জেলার কৃষি জমিতে জল সেচ করা হয়।
এই ব্যারেজের উচ্চতা ৪০ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ২২৭১ ফুট। এতে ৩৪টি গেট রয়েছে এবং ব্যারেজের বাম ও ডান দিকে রয়েছে দুটি সেচখাল। বিকেল বা সন্ধ্যার টাইমে আসলে ভালো দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
ইছাই ঘোষের দেউল :- পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা ব্লকের অন্তর্গত অজয় নদের একদম দক্ষিণপাশে গৌরাঙ্গপুরের দেউল পার্কের মধ্যে অবস্থিত এই ইছাই ঘোষের দেউল। এই দেউল মন্দিরটি ঠিক কবে কাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সে ব্যাপারে সঠিকভাবে কিছু বলা যায় না। উড়িষ্যার রেখ দেউল শিল্পরীতিতে এই মন্দিরটি নির্মিত করা হয়েছে। এই মন্দিরটি যে স্থানে নির্মিত সেখানে রারেশ্বর, গোপ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ইছাই ঘোষ তার আরাধ্য দেবী ভগবতী দেবীর আরাধনা করতেন।
ইছাই ঘোষ সম্বন্ধে আমাদের একটু জেনে রাখা দরকার। মঙ্গলকাব্য ধর্মমঙ্গলের এক প্রধান চরিত্র হলেন এই ইছাই ঘোষ। ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখলে রার বঙ্গের এই অঞ্চলে সেন রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে তিনি একটি স্বাধীন গোপ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণসেন নামক এই অঞ্চলের এক সামন্তকে পরাজিত করে তিনি নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করেন। পরবর্তীতে কর্ণসেনের পুত্র লাউসেনের কাছে তিনি পরাজিত হোন। অজয় নদের দক্ষিণ পাশে এই যুদ্ধ হয়েছিলো। এই যুদ্ধ সমন্ধে ধর্মমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত আছে।
তবে এই দেউল এর প্রতিষ্ঠাতা কে সেটা সমন্ধে সঠিকভাবে কিছুই জানা যায়নি। পুরাতত্ত্ববিদ্ দের মতে এই মন্দিরটি সম্ভবত ১১ শতকে নির্মাণ হয়ে থাকতে পারে। ইছাই ঘোষের পরবর্তী গোপ রাজারা তাদের পূর্ব পুরুষের স্মৃতি রক্ষার উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটা নির্মাণ করে থাকতে পারেন। দুর্গাপুর শহর থেকে এই মন্দিরের দূরত্ব প্রায় ৩০ কি.মি। দুর্গাপুর পৌঁছে দুর্গাপুর থেকে বাসে আপনাকে এই দেউল পার্ক পৌঁছতে হবে।
পাঞ্চেত ড্যাম :- পাঞ্চেত ড্যাম হলো দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন দ্বারা নির্মিত DVC এর প্রধান চারটি ড্যামের মধ্যে একটি। এটি ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার পাঞ্চেত পাহাড়ের কোলে দামোদর নদীর ওপরে অবস্থিত। এই ড্যামটি ঝাড়খণ্ডে অবস্থিত হলেও আপনি খুবই সহজে আসানসোল থেকে বরাকর হয়ে এই ড্যামটি দেখে আসতে পারেন, পুরুলিয়া থেকেও এখানে আসা যায়। আসানসোল থেকে এর দুরত্ব প্রায় ৩০ কি.মি ।আপনি আসানসোল থেকে একটি গাড়ি রিজার্ভ করে নিয়ে মাইথন ও পাঞ্চেত ড্যাম একসাথে একদিনে দেখে নিতে পারবেন। আসলে শীতে অথবা বর্ষার সিজনে এখানে আসার চেষ্টা করবেন।।
ভবানী পাঠকের কালি মন্দির :- দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারের খুব কাছে, দুর্গাপুর অম্বুজা কালি বাড়ি ও কালি মন্দির। যা ইতিহাস প্রসিদ্ধ সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠকের মন্দির হিসেবে পরিচিত।
এই মন্দিরটি ভবানী পাঠকের মন্দির হিসেবে পরিচিত হলেও এই মন্দির কিন্তু আরো প্রাচীন। সেন যুগের সময়কার এই মন্দির, গোপরাজা ইছাই ঘোষের সমসাময়িক। ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী এই মন্দিরে এসে পুজো দিতেন, তারপর তারা তাদের কাজে বের হতেন। জলপাইগুড়িতেও এরকম একটি দেবী চৌধুরানী মন্দির আছে। দুর্গাপরের এই এলাকা তখন ঘন জঙ্গলে ঢাকা ছিল। সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের সময়ে দেবী চৌধুরানী ও ভবানী এখানে মায়ের আরাধনা করতেন । দুর্গাপুর সিটি সেন্টারে নেমে খুবই সহজে এখানে চলে আসতে পারেন।
রনডিহা ড্যাম :- দুর্গাপুর মহকুমার পানাগড়ের কাছে দামোদর নদের ওপরে অবস্থিত এই রনডিহা ড্যাম, যা ১৯৩২ সালে অ্যান্ডারসন ওয়ারের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছিল। পানাগড় থেকে মাত্র ১০ কি.মি দক্ষিণে রনডিহাতে এই ড্যামটি অবস্থিত। নদীর উল্টো দিকেই আছে বাঁকুড়ার জেলার সোনামুখী।
জায়গাটি যথেষ্টই সুন্দর। পিকনিক স্পট হিসেবে ও খুবই আদর্শ একটি জায়গা, সেই কারনে জনপ্রিয়তাও পেয়েছে জায়গাটি। ড্যামে জলের ধারাটি খুবই সুন্দর ভাবে নিচে নেমে আসছে যা দেখতে ভারী সুন্দর লাগে, যার টানে পর্যটকেরা এই জায়গাটিতে ছুটে আসে।
ঘাঘর বুড়ি মন্দির :- ঘাঘর বুড়ি হলেন বাংলার লৌকিক দেবী। আসানসোলের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম এই মন্দির ।আসানসোল শহরের উত্তরে ক্লেদবাহী শীর্ণকায় নুনীয়া নদীর তীরে অধিষ্টিতা রাঢ় বাংলার জাগ্রত দেবী মা শ্রীশ্রী ঘাঘর বুড়ি। ঘাঘর শব্দের অর্থ হল – ঝাঁজ বাদ্য ও ঘুঙুর। অনেকে তাকে ষষ্ঠীর আরেক রুপ ও বলেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয় ১৬২০ সালে। ১৬২০ সালের ১লা মাঘকে স্মরণ করে প্রতি বছর মন্দিরের সামনের মাঠে বসে ঘাগরবুড়ি চণ্ডীমাতার মেলা।
প্রমাণ্য তথ্য থেকে জানা যায় বহু প্রাচীন কাল থেকে অনাচ্ছাদিত মন্দিরে, গাছ তলায় পূজা হয়ে আসছে মা ঘাঘর বুড়ির। ইনি দেবী শ্রীশ্রী চন্ডী। কোন মূর্তি নেই। শুধু তিনটি শীলা রয়েছে। পুরানে দেব-দেবীর বিভিন্ন পূজা পদ্ধতির উল্লেখ আছে- তার মধ্যে নৃত্য গীত-বাদ্য সহকারে বহু দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। রাস পূর্ণিমায় এখানে হোম যজ্ঞ করা হয়। আসানসোল শহর থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটের দূরত্বে এই মন্দিরটি অবস্থিত। বাসে আসলে কালি পাহাড়ি বাস স্ট্যান্ডে নেমে খুব কাছেই এই মন্দিরটি।
শিবশক্তি ধাম :- দুর্গাপুরের অন্যতম প্রসিদ্ধ এবং বড়ো মন্দির এই শিবশক্তি ধাম। নাম দেখেই সকলেই বুঝে গিয়েছেন এই দেবাধিদেব মহাদেবকে সমর্পিত করা। দুর্গাপরের আসলে অবশ্যই এই মন্দির থেকে ঘুরে যাবেন,মন্দিরটির অসাধারণ স্থাপত্য ও কারুকাজ আপনাকে মুগ্ধ করবে, এটিই দুর্গাপুরের সবচেয়ে বড় মন্দির। এখানে আসা খুব সহজ একদম GT রোডের ধারে অবস্থিত, গোপালপুর মাঠের সামনে নেমে পায়ে হেঁটেই চলে যেতে পারবেন।
আসানসোলের কিছু পিকনিক স্পট :- আসানসোল শহর থেকে খুব কম দূরত্বে কিছু পিকনিক স্পট, যেগুলো থেকে আপনারা একদিনের জন্য ঘুরে আসার পাশাপাশি পিকনিকও করতে পারবেন। জায়গা গুলো কিন্তু পিকনিক করার জন্য একদমই আদর্শ, সেরকমই কিছু জায়গা তুলে ধরছি -
১. সিধাবাড়ি পিকনিক স্পট
২. খাসিডাঙ্গা পিকনিক স্পট।
৩. বৃন্দাবন পিকনিক স্পট।
৪. গাঙ্গটিকুলী দ্বীপ।
৫. কাঁশকুলী পিকনিক স্পট।
৬. ভূতাবুড়ি পিকনিক স্পট।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন