উত্তর দিনাজপুর জেলার গুরুত্বপূর্ন ঐতিহাসিক স্থান
ভ্রমন পিপাসু :- আজকের এই ব্লগে আমি তুলে ধরবো উত্তর দিনাজপুর কিছু ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন স্থান। আগে উত্তর দিনাজপুর নিয়ে ব্লগে আমি এই জেলার সেরা ১০ টি ভ্রমণ স্থানকে তুলে ধরেছিলাম আর আজ থাকছে ঐতিহাসিক স্থান। দেশভাগের জন্য এই দিনাজপুর জেলাকে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। ভারতের অংশে থাকা পশ্চিম দিনাজপুর জেলাকে আবার ১৯৯২ সালের ১লা এপ্রিল দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সদর শহর বালুরঘাটই থেকে যায় এবং নতুন সৃষ্টি হওয়া উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর শহর করা হয় রায়গঞ্জকে।
দিনাজপুর নামের উৎপত্তি হয়েছে ভাতুরিয়ার রাজা গণেশের এক উপাধি 'দনুজমর্দনদেব' থেকে এই দনুজ থেকেই দিনাজপুর কথাটি এসেছে বলা মনে করা হয়। এই রাজা গণেশ ছিলেন সুলতানী আমলের বাংলার একমাত্র হিন্দু রাজা। তার ঢিপী কিন্তু এই জেলার হেমতাবাদ ব্লকের ভাতুরা গ্রামে আছে।এই জেলায় এরকম প্রচুর ঐতিহাসিক স্থান আছে সব তো আর দেওয়া সম্ভব না কিন্তু মোটামোটি ঐতিহাসিক দিক গুরুত্ব সম্পন্ন প্রায় সব গুলি জায়গাকেই এই ব্লগে স্থান দেওয়া হয়েছে। আসা করি ব্লগটি আপনাদের ভালই লাগবে এবং অনেক অজানা জায়গা আপনারা জানতে পারবেন। এই ব্লগটি লিখতে তথ্যের জন্য অনেক সহায়তা পেয়েছি শ্রী বৃন্দাবন ঘোষের লেখা বিভিন্ন বই। এছাড়াও আরো কিছু জায়গা থেকে তথ্য পেয়েছি।
১. আমাতি গ্রাম, পাল রাজার রাজধানী :- ইটাহার থেকে দক্ষিণে মহানন্দা ও সুঁই নদীর তীরে জয়হাট গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত আমাতি গ্রাম। এখানেই স্থাপিত হয়েছিলো পাল রাজা রামপালের রাজধানী রামাবতী। এই রামাবতী থেকেই আজকের আমাতি নামের উৎপত্তি। তবে রামপালকে সিংহাসনে বসার পূর্বে, সেই সময়ে গৌড়ের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত কৈবর্তরাজ ভীমকে পরাজিত করতে হয়েছিলো। যে যুদ্ধ মালদা জেলার খরবার রামপুর ও ভীমপুর মৌজায় সংঘটিত হয়েছিলো। যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভীম পরাজিত হোন। এরপর রামপাল ভীমকে হত্যা করে গৌড়ের সিংহাসনে বসেন এবং পাল বংশকে আবার দ্বিতীয়বারের জন্য গৌড়ের শাসন ক্ষমতায় পূনপ্রতিষ্ঠা করেন।
Amati, Itahar. |
সিংহাসনে বসেই তিনি রামাবতী নগরে তার নামে নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন, যেটা আজকের ইটাহারের আমাতি গ্রাম। আমাতি গ্রামে এরকম প্রচুর রাজধানীর প্রাচীন চিহ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।আমাতি গ্রামে প্রবেশের পথের দুপাশে ছোটো কোঠবাড়ি ও বড় কোঠবাড়ি বলে দুটো স্থান আছে। এছাড়া এখানে রাজবাড়ির ভগ্ন দেওয়াল, বিভিন্ন আকৃতির পাথর, পাথরের গোলাকার বৌদ্ধ চক্র ( যদিও এখন অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গিয়েছে), বিভিন্ন প্রাচীন দিঘী, তার বাঁধানো ঘাটের ধ্বংসাবশেষ পরিলক্ষিত হয়। আমাতিতে কাজলদিঘী, গাভরাইদিঘী ও দোসতীনাদিঘী রয়েছে। এই দিঘীগুলো পাল রাজারা খনন করেছিলেন। নগরের জল পয়প্রনালী ব্যবস্থার মাধ্যমে নদীতে পড়তো সেই ধ্বংসাবশেষ ও পরিলক্ষিত হয়।
আসবে কেমন করে যারা ইটাহারের দিক থেকে আসবেন তাদের বাইদারা চেকপোস্টের আগেই জয়হাট গ্রাম পঞ্চায়েত মোড় থেকে ডান দিকে যেতে হবে প্রায় ৪ কি.মি আর যারা গাজোলের দিক থেকে আসবে তারা চেকপোস্ট পেরিয়ে বাঁ দিকে ঢুকতে হবে।
২. কমলাবাড়ি মসজিদ :- রায়গঞ্জের কমলাবাড়ি হাটের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই মসজিদ যার বর্তমান নাম পীর মখদুম মসজিদ। যা উত্তর দিনাজপুর জেলার অন্যতম বৃহত্তম এবং প্রাচীন মসজিদ। সম্ভবত সুলতান হোসেন শাহের উদ্যোগে এই মসজিদ তৈরি করা হয়েছিলো, কেউ কেউ বলেন রাজা গণেশের ছেলে যদু, কেউ বলেন কুতুব শাহ, আবার কারো মতে পীর মখদুম সাহেব এর প্রতিষ্ঠাতা । তবে প্রতিষ্ঠাতা যেই হোন না কেনো সেই সময়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করে এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিলো।
এই মসজিদের দৈর্ঘ্য ৫০ ফুট, এবং প্রস্থ ২০ ফুট। ছাদে চারটি মিনার ও তার মাঝে ১০ টি বড় গম্বুজ লক্ষ্য করা যায়। মসজিদের সামনে কয়েকটি ছোট বড় মাজার প্রতিষ্ঠিত আছে। বৈশাখ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার এই মসজিদের বাৎসরিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় সেদিন বহু মানুষ শিরনি প্রদান করে, সেই উপলক্ষে মসজিদের সামনে অনুষ্ঠানেও আয়োজন করা হয়।
কেমন করে যাবেন - রায়গঞ্জের শিলিগুড়ি মোড় থেকে কালিয়াগঞ্জের দিকে যেতে হেমতাবাদের ঠিক এক কি.মি আগেই ঠাকুরবাড়ি মোড়, এই মোড় থেকে ডান দিকে ১ কি.মি গেলেই কমলাবাড়ি হাট, হাটের পশ্চিম দিকেই এই মসজিদ।
৩. বিন্দোলের ভৈরবী মন্দির :- রায়গঞ্জ শহর থেকে ২৩ কি.মি দূরে বিন্দোলের লুপ্তপ্রায় কাঞ্চন বা কাঁচ নদীর তীরে সুলতানী আমলে গড়ে উঠেছিলো এই ভৈরবী মন্দির। এই মন্দিরে কিন্তু কোনো ভৈরবী বা দেবী মূর্তি নেই, মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আছে কালো পাথরের মার্তন্ড ভৈরবের মূর্তি। এই মন্দির প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে আছে ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশের নাম। বর্তমানে উত্তর দিনাজপুর জেলায় যে তিনটে হেরিটেজ মন্দির আছে এই ভৈরবী মন্দিরটি তার মধ্যে একটি।
Bhairabi Temple, Bindol. |
এই মন্দির ইট চুন ও সুরকি দিয়ে গড়ে ওঠে, এবং মন্দিরে দেওয়ালে পোড়া মাটির কাজ ও দেখা যায়। সেই আমলে দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এমন কি পূর্ববঙ্গ থেকেও মানুষ কাঞ্চন নদী হয়ে এই মন্দিরে পূজা দিতে আসতো, কথিত আছে যে ডাকাতরা ডাকাতি করার পূর্বে এই মন্দিরে পুজো দিয়ে তারপর ডাকাতি করতে যেতো।
গ্রাম বাসিদের উদ্যোগে প্রতি বছর শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন মন্দিরে বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়। মন্দিরটি দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে ছিলো প্রায় কয়েকশো বছরের পুরোনো এই মন্দির। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হেরিটেজ কমিশনের উদ্যোগে এই মন্দিরের সংস্কার করা হয়। এখানে আসা খুবই সহজ বাস স্ট্যান্ড বা শিলিগুড়ি মোড় থেকে বিন্দোলের যেকোনো বাস বা ছোটো গাড়ি করে চলে আসুন বিন্দোল, বিন্দোল থেকে কিছুটা আগে রাস্তার পাশেই এই মন্দির।
আরো পড়ুন - উত্তর দিনাজপুর জেলার ১০ টি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল
৪. বালিয়ার মোঘল যুগের দুর্গ :- রায়গঞ্জের বিন্দোলের খুব কাছেই বালিয়া মৌজা। সেখানে মোগল আমলের একটি জরাজীর্ণ দূর্গ রয়েছে। এই দূর্গটি সপ্তদশ শতকে দ্বিতীয়ার্ধে তৈরি। কথিত আছে যে এখানেই বালিয়া নামে একজন শক্তিশালী জায়গীরদার থাকতেন, তার অধীনে বহু সংখ্যক সৈন্য ও ঘোড়া ও থাকতো। পাশেই আছে বালিয়া দিঘী এবং বুরহানা ফকিরের মাজার। শোনা যায় এই বুরহানা ফকিরের সাথে বালিয়া রাজার এক ভীষণ যুদ্ধ হয়েছিলো এবং এরপর বালিয়া রাজা দুর্গ সংলগ্ন বালিয়া দিঘীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
Balia Fort |
সপ্তদশ শতকে বাংলার সুবেদার শাহ সুজার আমলে বালিয়াকে এই অঞ্চলের জায়গীর দেওয়া হয়। তিনি জায়গীর পেয়ে এই অঞ্চলে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, দিনে দিনে তার আদায়কৃত করের পরিণাম বাড়তে থাকে, তিনিও প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী হোন। তাই তৎকালীন সুবেদার শাহ সুজা তাকে সরানোর জন্য হাসান বুরহানা নামে একজন দরবেশকে পাঠান। কথিত আছে তাদের দুজনের মধ্যে এক যুদ্ধ হয়, এবং বুরহানা ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতা প্রয়োগের( যদিও ঘটনাটি কত খানি সঠিক সেটা বলা যাবে না। এই কারণে শেষ পর্যন্ত বালিয়া রাজা আত্মহত্যা করেন। এরপর বুরহানা ফকির ও তার দলবল বালিয়া দূর্গ দখল করে।
দূর্গটি বর্তমানে ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়ে গেছে। এখানে আসতে চাইলে হেমতাবাদের কাছে ঠাকুরবাড়ি মোড় থেকে বাঁ দিকে ১০ কি.মি গেলেই এই বালিয়া দূর্গ। পাশেই আছে বুরহানা ফকিরের মাজার এবং বালিয়াদিঘি।
৫. ইসলামপুরের জমিদারবাড়ি :- উত্তর দিনাজপুর জেলার একমাত্র মহকুমা শহর এই ইসলামপুর, বর্তমানে এটি একটি পুলিশ জেলা হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। এই পুরো ইসলামপুর মহকুমাই স্বাধীনতার পূর্বে বিহার রাজ্যের অংশ ছিল। স্বাধীনতার পর এটিকে উত্তর দিনাজপুরের সাথে যুক্ত করা হয়। এই ইসলামপুর শহরেই চৌধুরীদের প্রাচীন জরাজির্ণ জমিদারবাড়ি। বেশ কিছু বছর আগে এই জরাজির্ণ জমিদারবাড়ির কিছু অংশের সংস্কারও হয়েছে।
Islampur Jamidarbari. |
ইসলামপুর জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মৌলবি আব্দুল আজিজ। তবে তাদের আদি বাসভূমি ছিল উত্তর প্রদেশে। কথিত আছে নাকি তাদের এক পূর্ব পুরুষ সেনা বাহিনীর কাজ নিয়ে এই জেলায় এসেছিলেন তারপর আর ফিরে যাননি তারপর নগৎ বেতনের পরিবর্তে জায়গীর দেওয়া হয়, ধীরে ধীরে তারা ইসলামপুর এলাকার বিশাল সমাপ্তির মালিক হোন। ইসলামপুর, চোপড়া, কিশানগঞ্জ, ঠাকুরগঞ্জ, বাংলাদেশের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও প্রভৃতি এলাকায় তাদের জমি ছিল।
এখানে আসতে হলে ইসলামপুরের পুরনো বাস স্ট্যান্ডের মোড়ে নেমে টোটো ভাড়া করে পশ্চিম দিকে ১ কি.মি যেতে হবে।
৬. রায়পুরের কল্যাণ গোঁসাই এর মন্দির :- রায়গঞ্জ থেকে মাত্র ৩-৪ কি.মি দূরেই অবস্থিত রায়পুর গ্রাম। সেখানেই অবস্থিত কল্যাণ গোঁসাই এর মন্দির। শোনা যায় শ্রী চৈতন্যদেবের উত্তরবঙ্গ ভ্রমণকালে এই মন্দিরে এসেছিলেন।
Kalyan Gosai Temple. |
পাল আমলে এই এলাকায় পদ্মাহার, গদাহার, কাতাহার, মিলাহার নামে পুকুর খনন করা হয়েছিলো। পাল আমলে এখানে শৈব, বৌদ্ধ, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মানুষ বসবাস করতো কল্যাণ গোঁসাই এর উদ্যোগে তাদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিলো। তার উদ্যোগেই রায়পুরে ইট চুন, সুরকি দিয়ে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। মন্দিরে বিষ্ণুমূর্তি ও শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত ছিল মুসলিম আক্রমনের সময়ে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত মূর্তি গুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু মূর্তি আক্রান্ত হওয়ার আগেই জলে ফেলে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দিঘি গুলি সংস্কার করতে গিয়ে এই মূর্তি গুলি উদ্ধার হয়। দিঘি গুলোর নাম আমি শুরুতেই বলেছিলেন। মূর্তি গুলোর মধ্যে একটি বিষ্ণু মূর্তি এবং একটি বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। বৌদ্ধ মূর্তিটি কিন্তু ছিল বেলে পাথরের, এরকম মূর্তি আমাদের জেলায় একদমই দেখা যায়না। এখানে আসতে হলে রায়গঞ্জ FCI মোড় থেকে ডান দিকে যেতে হবে কাশিবাটি পার করেই এই রায়পুর।
৭. মারনাই ইটাহার :- একবাক্যে বলা যায় উত্তর দিনাজপুর জেলার ঐতিহাসিক দিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা। এরকম বর্ধিষ্ণু গ্রাম এই জেলায় আর একটিও নেই। এখানে দেখার মত আছে অনেক কিছুই।
মারনাই উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার ব্লকের সুঁই নদীর তীরবর্তী একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো পূর্বে। মহানন্দা এবং সুঁই নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার এখানে প্রচুর শষ্য উৎপাদন হতো। "মার-নাই" নামটি তারই ইঙ্গিত বহন করে হয়তো। নদীর ওপারেই আছে মালদা জেলা।
মারনাই ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে উনবিংশ শতকে একদম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে। মারনাই গ্রামের জমিদার ব্যবস্থা কিন্তু একরকম অদ্ভূত এবং বিরল, কেনো সেটা আপনি পুরোটা পড়লেই বুঝে যাবেন। আমরা সকলেই জানি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়ে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূচনা হয়। সেই অনুযায়ী ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে দিনাজপুর মহারাজার কাছ থেকে মারনাই এর তখনকার জমিদার মহেন্দ্রনারায়ণ পাল চৌধুরী এবং জোতদার বিহারীলাল দে ( নুন ব্যাবসা করতো বলে নুনিয়া বাড়ি বলা হতো) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বত্বে জমি পান। আপনি কিন্তু একই গ্রামে মধ্যে জমিদার এবং জোতদারের সহাবস্থান খুবই কম দেখতে পাবেন, হয়তো পাবেনই না, গোটা দেশেই যা বিরল ঘটনা, কিন্তু মারনাই ছিল ব্যতিক্রমি একটি গ্রাম, আমি শুরুতেই বলেছিলাম যে মারনাই জমিদারি ব্যবস্থা একদমই আলাদা গোটা দেশের ইতিহাসে বিরল।
এই পালচৌধুরী জমিদার বাড়ি এবং জোতদার দে নুনিয়া বাড়ি কে কেন্দ্র করেই মারনাই এর ইতিহাস আবর্তিত হয়ে আসছিলো। সমৃদ্ধ গ্রাম মারনাই তে দেখার মত কি কি আছে সেগুলো এক এক তুলে ধরছি...
১. মারনাই জমিদারবাড়ি
২. নুনিয়া বাড়ি।
৩. কাছারী বাড়ি।
৪. ভূতেশ্বর মহাদেব জিউ মন্দির।
৫. প্রমথেশ্বর জিউ মন্দির।
৬. জেলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম স্কুল মারনাই শরচ্চন্দ্র হাই স্কুল
৭. মারনাই রামকৃষ্ণ সেবাসংঘ।
৮. হিন্দু মিলন মন্দির/ ভারত সেবাশ্রম সংঘ।
9. ঘৃততলাতে মহানন্দা - সুঁই নদীর মিলনস্থল।
৮. করনদিঘীর সাবধানের নীলকুঠি :- করনদিঘীর নীলকুঠি বর্তমানে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। অবস্থান করনদিঘী ব্লকের লাহুতারা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের সাবধান এলাকায়। এলাকায় নীলকুঠি থাকার জন্য গোটা এলাকার নামই নীলকুঠি হয়ে যায়। ব্রিটিশ আমল থেকেই নাগর নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নীল চাষের পক্ষে অনুকূল থাকায় নীল চাষ শুরু করে ব্রিটিশরা। সম্ভবত উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে এখানে এই নীলকুঠি টি স্থাপিত হয়। এলাকাটি পুরোপুরি আদিবাসী অধ্যুষিত। হয়তো নীলকুঠিতে কাজ করার জন্য তাদের এখানে আনা হয়ে থাকতে পারে। 26 জানুয়ারি দিন এখানে বিরাট বড় করে অনুষ্ঠান হয় ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে।
নীলকুঠিতে 6 টি চৌবাচ্চা আছে এবং একটি বড় উনোন যা বর্তমানে সংস্কার করা হয়েছে। এটি চারদিকে পরীখা দিয়ে ঘেরা ছিল যা পার্শ্ববর্তী নাগর নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল।
কেমন করে যাবেন - রায়গঞ্জ থেকে করনদিঘী NH34 ধরে বোতলবাড়ি তে নেমে 12 কি.মি যেতে হবে সাবধানে। সাবধান থেকে মাত্র 2 কি.মি দূরে এই নীলকুঠি।
আরো পড়ুন - উত্তর দিনাজপুর জেলার ১০ টি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল
৯. রায়গঞ্জ ক্যাথিড্রাল চার্চ :- উত্তর দিনাজপুর আসবেন আর রায়গঞ্জের এই চার্চ দেখবেন না এটা হতেই পারে না। রায়গঞ্জের কুলিক পক্ষীনিবাস যতটা জনপ্রিয় কিন্তু তার তুলনায় রায়গঞ্জের এই সেন্ট জোসেফ ক্যাথিড্রাল চার্চ এতটা জনপ্রিয় ও চির পরিচিত না। কিন্তু আমার কথা যদি শোনেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে এই চার্চ থেকে একবার ঘুরে যাওয়া উচিৎ, এতো সুন্দর এবং এত বৃহৎ চার্চ আপনি আমাদের রাজ্যে খুবই কমই দেখেছেন। রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৭ কি.মি দূরে ছটপড়ুয়াতে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম এই চার্চ।
Raiganj Cathedral Church. |
এই চার্চের ইতিহাস যদি দেখা হয় তাহলে দেখা যায় ১৯৬২ সাল থেকে এই চার্চের যাত্রা শুরু তখন একটি মাত্র ছোট ঘর থেকে অ্যালবিনাস কুজুর এই চার্চের সূত্রপাত করেন। বর্তমানে আমরা চার্চের যে আধুনিক রূপ দেখতে পাই তার উদ্বোধন হয় ২০১০ সালে। একদমই পুরোপুরি ইউরোপীয় আদলে গঠিক, গ্রীক ও রোমান স্টাইলে বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন উচ্চমানের মার্বেল, টাইলস্ গ্লাস সাহায্যে এই চার্চ নির্মাণ করা হয়, এরকম গঠনের চার্চ আমাদের দেশে একদমই নতুন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও হয়েছিলো খুব জমকালো ভাবে। ক্ষেত্রফলের দিক থেকে একসময় এটি চার্চ ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চার্চ। এর উচ্চতা ৯০ ফিট।
কেমন করে যাবেন - রায়গঞ্জ থেকে বাসে যেতে চাইলে শিলিগুড়ি মোড় বা বাস স্ট্যান্ড থেকে যেকোনো লোকাল বেসরকারি কালিয়াগঞ্জ গামি বাসে উঠলেই আপনাকে নামিয়ে দেবে। তা না হলে সবচেয়ে ভাল হবে বাস স্ট্যান্ড বা শিলিগুড়ি মোড় থেকে হেমতাবাদগামী যেকোনো অটো তে উঠে পড়ুন আপনাকে একদম চার্চের সামনে নামিয়ে দেবে। ২৫ ডিসেম্বরের সময়ে এখানে বিরাট মেলা বসে এবং প্রচুর লোকের সমাগম হয়, তাছাড়াও বছরের সারা বছরই এই চার্চ খোলা থাকে, যেকোনো দিন আসতে পারেন বিকেল ৫ টার মধ্যে।
১০. বাহিন জমিদারবাড়ি :- রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরে বাহিন গ্রাম। এই বাহিন গ্রামেরই নাগর নদীর একদম পারে গড়ে উঠছিল প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো বাহিন রাজবাড়ি, যেটি মুলত একটি জমিদারবাড়ি। নদীর উল্টো দিকেই আছে বিহার রাজ্য, বিহারের কাটিহারের বারসই ব্লক। দুই রাজ্যের মাঝে এই জমিদার বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিলো। তৈরি করেছিলেন জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী।
বাহিন জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠাত জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন উত্তর দিনাজপুর জেলার চূড়ামন জমিদারবাড়ি জমিদার মহেন্দ্রপ্রসাদ রায় চৌধুরীর দত্তকপুত্র। পারিবারিক বিবাদের ফলে তিনি বাহিন চলে আসেন। তিনি অনেক ভেবে চিন্তেই এই জায়গাটিকে নির্বাচন করেছিলেন। জমিদার সত্যনারায়ন রায়চৌধুরীর সময়ে এই জমিদারির অবসান ঘটে। তারপর থেকে বসবাসের অভাবে এই জমিদারবাড়ি অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। বর্তমানে এই জমিদার বাড়ির অবস্থা খুবই সঙ্গিন বেশ কিছুদিন এই জমিদার বাড়ি ভারত সেবাশ্রমের দেখাশোনাতে ছিল, কিন্তু জরাজির্ণ এই বাড়ির সংস্কার সেভাবে না হওয়ায় দিনে দিনে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে আসছে। বেশ কিছুদিন হলো এই জমিদারবাড়িকে হেরিটেজ কমিশন থেকে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, এখন শুধুই সংস্কারের অপেক্ষা। সংস্কার হলে যেমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন এই বাড়ি ধংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে তেমনি পর্যটনের খুবই বিকাশ ঘটবে। বর্তমানে এই বাড়িটিকে একটি পুলিশ ফাঁড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
Bahin Jamidarbari |
রায়গঞ্জ শহর থেকে মাত্র ১৫ কি.মি দূরে এই বাহিন গ্রাম ।রায়গঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে আপনি ছোটো গাড়ি অটো এবং টোটো ও পেয়ে যাবেন এই জমিদারবাড়িতে বা বলতে গেলে বাহিনে আসার জন্য। আপনি চাইলে একটি টোটো রিজার্ভও করে নিতে পারেন আর বাইক থাকলে তো কোনো ব্যাপারই নেই।
১১. স্বামীনাথ মন্দির :- উত্তর দিনাজপুর আরো একটি প্রাচীন মন্দির হল ইটাহার ব্লকের হাসুয়ার স্বামীনাথের মন্দির। যে মন্দিরের সাথে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস ও মাহাত্ম্য এবং যে মন্দিরকে কেন্দ্র করে আয়োজন হয় এই জেলার বৃহত্তম স্বামীনাথের মেলা।
ভূপালপূর জমিদারবাড়ির জমিদার ভূপালচন্দ্র রায়চৌধুরীর মা দুর্গাময়ী চৌধুরী তার স্বর্গীয় শ্বাশুরীর পদ্মাবতী দেবীর শুভ সংকল্প অনুসারে 1321 বঙ্গাব্দে 25 শে বৈশাখ ইংরেজির 1914 সালে স্বামীনাথের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন হাসুয়া নামক স্থানে কারন এখানেই এই মূর্তিটি পাওয়া যায়। দুর্গাময়ী চৌধুরী তার স্বর্গীয় শ্বাশুরীর উদ্দেশ্যে এক কবিতা লিখেছিলেন, কবিতাটি মন্দিরের কালো পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে। জমিদার ভূপালচন্দ্র রায়চৌধুরী স্বামীনাথের স্বপ্নাদেশ পেয়ে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন তার পুজো শুরু করেন। এই দিন জমিদার বাড়ির বংশধরেরা হাসুয়ায় গিয়ে স্বামীনাথ ও সীতাকে স্বর্ণলঙ্কারে ভূসিত করেন। তারপরই মন্দিরে পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এই দিনে মন্দিরে বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়। তাই এদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পূজা চলতে থাকে। মেলার দিন থেকে জমিদারবাড়ির বংশধরেরা প্রায় সবাই এখানে উপস্থিত থাকে। মন্দিরের কারুকাজ একদম দেখার মত। বর্তমানে মন্দিরের সেবাইত শিবপ্রসাদ রায়চৌধুরী, তার উদ্যোগে মন্দিরে নিত্য পূজাপাট করা হয়।
স্বামীনাথের মন্দিরের ভিতরে যে কালো কোষ্টিপাথরের যে মূর্তিটি বিদ্যমান সেটি আসলে বিষ্ণুমূর্তি। মন্দিরের ভিতরে যতো গুলো মূর্তি আছে তারমধ্যে এই মূর্তিটি সবচেয়ে সুন্দর। তাই এই মূর্তিটি মন্দিরের একদম মাঝখানে অবস্থিত। মূর্তিটির উচ্চতা সাড়ে চারফুট, চওড়ায় দুই ফুট। রূপার বালা পরিহিত, চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। কপালে সোনার টিপ, গলাতে সোনার হার, পরনে শুভ্র বসন। মাঝে মধ্যে ঘি মাখনের জন্য মূর্তিটি খুব উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করেছে। বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন মূর্তি টিকে রূপালি অলঙ্কার দ্বারা সজ্জিত করে তোলা হয়। মূর্তিটি সাতদিন এভাবেই থাকে। এই সময়ে ভক্তবৃন্দ মূর্তিটির পা-দুখানি দেখতে পায়। বছরের অন্যদিন গুলিতে সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে। কেবলমাত্র মুখটি বেরিয়ে থাকে। মন্দিরের পাশেই আছে জোড়া শিব মন্দির। কথিত আছে নাকি যে স্বামীনাথের শিব বেলতলার নিচে মাটি থেকেই উঠে এসেছে। জমিদার ভূপালচন্দ্র রায়চৌধুরী উদ্যোগেই ওখানে শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়। শিবরাত্রির দিন এখানে প্রচুর ভিড় হয়। স্বামীনাথের মন্দিরে স্বামীনাথের মূর্তিটি ছাড়াও আরও কিছু মূর্তি দেখতে পাবেন, যেমন কালোপাথরের মনসা,রাধা কৃষ্ণ, গণেশ, একুশটি সালগ্রাম শিলা, জগন্নাথ, বলরাম, শুভদ্রা মূর্তি দেখা যায়।
১২. কালিয়াগঞ্জের মহেশপুর জমিদারবাড়ি :- কালিয়াগঞ্জ শহর থেকে ৭,৮ কি.মি দূরে কুমারী নদীর তীরে অবস্থিত মহেশপুর গ্রাম। উর্বরা শক্তি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই গ্রাম অবস্থিত ধনকৈল - ফরিদপুর সড়কের ওপরে। এই মহেশপুর গ্রামেই ১৯৩২ সালে এই মহেশপুর জমিদারবাড়িটি গড়ে তোলা হয়। এই জমিদারবাড়ির দানের জমিতেই গড়ে ওঠে কালিয়াগঞ্জ পার্বতী সুন্দরী উচ্চবিদ্যালয়।
মহেশপুর জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন যজ্ঞেশ্বর মন্ডল। তার স্ত্রী ছিলেন পার্বতী সুন্দরী যার নামে কালিয়াগঞ্জের পার্বতী সুন্দরী উচ্চ বিদ্যালয়। নাহার এস্টেটের এই অঞ্চলের জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। সেই কারণে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমুন্ডী ব্লকের মাকোল থেকে মহেশপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের জমির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০০ বিঘা। পরবর্তীকালে তাকে রায়চৌধুরী উপাধিতেও ভূষিত করা হয়।
১৯৩২ সালে মহেশপুরে এই দোতলা জমিদারবাড়িটি নির্মাণ করা হয়। বাড়ির একতলায় তিনটি ঘর এবং দোতলায় একটি ঘর নির্মাণ করা হয় দক্ষিণবঙ্গ থেকে মিস্ত্রি এনে। ১৯৪২ সালে এই বাড়ির পাশে আরো একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। পুরো ঘটনাটির দশ বিঘের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলো এই পুরো বাড়িটি, এখন বর্তমানে অল্প কিছুই অবশিষ্ট আছে। জমিদার যজ্ঞেশ্বর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার পুত্র জীবন কৃষ্ণ রায়চৌধুরী এই জমিদারির দেখা শোনা করেন।
১৩. ভেলাই জমিদারবাড়ি :- কালিয়াগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১০ কি.মি দূরে শ্রীমতী নদীর তীরে অবস্থিত ভেলাই গ্রাম। এই ভেলাই গ্রামেই অবস্থিত ভেলাই জমিদারবাড়ি এই জমিদারীর পত্তন করেন জমিদার মধুসূদন চৌধুরী।
জমিদার মধুসূদন চৌধুরীর আদি বাসস্থান ছিলো বর্ধমান জেলায়। মধুসূদন চৌধুরীর দাদা দ্বারকানাথ চৌধুরী বড়াল এস্টেটে চাকরি করতেন। বড়াল এস্টেটের কাছ থেকে ভেলাই এলাকার এই জমিদার কিনে নেন দ্বারকানাথ চৌধুরী। এবং এর পরিচালনাল দায়িত্বভার দেওয়া হয় মধুসূদন চৌধুরীকে।
এই জমিদারির অধীনে ছিল প্রায় ৭০০- ৮০০ বিঘা জমি যার মধ্যে ছিল হেমতাবাদ থানার বামোর এবং কালিয়াগঞ্জ থানার ভেলাই মৌজা। এই জমিদার দেখভালের জন্য ভেলাই গ্রামে প্রায় ২০ বিঘা এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় ভেলাই জমিদারবাড়ি। জমিদার মধুসূদন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার খুরতুতো ভাই শরচ্চন্দ্র চৌধুরী এই জমিদারি দেখভালের দায়িত্ব পান।জমিদার শরৎচন্দ্র চৌধুরীর ছেলে ভুপালচন্দ্র চৌধুরীর আমলেই এই জমিদারির উচ্ছেদ ঘটে।
১৪. হেমতাবাদের বামোরের তারাসুন্দরী মন্দির :- হেমতাবাদের বিষ্ণুপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বামোর গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন তারাসুন্দরী মন্দির যা বর্তমানে হেরিটেজ মন্দির।
মুঘল যুগের সময়কার এই মন্দিরের অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও প্রচারে অভাবে তা অনেকের কাছেই অজানা। মন্দিরের আরেক নাম রানী ভবানীর মন্দির এবং কাশি ঠাকুরের মন্দিরও বলা হয়। প্রতিবছর দীপ্নানিতা অমাবস্যায় কালি মূর্তি গড়ে এখানে কালী পূজার আয়োজন করা হয়।
Tara Sundari Temple Bamoir. |
কেমন করে পৌঁছোবেন এখানে:- হেমতাবাদ থেকে 17 কি.মি দূরে এই মন্দির। হেমতাবাদের বিষ্ণুপুর হাটের খুব কাছেই এই মন্দির ওখানে গিয়ে যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে। আবার কেউ কেউ চাইলে সমাসপুর হয়েও যেতে পারেন একটু দূর বেশি হবে কিন্তু রাস্তা খুব ভালো পাবেন। আবার কেউ কেউ চাইলে বিন্দোল হয়েও যেতে পারেন, বিন্দোলের ভৈরবী মন্দির দেখে এটাও সাথে দেখে নিতে পারেন।
১৫. ভাতুরা রাজা গণেশের গড় :- বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটেছিল বখ্তিয়ার খলজী ১১৯১খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে। তারপর বাংলায় চলে প্রায় ৬০০ বছর ধরে মুসলিম শাসন, এই শাসনাকালে ইলিয়াসশাহী, হুসেনশাহী,হাবসী, নবাবী প্রভৃতি বংশের দ্বারা বাংলা শাসিত হয়। এই ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনে বাংলার একমাত্র হিন্দু শাসক ছিলেন আজ যাকে নিয়ে আমরা চর্চা করবো তিনি হলেন রাজা গণেশ বা ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশ নারায়ণ ভাদুড়ী।রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার।তিনি ব্রাহ্মণ বংশীয় ভাদুড়ী বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সম্ভবত ভাদুড়ী থেকেই নামটি (ভাদুড়ীয়া > ভাতুরিয়া) এসে থাকতে পারে।তিনি মুসলিম শাসনের দুর্বলতার সুযোগে মুসলিম শাসককে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেন।
নিজ রাজ্যে সুরক্ষার জন্য তিনি বিভিন্নস্থানে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন, উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ ব্লকের বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া ভাতুরাতেও দূর্গ গড়ে তুলেছিলেন। ইলিয়াসশাহী বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজমশাহের রাজত্বকালে রাজা গণেশ তার রাজস্ব ও শাসন বিভাগের প্রধান হয়ে ওঠেন গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ হিন্দুদের উচ্চপদ থেকে সরানোর স্বরযন্ত্র করছিলেন। তাই রাজা গণেশের নেতৃত্বে হিন্দু আমিররা গিয়াসউদ্দিন হত্যা করে। এবং সেনাবাহিনীর সাহায্যে গিয়াসউদ্দিন এর ছেলে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে সিংহাসনচ্যূত করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন । ভাতুরা সন্নিকটে শমসপুরে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের ছেলে শমস্উদ্দিনের সাথে তার যুদ্ধ হয় যুদ্ধে গণেশের হাতে শমস্উদ্দিনের মৃত্যু হয়, আর এই শমস্উদ্দিনের নাম অনুসারেই জায়গাটির নাম হয় শমসপুর।
রাজা গণেশ হেমতাবাদের ভাতুরাতে যে দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন তা বর্তমানে মাটির উচু ঢিপিতে পরিনত হয়েছে। এই ঢিপির পশ্চিমে বিনা নদী এবং পূর্বে গামারী নদী। এই গামারী নদীর অংশটি বর্তমানে ঢোডর বিলে পরিণত হয়েছে, পূর্বে এটি গামারী নদীর অংশ ছিলো। দক্ষিণে ছিল একটা বড় পরিখা, আজ ও তার নিদর্শন আছে, সুতরাং এই ঢিপি যে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ছিলো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রামের উত্তর ও দক্ষিণে সাঁকরাইল ও কাতলাসই নামে দুটি প্রাচীন পুকুর রয়েছে সেখানে বাঁধানো সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।রাজা গণেশকে ফার্সিতে যে "হাকিম দিনওয়াজ" বলা হয়েছে বর্তমান ঐতিহাসিকদের মতে তা দনুজর্মদনদেবের অপ্রভ্রংশ মাত্র। মনে করা হয় এই "দনুজ" থেকেই দিনাজপুর নামের উৎপত্তি।
১৬. চূড়ামন জমিদারবাড়ি :- ইটাহার থেকে প্রায় ৭-৮ কি.মি দূরে মহানন্দা নদীর পাশে অবস্থিত চূড়ামন। এই চূড়ামনেই গড়ে উঠেছিলো এক জমিদারবাড়ি যা এখন প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়ে গেছে। মহানন্দা নদীর তীরে এক বিশাল জমিদারবাড়ি তৈরি করা হয়। সেই সময়ে মহানন্দা বেশ উত্তাল ছিলো এবং মহানন্দার জল প্রবল বেগে তীরে আছড়ে পড়তো। তার ফলেই জমিদারবাড়ি ধীরে ধীরে মহানন্দার গর্ভে পতিত হতে থাকে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা রোধ করা যায়নি। জমিদারবাড়ি বেশিরভাগ ধ্বংসাবশেষই মহানন্দার তলে চলে গিয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো নদী তীরবর্তী জঙ্গলাকীর্ন উচু ঢিপির মধ্যে দেখা যায়। এই জমিদারবাড়িটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গেলে,তারপর তারা ভূপালপূরে চলে আসেন। জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায়চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তার নাবালক পুত্র ভূপালচন্দ্র রায়চৌধুরী উত্তরাধিকারীরা হোন। ভূপালচন্দ্রের নামেই এই এলাকাটি নাম হয় ভূপালপূর। ভূপালপূরের পাশেই আছে দুর্গাপূর, যার নাম হয় ভূপালচন্দ্রের মা দুর্গাময়ী রায় চৌধুরীর নামে।
Churaman Jamidarbari. |
১২০০ বঙ্গাব্দের শেষের দিকে চূড়ামন জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র রায় চৌধুরী মারা যান। তার মৃত্যুর পর, এবং মহানন্দার জলে জমিদারবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে জমিদারবাড়ির লোকেরা ভূপালপূরে চলে আসে। জমিদার কৃষ্ণচন্দ্র সেইসময়ে নাবালক ছিল তাই ব্রিটিশ সরকার তার দেখাশোনার ভার গ্রহণ করে। এই সময়ে ব্রিটিশ সরকার এই রাজবাড়ীর একতলাটি তার থাকার জন্য তৈরি করে দেয়। আর বাড়ির দোতলাটি জমিদার ভূপালচন্দ্র তৈরি করেন।
১৭. গোয়ালপাড়া মসজিদ / মহন্ত মসজিদ :- রায়গঞ্জের পূর্বদিকে বরুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত গোয়ালপাড়া গ্রাম। মোগল আমলে দক্ষিণ গোয়ালপাড়ায় মুসলিমদের প্রাধান্য ছিল তাদের উদ্যোগেই দক্ষিণ গোয়ালপাড়ায় দুটি মসজিদ তৈরি করা হয়েছিলো। তার মধ্যে একটি মহন্ত মসজিদ এবং অনতিদূরেই আছে আরো একটি মসজিদ। এই এলাকা পূর্বে পাঁচ পুকুর নামেও পরিচিত ছিল, সেই পাঁচটি পুকুর আজও এই এলাকায় দেখা যায়।
Mahanta Masjid, Raiganj. |
মহন্ত মসজিদের দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ২৫ ফুট। মসজিদে আছে তিনটি খিলান যুক্ত দরজা, তিনটি গম্বুজ। মনে করা হয় এই মসজিদটি রাজা গণেশের ছেলে জালালউদ্দিনের সময়কালে নির্মিত হয়েছিল। অতীতে এই মসজিদে লোক মহিলা প্রবেশ করে নি, বর্তমানেও কোনো মহিলা প্রবেশ করার সাহস পায়না। মসজিদের পার্শ্ববর্তী ফটিক চন্দ্র মহন্ত এই মসজিদের দেখাশোনার কাজ করে তাই এই মসজিদ মহন্ত মসজিদ হিসেবে পরিচিত। তার উদ্যোগেই মসজিদ প্রাঙ্গণে রাধাকৃষ্ণ মন্দির গড়ে উঠেছে।
আরো পড়ুন - উত্তর দিনাজপুর জেলার ১০ টি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল
১৮. রাজা মহেশের ঢিপি :- মধ্যযুগে বাংলায় সুলতানী আমলে রাজা মহেশ একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তার বংশ পরিচয় নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায়না, তবে যেটুকু জানা যায় যে, তিনি একজন ধর্মপ্রাণ, প্রজারঞ্জন এবং শক্তিশালী রাজা ছিলেন, বেশ কয়েকটি অঞ্চল তার শাসনাধীনে ছিলো। আর এই সমস্ত অঞ্চলগুলি একসাথে "মহেশ পরগনা" নামে পরিচিত ছিলো আর তার প্রাসাদ সংলগ্ন এলাকা যেটা বর্তমানে কমলাবাড়ি হাট ও আসে পাশের কিছু এলাকা, সেটাকে "কশবা মহেশো" বলে অভিহিত করা হয়।
Raja Mahesh Dhipi, Kasba Maheso. |
কশবা মহেশো এলাকাতেই তার প্রাসাদ ছিলো। তার এই প্রাসাদ উচু প্রাচীর দ্বারা বেস্তিত ছিলো। সেই প্রাসাদ থেকে এক সুরঙ্গপথ মিরুয়ালের হোসেন শাহ মাজার বা চাঁদ শাহের মাজার (যেটা বর্তমানে মিরুয়ালের বিএসএফ ক্যাম্পের পিছনে এক উচু ঢিপির ওপরে অবস্থিত) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
একজন পীর ছিলো পীর বদরুদ্দিন, তিনি সবসময় বিধর্মী রাজা মহেশ উৎখাত করতে চেয়েছিলেন, সেইজন্য তিনি তখনকার বাংলার সুলতান হুসেনশাহ কে হিন্দু রাজা মহেশকে উৎখাত করার জন্য আমন্ত্রণ জানান, কথিত আছে নাকি যে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মহেশের প্রাসাদ আক্রমন করেছিলেন। বলা হয় সুলতান হুসেন শাহের রাজা মহেশের রাজপ্রাসাদ আক্রমনকালে তিনি ঐ সুরঙ্গপথ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সুরঙ্গপথের শেষ প্রান্ত অর্থাৎ মিরুয়ালের কাছে এসে হুসেনশাহের সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান, সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। তারপর ঐ স্থানে হুসেন শাহ তার বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেন যা হুসেন শাহের তখত্ নামেও পরিচিত। বর্তমানে এর কিছুই অবশিষ্ট নেই, বর্তমানে এখানে পীরশাহের মাজার আছে। যার অবস্থান মিরুয়ালের বিএসএফ ক্যাম্পের একদম পিছনে গোবিন্দপুর গ্রামে।
১৯.গোবিন্দপুরের হোসেন শাহের বিজয় স্তম্ভ চাঁদ শাহের মাজার ও ফকিরদিঘি :- রায়গঞ্জের ১৪ নং কমলাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত মিরুয়ালের বিএসএফ ক্যাম্পের ঠিক পেছনে গোবিন্দপুর গ্রামে ২৫ ফিট উচ্চতা বিশিষ্ট একটি ঢিপির ওপরে অবস্থিত চাঁদ শাহের মাজার। মনে করা হয় সুলতানী আমলে রাজা মহেশ কমলাবাড়ি হাট সংলগ্ন তার রাজ প্রসাদ থেকে গোবিন্দপুর পর্যন্ত একটি সুরঙ্গপথ খনন করেছিলেন ।এই সুরঙ্গপথের মুখেই তৈরি করেন একটি বড় দিঘি, যা বর্তমানে ফকিরদিঘি নামে পরিচিত।
Husen Shah, Chand Shah, Mazar. |
সুলতান হোসেন শাহ রাজা মহেশের রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করলে রাজা মহেশ সেই সুরঙ্গপথ দিয়ে পালানোর সময়ে শেষ প্রান্ত গোবিন্দপুরে এসে হোসেন শাহের নমস্কার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, এবং সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। তারপর ঐ স্থানে হোসেন শাহ বিজয় স্তম্ভ স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে ওখানে চাঁদ শাহের মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। বেশিরভাগ সময়ে এই এলাকা জঙ্গলে ঢেকে থাকে, এবং বছরে একবার এখানে উরুস উৎসব ও পালিত হয়।
২০. করনদিঘীর শিরুয়ার মেলা :- রাজা কর্ণের স্মৃতি বিজড়িত করনদিঘীর মেলা যার সূচনা হয় নববর্ষের দিন থেকে।
এই মেলার আরেক নাম করনদিঘীর শিরুয়ার মেলা। সূচনা করেন পুর্নিয়ার রাজা পি সি লাল। উত্তর দিনাজপুরের জেলার বড় মাপের মেলা গুলোর মধ্যে অন্যতম এই মেলা। মহাভারতের আমলে এই এলাকা অঙ্গ মানে বিহার রাজ্যের অধীনে ছিল। সেই সময় অঙ্গরাজ কর্ণ এই দিঘিতে তর্পণ করতেন তারপর থেকেই এই দিঘীর সাথে কর্ণের নাম যুক্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে পুরো এলাকার নামই এই দিঘীর নামে হয়ে যায়।
Siruar Mela Karandighi. |
ব্রিটিশ আমলে এই এলাকা পুর্নিয়ার রাজা পি সি লাল এর অধীনে ছিলো। দিঘীর পাশে রাজার একটি কাছারী বাড়িও ছিলো। সেখানে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে হালখাতা উৎসব পালিত হতো, বহু প্রজা তাদের কর জমা দিতে আসতেন। প্রজাদের মনোরঞ্জের জন্যই রাজা পি সি লাল এই মেলার সূত্রপাত করেন। এই দিঘীর জলকে খুব পবিত্র মনে করা হয়, তাই মেলা উপলক্ষে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে প্রচুর মানুষের সমাগম হয় এই দিঘী ও মেলাতে।
২১. রায়গঞ্জের পীরপুকুরের দরগা :- রায়গঞ্জের উকিল পাড়ায় পীরপুকুরের পাড়ে এই দরগা অবস্থিত। দরগা বলতে বোঝায় পীরের কবর ও তৎসংলগ্ন পবিত্র স্থান। ইট চুন, সুরকি দিয়ে তৈরী এই দরগা বর্তমানে হেরিটেজ কমিশনের দ্বারা সংস্কার ও করা হয়েছে। দরগা সংলগ্ন পুকুরটিকে পীরপুকুর বলা হয়।
Darga, Pirpukur, Raiganj. |
মনে করা হয় এই দরগা পূর্বে মন্দির ছিল সম্ভবত তুর্কি আক্রমণের সময়ে মন্দিরের মূর্তিগুলোকে পার্শ্ববর্তী পীর পুকুরের জলে ফেলে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পুকুরের মাটি কাটতে গিয়ে সেন আমলের কিছু মূর্তি উদ্ধার হয়। বড়ম সউদ পীর এই দরগায় থাকতেন। তার মৃত্যুর পর পাশেই তার মাজার তৈরী করে দেওয়া হয়। এই দরগার ফকিররা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহে অংশ গ্রহন করেছিলেন। বিদ্রোহের নেতারা প্রায়ই এখানে আসতেন। প্রতি বছর ১লা বৈশাখের দিন থেকে এখানে মেলা বসতো যা চার দিন ধরে চলতো, বর্তমানে এই মেলা একদিনই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
২২. রায়গঞ্জের ঐতিহাসিক দীপরাজার দীঘি :- এই দীঘি রায়গঞ্জের ৭নং শীতগ্রাম অঞ্চলের দীপনগর মৌজায় প্রায় ১৭ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত।প্রাচীনকালে এখানে লুপ্তপ্রায় কাঞ্চন নদীর তীরে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে এই দীপনগর বিস্তৃত ছিল।
পাল আমলে দীপ নামক এক রাজা এই দীঘি খনন করেছিলেন, সেইজন্যেই এর নাম দীপরাজার দীঘি, স্থানীয় মানুষেরা যাকে বড়দীঘি বলে ডাকে। এই এলাকায় এই দীঘি ছাড়াও নানাহার, কেশাহার, বোচাহার এবং ঊষাহার নামে জলাশয়ও রয়েছে, যেগুলোও দীপ রাজার উদ্যোগে খনন করা হয়। দীপরাজার দীঘি উত্তর পশ্চিমদিকে আছে রানী দীঘি,এই দীঘিতে রানী নামতেন তাই এই নাম। তাছাড়া দীপনগর থেকে প্রাপ্ত পাথরের মূর্তিগুলোও পাল আমলের, ১৯১৯ সালে এই মজে যাওয়া এই দীঘি সংস্কার করা হয়, তখন এখানে বাঁধানো ঘাট সহ অনেক কিছুই পরিলক্ষিত হয়।
Historical Dwiprajar Dighi. |
দীঘির উত্তর পাড়ে একটি সুবিশাল অশ্বত্থ গাছের নিচে প্রতিষ্ঠিত একটি বেদী, যা দীপ রাজা ঠাকুরের বেদী নামে পরিচিত। এখানে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির দিন পুজো হয়, দূর দূরান্ত পূর্নাথীরা দীঘির জলে স্নান করে, তাদের মানত দীঘির জলে সমর্পণ করে। সেই উপলক্ষে এখানে মেলাও বসে।
এই দীঘিতেই এবার নতুনঅতিথি এসেছে - Tundra Bean Goose যার সংখ্যা মাত্র ২টি এছাড়াও এখানে প্রচুর পরিমাণে Greylag Goose নামে এই হাঁসটি দেখতে পাবেন 😍😍 প্রতি বছর শীতকাল হলেই রায়গঞ্জের ঐতিহাসিক দীপরাজার দীঘিতে এই পরিযায়ী পাখিদের দেখা যায়।
২৩. রায়গঞ্জের টেনহরি এক প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম :-
রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪ কি.মি দূরে অবস্থিত টেনহরি গ্রাম সেন বংশের আমলে খুবই বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছিলো। এই গ্রামে অবস্থিত সন্ন্যাসী ভিটা, পাতালঘোড়া জলাশয়, বল্লাল দীঘি, নিহালি বিল তারই পরিচয় বহন করে। বল্লাল সেনের আমলে টেনহরি গ্রামে পাতালঘোড়া জলাশয়ের সামনে একটি মন্দির গড়ে উঠেছিলো, সেখানে বিষ্ণু ও মহাদেবের খুবই নিষ্ঠার সাথে পুজো করা হতো। পাতালঘোড়া জলাশয় এই মন্দিরের পূজার্চনার জন্যই খনন করা হয়েছিলো। পাশে ঘাট ও বাঁধানো হয়। তখন এই জলাশয় যথেষ্ঠ গভীর ছিল, শোনা যায় নাকি সেই সময়ে একটি ঘোড়া এই জলাশয়ে পড়ে ডুবে হয়, তারপর থেকেই নাকি জলাশয়টি পাতালঘোড়া নামে পরিচিত লাভ করে। তখন এই মন্দিরে কারুকার্যময় সাড়ে ছয় ফুটের বিষ্ণু মূর্তিটি দেখতে প্রচুর মানুষ ভিড় জমাতো।
Tenohari, Raiganj. |
বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের পর মুসলিম আক্রমনের ভয়ে গ্রামবাসীরা মূর্তিগুলোকে পার্শ্ববর্তী পাতালঘোড়া জলাশয়ে ডুবিয়ে দেয়। তারপর থেকেই মন্দিরে পূজাপাঠ একদমই বন্ধ হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে মন্দিরটি ধংসস্তূপে পরিণত হয়ে পড়ে।
১৯৮১ সালে চৈত্র পূর্ণিমার দিন পাতালঘোড়া জলাশয় সংস্কার করতে গিয়ে এই মূর্তিগুলি উদ্ধার হয়। সেন আমলের পুরনো মন্দিরের ভিতের ওপরেই বর্তমানে মন্দিরটি গড়ে তোলা হয়। তাছাড়া পুরনো মন্দিরের একটি পাথরের স্তম্ভও উদ্ধার হয় যেটি এখন বারান্দায় ব্যবহার হচ্ছে। মন্দিরে বর্তমানে ৩ ফুট ২ ইঞ্চির একটি বিষ্ণুমূর্তি, এবং সাড়ে ছয় ফুটের বিষ্ণুর দশাবতার মূর্তি রাখা আছে। দুটি মূর্তি এই মন্দির থেকে চুরিও হয়ে গেছে। এই দশাবতার থেকেই টেনহরি গ্রামের নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। বাংলায় এতো বড় কষ্টি পাথরের প্রাচীন বিষ্ণুমূর্তি খুবই কম দেখতে পাবেন। সমগ্র দসাবতার মূর্তিটির কারুকাজ খুবই অপরূপ।
সেন রাজারা বৈষ্ণব ও শৈব ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য এই মন্দিরে মহাদেবের পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেইসময় যে শিবলিঙ্গটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা ছিল সেটিও সেই সময়ে পাওয়া গিয়েছিলো, মন্দিরে ভেতরে সেটি এখনো রাখা আছে। বর্তমানে গ্রাম বাসিদের উদ্যোগে প্রতি বছর চৈত্র পূর্ণিমার দিন মন্দিরের বাৎসরিক পূজা হয়ে থাকে। পূজা উপলক্ষে মেলারও আয়োজন করা হয়। মেলাটি নারায়ণ ঠাকুরের মেলা বলে পরিচিত। মেলা যদিও এখন শেষ হয়ে গিয়েছে কিন্তু তা সত্বেও মন্দির থেকে একবার অবশ্যই ঘুরে যেতে পারেন। এত গুরুত্বপূর্ণ এই এত বড় বিষ্ণুমূর্তি কিন্তু খুবই কম দেখতে পাবেন। আসবেন কেমন করে রায়গঞ্জের মারাইকুড়ায় বাইপাস ক্রস করেই এই টেনহরি যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দেবে মন্দির টি কোথায়।
২৪. কালিয়াগঞ্জের বয়রা কালিমন্দির :- বয়রা কালিমন্দির কালিয়াগঞ্জ শহরের লুপ্তপ্রায় শ্রীমতী নদীর অবস্থিত। প্রাচীনকালে এই শ্রীমতী নদী বিস্তৃত ও খরশ্রোতা ছিল। তখন মালবোঝাই বড় বড় নৌকা কালিয়াগঞ্জের গুদরীবাজার ঘাটে এসে লাগতো। ব্যাবসা বাণিজ্যের জন্য অনেক বনিকরা এখানে আসতো। তারা গুদরীবাজারের কাছে শ্রীমতী নদীর তীরে জঙ্গলাকীর্ন স্থানে একটি বয়রা গাছের নিচে কালি পূজার সূচনা করেন, তাই এই মন্দির বয়রা কালি নামে পরিচিত।
Boyra Kali Mandir Kaliyaganj |
ব্রিটিশ আমলে কালিয়াগঞ্জ থানার এক দারগা ছিল নাম নজমুল হক, তিনি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি তার যথেষ্ট অনুরাগ ছিল, তার উদ্যোগেই বয়রা কালিমন্দির নির্মাণ করা হয়েছিলো। তখন থেকেই এই মন্দিরে খুবই নিষ্ঠা সহকারে পূজা হতো নজমুল হকের উদ্যোগে সাতদিন ধরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, যাত্রাপালার ও আসর বসতো। পাশেই নজমু মঞ্চ নামে একটি মঞ্চ নির্মাণ করা তার স্মৃতিতে। ১৯৬৬ সালে পুরনো মন্দিরটিকে ভেঙে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। নদিয়ার কৃষ্ণনগর থেকে প্রায় ৪ লক্ষ্য টাকা ব্যয় করে গড়া একটি অষ্ট ধাতুর কালি মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
২৫. কানকির জৈন মন্দির :- সদর শহর রায়গঞ্জ থেকে প্রায় ৬৫ কি.মি দূরে ৩১ নং জাতীয় সড়কের ধারে অবস্থিত বর্ধিষ্ণু গ্রাম কানকি। সেখান দিয়ে একসময় কানখাই নামে এক নদী প্রবাহিত হতো সেই থেকেই এই কানকি নামের উৎপত্তি। প্রাচীন কাল থেকেই কানকিতে মিশ্র জনবসতির বসবাস লক্ষ্য করা যায়। যার মধ্যে ছিলো, মুসলিম, হিন্দু বাঙালি, জৈন, এবং মারওয়াড়ী। কানকির শিমুলিয়া মৌজায় ১৯২৪ মোতিলাল জৈনের উদ্যোগে একটি জৈন মন্দির স্থাপন করা হয়। কানকি এবং কিশানগঞ্জের ধর্মপ্রাণ জৈন সম্প্রদায়ের মানুষেরা এই মন্দিরের জন্য জমি ও অর্থ দান করেন।
Jain Temple, Kanki. |
১৯৩৩ সালে পূর্বের টিনের চালের মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে আয়তনের বিচারে এই মন্দিরটি গোটা উত্তর পূর্ব ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছে। তিনতলা বিশিষ্ট এই মন্দিরের বাৎসরিক পূজা হয় ভাদ্র মাসে। অসাধারণ কারুকাজে সজ্জিত এই মন্দির অবশ্যই আপনাদের একবার ঘুরে যাওয়া উচিৎ। কানকি বাস স্ট্যান্ডের একদম কাছেই এই মন্দিরটা পায়ে হেঁটেই চলে আসতে পারেন।
২৬. তমোছাড়ি মঠবাড়ি :- উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের রোহিতা নদীর তীরে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়। যা তমোছাড়ি মঠবাড়ি বা পাতালেশ্বরী বৌদ্ধ মঠ নামেও পরিচিত। এই মঠের ধ্বংসাবশেষ প্রায় ২ কি.মি জায়গা জুড়ে আছে। চারদিকে বেস্তিত প্রাচীরের সঙ্গে ভিক্ষুকদের জন্য ঘর, রন্ধনশালা, ভোজনালয় নির্মিত হয়েছিলো।
এই মঠের দেওয়াল ছিল বেশ সুউচ্চ ও সুবিস্তৃত। প্রচারের দক্ষিণেই ছিল সিংহদুয়ার। পাল আমলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। বখ্তিয়ার খলজীর সময়ে এই মঠ আক্রমণ করা হয়। পরবর্তীকালে এই মঠে খনন কার্য চলার সময়ে কিছু বৌদ্ধ মূর্তি, পার্শ্ববর্তী পুকুর থেকে লক্ষী নারায়ণের দুটি মূর্তি উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে এই জায়গা জঙ্গলাকীর্ন অবস্থায় পড়ে আছে।
২৭. অসুরাগড় :- উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া থানার সূর্যাপুর - ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ৩১ নং জাতীয় সড়কের একদম পাশে অবস্থিত এই অসুরাগড়। এই অসুরাগড়েই প্রাচীন এক দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। অসুরাগড়ে নামটি এসেছে এখানে বসবাসকারি মানুষজনের কাছ থেকে। অসুরাগড়ে বসবাস ছিল বাংলার আদিম জনজাতি অস্ট্রিক ভাষা গোষ্ঠীর লোকেদের। প্রাচীন সাহিত্যে যাদের নিসাদ বলা হয়েছে এবং বৈদিক সাহিত্যে যাদের দস্যু বা অসুর বলা হয়েছে, যাদের আদি বাসভূমি ছিল মধ্য এশিয়া। সেই থেকেই জায়গাটি নাম এসেছে অসুরাগড়।
এই অসুরাগড় থেকেই প্রাচীন কালের মৌর্য, কুষাণ এবং গুপ্ত আমলের বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এর পাশাপাশি প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি একটি গড় বা দুর্গ ছিলো এবং চারদিকে পরিখা দিয়ে বেস্তিত ছিল সেটাও স্পষ্ট লক্ষ্যনীয়। অসুরাগড় থেকে সম্রাট কনিষ্কের আমলের একটি তাম্র মুদ্রা পাওয়া গেছে। এছাড়াও এখান থেকে তামার থালা, পদক সিল প্রভৃতি পাওয়া গেছে।
মনে করা হয় গুপ্ত আমলে বিক্রমাদিত্যের সময়ে এই অসুরাগড়ে পাঁচভাই দুর্গ বা গড় নির্মাণ করেছিলেন, তাঁরা জাতিতে ছিল অসুর, তারা তামার ব্যাবসা করতো।সেই সময়ে এই এলাকা তামার সবচেয়ে বড় আড়ৎ পরিনত হয়েছিলো। বিভিন্ন দেশের বনিকরা তখন এই অসুরাগড়ে আসতো। পরবর্তীকালে এখানে মুসলিমদের আগমন ঘটে, তারাও অনেকটা এলাকা দখল করে নেয়।বর্তমানে এই দুর্গের কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
২৮. পাড়া জমিদারবাড়ি :- উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার থানার গুলন্দর - 2 গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পাড়া গ্রাম, পাশেই অবস্থিত হরিপুর গ্রাম। যাদের একত্রে পাড়াহরিপুর বলা হয়ে থাকে। এই পাড়া গ্রামেই দুর্গা প্রসাদ চৌধুরীর হাত ধরে সূচনা ঘটে পাড়া জমিদারির তাদের আদি নিবাস ছিল নদীয়া জেলায়। এই পাড়া গ্রামেই জমিদার দুর্গা প্রসাদ চৌধুরীর উদ্যোগে একটি দোতলা জমিদারবাড়ি নির্মিত হয়। এই বাড়ির মাটির নিচেও একটি ঘর ছিল যাতে মুল্যবান ধন সম্পদ রাখা থাকতো। জমিদারবাড়িতে সেই সময়ে আলো, পাখা থেকে শুরু করে, নাচগানের আসর ও বসতো।
জমিদারদের উদ্যোগে পাড়াতে ডাকঘর ও হাটের সূচনা হয়। জমিদার দুর্গাপ্রসাদ চৌধুরী গ্রামে শিক্ষা বিস্তারের জন্য জমি দান করেন। ১৯৫৪ সালে এই জমিদারির অবসান হওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটে, এবং বাড়িটি সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ হয়ে যায়।
২৯. ইসলামপুরের বোলঞ্চা জমিদারবাড়ি ও মসজিদ :- ইসলামপুর শহর থেকে প্রায় ৬ কি.মি পূর্বে অবস্থিত বোলঞ্চা গ্রাম। এই বোলঞ্চা গ্রামের জাবাহের আলীর হাত ধরে বোলঞ্চা জমিদারি, জমিদারবাড়ি ও মসজিদের পত্তন ঘটে। কথিত আছে নাকি মোঘল আমলে আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিং একবার এসেছিলেন।
এই এলাকায় জাবাহের আলীর বেশ দাপট ছিলো। সেই কারণে পূর্নিয়ার রাজা পি সি লাল বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার বিঘা জমির খাজনা আদায়ের দায়িত্ব দেন, সেই থেকেই জমিদারির সূচনা। বোলঞ্চাতে ২ বিঘা জমির ওপরে তিনি এক জমিদারবাড়ি গড়ে তোলেন। সংস্কারের অভাবে জমিদারবাড়িটি জরাজীর্ন আকার ধারণ করেছে। দু এক জায়গায় তাদের কাছারী বাড়ি ও ছিল। রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে দিঘি খনন দান ধ্যান প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাদের অনেক অবদান ছিল।
এই জমিদারবাড়ি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব হল বোলঞ্চার এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এর দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট, প্রস্থ ২১ ফুট, উচ্চতা ৩০ ফিট মসজিদের চার দিকের দেওয়ালেই অসাধারণ কারুকাজ বিদ্যমান। মসজিদের চারটি খিলানের ওপরে গোলাকার বৃহৎ গম্বুজটি অবস্থিত। মসজিদের সামনে এবং পেছনে সর্বমোট ৮ টি মিনার রয়েছে।
৩০. বাগিন্দরের রাজবাড়ি ভগ্নাবশেষ ও শিব মন্দির :- করনদিঘী থানার দোমোহনার কাছে বাগিন্দর মৌজায় প্রায় ৮০ বিঘা জায়গা জুড়ে রাজবাড়ি নামে একটি গ্রাম রয়েছে। গোটা গ্রামটাই রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের ওপরে অবস্থিত । গ্রামে পূর্ব দিকে আছে রানীদিঘি আর পশ্চিমদিকে আছে গেড়া নদী। রানীদিঘিতে বাঁধানো একটি ঘাটও আছে। এই রানী দিঘি ছাড়াও রাজার আমলে প্রজাদের চাষবাসের সুবিধার জন্য জালালদিঘি ও সুরতাদিঘির মত আরো কিছু দিঘি খনন করা হয়েছিলো। রাজবাড়িটির ভগ্নাবশেষ মাটিতে বিলীন হয়ে গেলেও সেই আমলের দেব মন্দিরটি আজও নিশ্চিহ্ন হয়নি। মন্দিরটি একটি প্রাচীন শিব মন্দির। মন্দিরটি কারুকার্যময় ছোট বড় ইট দিয়ে তৈরী। মন্দিরটি দৈর্ঘ্যে আট ফুট এবং প্রস্থেও আট ফুট।
এই মন্দিরের চূড়ায় একটি পিতলের ঘট স্থাপিত ছিল যেটি এখন আর নেই। মন্দিরটি দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার নেই ফলে দীর্ঘদিনের সংস্কারের অভাবে মন্দিরের ইট গুলোতে নোনা ধরে গেছে এবং মন্দিরের চূড়ার ওপরে একটি অশ্বথ গাছ ও বেড়ে উঠেছে।
৩১. পাঁচভায়া কাছারী বাড়ি :- রায়গঞ্জের ২ নং জগদীশপুর অঞ্চলের অন্তর্গত নাগর নদীর তীরে পাঁচভায়া গ্রাম অবস্থিত। কথিত আছে যে পান্ডবেরা অজ্ঞাত বাসের সময়ে এই পাঁচভায়াতে এসেছিলেন। তখন জঙ্গলে পরিপূর্ণ এই এলাকায় একটি শমীবৃক্ষের নিচে এক রাত্রি অতিবাহিত করেছিলেন।রংপুরের জমিদার গোপাল লাল রায় পাঁচভায়ার ইজারা পান। সেই কারণে তিনি এখানে একটি দোতলা বিশিষ্ট কাছারীবাড়ি নির্মাণ করেন।
জমিদার গোপাললাল রায় পাঁচভায়াতে একজন দক্ষ কর্মচারী নিয়োগ করেন রাজস্ব আদায়ের জন্য। জমিদার গোপাললাল রায় রংপুর থেকে এই কাছারী বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। এখানে এসে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে শিকার করা ছাড়াও নাগর নদীতে নৌকা ভ্রমন উপভোগ করতেন। জমিদারের উদ্যোগে এখানে একটি দুর্গা পূজার ও সূত্রপাত হয়। তার মৃত্যুর পর কাজ পর এই জমিদারি দেখাশোনার দায়িত্ব পান ভৈরবলাল রায়। তার সময়েই এই জমিদারির অবসান ঘটে। এখনো এই কাছারী বাড়িটি টিকে আছে এখানে আসলেই সেটা দেখতে পাবেন। আসতে হলে রায়গঞ্জের নাগর থেকে ভাটোলের রাস্তা দিয়ে যেতে হালালপুর মোড় তারপর বা দিকে গেলেই এই পাঁচভায়া গ্রাম।
৩২. দলুয়ার প্রাচীন মন্দির :- উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার খুব কাছেই ডাউক নদীর তীরে অবস্থিত এই দলুয়া গ্রাম। প্রাচীনকালে এই এলাকা জলা - দলদলা ছিল বলে এই জায়গাটি নাম এসেছে দলুয়া। বৈষ্ণব সাধক পাহাড় সিং দলুয়া মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।
Dalua Temple. |
স্থানীয়রা প্রাচীনকাল থেকেই এই ডাউক নদীকে গঙ্গার সাথে তুলনা করতো এবং দেবী রূপে পূজা ও করা হতো। সেই কারণেই পাহাড় সিং ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরে গঙ্গার পাশাপাশি শিব এবং রাধা কৃষ্ণের মূর্তি ও প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন এই অঞ্চল ঘন গভীর জঙ্গলে আচ্ছাদিত ছিল। প্রতি বছর মাঘি পূর্ণিমার দিন এখানে ধুমধাম সহকারে পূজার আয়োজন করা হয় তখন প্রচুর পূর্ণার্থী এখানে ভিড় করে, ডাউক নদীতে পূর্ন স্থান করে, তারপর পূজা দেয়।
পাহাড় সিং এর মৃত্যুর পর তাকে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী একটি জায়গায় সমাধিস্থ করা হয়। বর্তমানে পাহাড় সিং এর ছেলে যুযান সিং মন্দিরের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার উদ্যোগে ডাউক নদীর বন্যায় যর্নেশ্বর ক্ষতিগ্রস্ত এই মন্দিরের নতুন রূপে নির্মাণ করা হয়, কয়েক বিঘা জমি ও ডান করা হয় মন্দিরের জন্য। চোপড়া বাস স্ট্যান্ডের কিছু আগেই দলুয়া সেখানে নেমে বা দিকে কিছুটা গেলেই ডাউক নদী ও মন্দির দেখতে পাবেন।
৩৩. বন্দরের করুণাময়ী আদি কালি মন্দির :- মোগল আমলে রায়গঞ্জ শহরের কুলিক নদীর তীরবর্তী বন্দর এলাকা একটি বড় বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। এই কুলিক নদী নাগর ও মহানন্দার মাধ্যমে গঙ্গার সাথে যুক্ত ছিল। তখন দূর দূরান্ত থেকে বনিকরা এখানে নৌকা বোঝাই করে মাল নিয়ে এখানে আসতো। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল তার ও অনেক আগে থেকে। সেই সময় ব্যবসায়ী ও বনিকরা তাদের নিরাপদ যাত্রা এবং ব্যাবসায়িক উন্নতিকল্পে এই মন্দিরে এসে মায়ের আশীর্বাদ প্রার্থনা করতো। এই কালী পূজা ছিল রায়গঞ্জের সবচেয়ে প্রাচীন কালি পূজা, সেই কারণেই এর নাম হয়েছে আদি কালিবাড়ি।
Bandar Adi Kali & Adi Durga Temple. |
কথিত আছে বনিকদের সাথে সাথে পাঞ্জাব থেকে এক সাধু এসে এই মন্দিরে থাকতে শুরু করেন তিনি পঞ্চমুন্ডির আসন প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় মগ্ন থাকতেন, তিনি বহু মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। এরপর থেকেই এই মন্দিরের মহাত্ম্য ও ভক্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেহেতু এই এলাকা দিনাজপুরের মহারাজার অধিকারে ছিল তাই দিনাজপুরের মহারাজা প্রায়ই এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন, তাদের প্রচেষ্টায় এই মন্দিরের সংস্কার সাধন হয়।
মন্দিরের স্থানটি যথেষ্ট উচু জায়গায় অবস্থিত। ভেতরে একটি প্রাচীন বটবৃক্ষ রয়েছে। বর্তমানে মন্দিরে মায়ের যে মূর্তিটি দেখতে পাই, এটি একটি দক্ষিণা কালির মূর্তি এর প্রতিষ্ঠাকাল, ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে, বেনারস থেকে এই মূর্তিটিকে তৈরি করে নিয়ে আসা হয়েছিল, তার আগেই মায়ের বেদীটিরই পুজো করা হতো। এই মন্দিরের দেবী বহু ভক্তদের প্রার্থনা পূরণ করেন তাই এই কালী মা করুণাময়ী কালি নামে পরিচিত।
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে এই মন্দিরের বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয়। তখন বহু ভক্তের সমাগম হয়। বন্দর এলাকায় এই আদি কালি বাড়ি ছাড়াও আদি শিব মন্দির এবং আদি দুর্গা মন্দির অবস্থিত। যেগুলোও খুবই প্রাচীন।
৩৪. রামগঞ্জ জমিদারবাড়ি :- ইসলামপুর থেকে কয়েক কি.মি এগিয়ে ৩১ নং জাতীয় সড়কের একদম পাশেই অবস্থিত রামগঞ্জ জমিদারবাড়ি। এই পুরো এলাকা আগে বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে উত্তর প্রদেশের বলিয়া জেলা থেকে রামগঞ্জে এসে বসতি স্থাপন করে ভগৎ পরিবার। এই ভগৎ পরিবারের রামরঞ্জন ভগতের হাত ধরেই রামগঞ্জ জমিদারির সূচনা হয়। তার নাম থেকেই জায়গাটির নামও হয়ে যায় রামগঞ্জ।
পূর্নিয়ার রাজা পি সি লাল ও খাগড়ার নবাবের কাছ থেকে তিনি জমিদারি লাভ করেন। তার প্রায় কয়েক হাজার বিঘা জমি ছিলো। সেই টাকায় তিনি রামগঞ্জে ২ বিঘা জায়গা জুড়ে ত্রিতল বাড়ি নির্মাণ করেন। সেই বাড়ির কিছু অংশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে।জমিদার রামরঞ্জন ভগতের উদ্যোগেই রামগঞ্জ হাটের সূচনা হয়। লোকে তাকে ভগৎ জি বলে ডাকতেন।
৩৫. উদগ্রামের প্রাচীন দুর্গাপূজা, রাধিকাপুর :- উদগ্রামের ইতিহাস বলতে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো দুর্গাপূজার কথা বলা যায়। অবিভক্ত দিনাজপুর তথা বাংলার প্রাচীন পুজো গুলোর মধ্যে একটি। দেবী দুর্গাকে এখানে চণ্ডী রূপে পূজা করা হয়, গ্রামের একদম মাঝ বরাবর টিন-দালানের চণ্ডীমণ্ডপ টি অবস্থিত যা বর্তমানে পাকা দালানে রূপান্তরিত করা হয়েছে। দিনাজপুরের মহারাজারা তার পুজোর জন্য জমি দান করেছিলেন। গ্রামের নিঃসন্তান পিতামাতারাও তার পুজোর জন্য জমি দিয়েছিলেন। তাই এখনো এই দুর্গাপূজার নামে বারো বিঘে জমি আছে, কিন্তু দেশ ভাগের ফলে বেশিরভাগ জমি বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে যায়, কিন্তু এখনো 5,6 বিঘা জমি এপারে আছে, এই জমির ফসলের টাকা থেকেই মন্দিরের খরচ ও মায়ের পূজা চলে, দুর্গাপূজার জন্য আলাদা ভাবে কোন চাঁদা তোলা হয়না।
উদগ্রাম রাধিকাপুর । |
- আরো পড়ুন - উদগ্রামের ইতিহাস
পূর্বে দিনাজপুরের জমিদার বাড়ির কামানের গোলার আওয়াজ শুনে এখানে অষ্টমীর পুজো শুরু হতো, দিনাজপুরের জমিদারবাড়ির নিয়ম ও সূচি মেনেই এখানে পুজো হতো, তাই উদগ্রামের অষ্টমীর দুর্গাপূজার মহাত্ম খুব বেশি স্থানীয় লোকেদের কাছে, যার ফলে অষ্টমীতে এখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়,উত্তর দিনাজপুর জেলা ছাড়াও পাশের জেলা থেকে ও মানুষ এখানে আসে। উদগ্রামের মানুষদের তাদের মা চন্ডীর ওপরে আগাধ বিশ্বাস তাই গ্রামে কোনো বিয়ে বা কোনো শুভ কাজ হলেই তা দেবী চণ্ডীকে সাক্ষী রেখেই করা হয়, ছাদনাতলা তৈরী হয় মন্দির চত্বরের মধ্যেই। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস চন্ডীর সামনে বিয়ে হলে সংসার সুখের হয় এবং অটুট থাকে দাম্পত্য জীবন।
৩৬. সোনাপুর গ্রাম, ইটাহার :- ইটাহারের বোনবোল হাইস্কুল সংলগ্ন সোনাপুর গ্রাম। পুরো গ্রাম জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন। যার মধ্যে আছে কষ্টিপাথরের কিছু বিষ্ণুমূর্তি এছাড়াও আরো অন্য প্রাচীন পাথরের কিছু মূর্তি, মূর্তির ভাঙা টুকরো, কোনো কাঠামোর অংশ, পিলার এসব। তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গণেশের দুটি এবং বুদ্ধদেবের একটি মূর্তি। গ্রামেরই আশে পাশ থেকে প্রাপ্ত এই সব মূর্তি গুলো গ্রামেরই ২,৩টে মন্দিরে রাখা আছে। তার মধ্যে দুটি মন্দিরে আমরা গিয়েছিলাম। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্রাচীনকালে এই গ্রামটি ঐতিহাসিক দিক সমৃদ্ধ এলাকা ছিল, এমনিতেই গোটা ইটাহার ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই গুরুত্ব সম্পন্ন। পাল ও সেন যুগের বহু নিদর্শন ইটাহার বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার হয়েছে,কিন্তু এই সোনাপুর গ্রামে মত একটি জায়গায় এত সংখ্যক নিদর্শন আর কোথাও হয়তো দেখতে পাবেন না। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ একদমই নেই, কিছু কিছু নিদর্শন চুরিও হয়ে গিয়েছে।
ইটাহারের দুর্লভপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পাশে অবস্থিত সোনাপুর গ্রাম, দুর্গাপুরের ভেন্ডাবাড়ি মোড় থেকে মাত্র ৪ কি.মি। বানবোলের দিক থেকেও আসা যায় তবে ভেন্ডাবাড়ি মোড় থেকে কাছে।
ধন্যবাদ সকলকে। আসাকরি ব্লগটি আপনাদের ভালই লেগেছে। 🙏 🙏 🙏
ভ্রমণ পিপাসু।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন