-: মা গুহ্যকালী :-
ভ্রমণ পিপাসু :- সমগ্র বিশ্বে এই কালী মাত্র একটিই আছে। প্রায় কয়েক হাজার বছরের পুরোনো রহস্যময় ঐতিহাসিক বীরভূমের অকালীপুরের গুহ্যকালী মাতা। ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস কষ্ঠি পাথরের এই বিগ্রহকে লন্ডনে পাচার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি। এই মূর্তি প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে আছে রাজা নন্দকুমারের নাম। তিনি নিজ হাতে ব্রাহ্মনী নদীর তীরে অকালীপুর গ্রামে মা কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রাজা নন্দকুমারের নাম হয়তো অনেকেই শুনছেন, তিনিই হলেন প্রথম ভারতীয় ব্যক্তি যার বিচারে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফাঁসি হয়েছিলো, যদিও এর পেছনে ওয়ারেন হেস্টিংসের চক্রান্ত।
মা গুহ্যকালীর রূপ একদমই অদ্ভুত। মা গুহ্যকালী এখানে বসে আছে সাপ বা নাগের ওপর, সমগ্র বিশ্বে মা কালির এরকম রূপ আপনারা আর কোথাও দেখতে পাবেন না। এছাড়াও মায়ের মুকুটে দেখতে পাবেন এক হাজার সাপের ফনা এবং মায়ের সর্ব অঙ্গেই আছে সাপ। এই গুহ্যকালী মন্দিরের আসে পাশে কোনো ভৈরব ও শিবের মন্দির আপনারা দেখতে পাবেন না।
ইতিহাস :- মা গুহ্যকালীর এখানে প্রতিষ্ঠা হওয়ার পেছনে আছে এক বিরাট ইতিহাস। মায়ের এই বিগ্রহটি কয়েক হাজার বছরের পুরোনো এবং মগধ রাজ জরাসন্ধের সময়কার বলে মনে করা হয়। ইন্দোরের রানী অহল্যাবাঈ হোলকার সর্বপ্রথম এই বিগ্রহটিকে খুঁজে পান, যা তিনি কাশির রাজা চৈত সিং এর হাতে তুলে দেন। রাজা চৈত সিং দূর্লভ এই মূর্তিটিকে প্রতিষ্ঠা করে পূজা অর্চনা শুরু করেন। কিন্তু সেই সময়ে গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংসের কাছে খবর চলে যায় যে, রাজা চৈত সিং এর কাছে এর দুর্লভ কষ্টি পাথরের মূর্তি আছে যার দাম কয়েক লক্ষ টাকা।এই কথা শোনা মাত্র হেস্টিংস পরিকল্পনা শুরু করে দেন এই মূর্তিটিকে চুরি করে লন্ডনে পাচার করে দিতে। কিন্তু রাজা চৈত সিং হেস্টিংসের এই পরিকল্পনা কোনো ভাবে জেনে যান, এবং ভাবতে থাকেন কি ভাবে মায়ের এই বিগ্রহটিকে বিদেশে পাচার হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা যায়। সেই সূত্রেই তিনি কোন এক নির্জন জায়গায় গঙ্গা বক্ষে মায়ের বিগ্রহটিকে লুকিয়ে রাখেন।
এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় অংশ। সেই সময় নদিয়া বর্ধমান ও হুগলির দেওয়ান রাজা নন্দকুমার এক স্বপ্নাদেশ পান। তিনি ছিলেন মা কালির বড় ভক্ত ও সাধক উপাসক।স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরেই দিনই তিনি কাশি রাজের কাছে ছুটে যান এবং সমস্ত কিছু খুলে বলেন। কাশি রাজ তার কথায় আশ্বস্ত হন এবং মায়ের মূর্তি কে নিয়ে নৌকাযোগে নিজ গ্রাম ভদ্রপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন, কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ভদ্রপুর পর্যন্ত পৌঁছোতে পারেনি নৌকা ব্রাহ্মনী নদী হয়ে যাওয়ার পথে আকালীপুর গ্রামের কাছে এসে থেমে যায়, আর সামনে অগ্রসর হচ্ছিল না, তাই তিনি এই গ্রামেই ব্রাহ্মনী নদীর তীরে একটি বেদীর ওপর মাকে প্রতিষ্ঠা করেন, পরবর্তীকালে তিনি মন্দির ও নির্মাণ করে দেন যা আজকে আমরা দেখতে পাই। মায়ের মন্দির থেকে কিছু দূরেই এই প্রাচীন বেদীটি এখনো আছে। এই গুহ্যকালী মন্দিরের সাথে সাথে রাজা নন্দকুমারের নামও অমর হয়ে আছে। যার আদি বাসভূমি ছিল আকালীপুর পার্শ্ববর্তী গ্রাম ভদ্রপুরে।
মা গুহ্যকালীর মন্দির ও মূর্তির সাথে রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে অনেক অলৌকিক কাহিনী ও ঘটনা। সেরকমই একটি ঘটনা ঘটে, মায়ের মূর্তিটিকে বেদী থেকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠার দিন ১০৮ খানা বলি দেওয়া হয়েছিল বলে শোনা যায়, সবশেষে দেওয়া হয়েছিলো একটা নরবলী। মায়ের মন্দিরে প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে গ্রামে এক বিরাট মেলা বসে, সেই মেলা থেকেই একটি বাচ্চাকে ধরে এনে এখানে বলি দেওয়া হয়, কিন্তু বাচ্চাটির মা এর কাতর আবেদনে অলৌকিক ভাবে বাচ্চা ছেলেটি আবার জীবিত অবস্থায় ফিরে আসে, তার পর থেকেই গ্রামের লোকেদের একদম বিশ্বাস হয় যে এই মা খুব জাগ্রত, এবং মা কাছে ভক্তিভরে যা কিছুই চাওয়া যায় না তা পূরণ করে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত খুবই নিষ্ঠার সাথে মায়ের পুজো চলে আসছে। যে অদ্ভূত অসাধারণ অনন্য এই বিগ্রহটি আরো একটু কিছু হলেই স্থান পেতো লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ বিগ্রহটি আমাদের রাজ্যের একটি ছোট্ট গ্রামে বিরাজমান তা সত্ত্বেও আমরা বাঙালিরা তার কোনো খোঁজই রাখিনা।
কেমন করে যাবেন :- এবার আসি আপনার কেমন করে এই আকালীপুর গ্রামে এসে পৌঁছোবেন। আপনারা যদি কলকাতার দিক থেকে আসতে চান তাহলে আপনাদের নামতে হবে নলহাটি স্টেশন বা বাস স্ট্যান্ডে। তারপর বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ধরে আকালীপুর গ্রাম এবং তারপর একটি টোটো ভাড়া করে চলে আসুন এই মন্দিরে। ট্রেনে আসতে চাইলে নলহাটি থেকে আজিমগঞ্জ লাইনের ট্রেন ধরে নামতে হবে লোহাপুর স্টেশনে, এরপর স্টেশন থেকে টোটো ভাড়া করে আসতে হবে এই গ্রামে।আর যারা নর্থ বেঙ্গলের দিক থেকে আসবেন তারা NH 34 ধরে নেমে পড়ুন মোড়গ্রামে তারপর কোনো ছোট গাড়ি, বাস বা টোটো রিজার্ভ করে চলে আসুন এই গ্রামে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন