ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের ব্যাপারে সম্পুর্ন তথ্য। world Longest Trans - Trans Siberian railway. Everything you Need To know.

 ভ্রমণ পিপাসু :- প্রায় ১০০০০ কি.মি বিস্তৃত পৃথিবীর দীর্ঘতম ট্রেন লাইন এই ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে। যা বিস্তৃত হয়েছে রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া এবং চিনের মধ্যে দিয়ে এবং এই রেলপথ সংযুক্ত করেছে এশিয়ার সাথে ইউরোপের। প্রায় ১০০ বছরের পুরনো এই রেলপথ আজও অবিরাম গতিতে ছুটে চলেছে পৃথিবীর হাজারো বৈচিত্র্যকে গায়ে মাখিয়ে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। এই ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের পুরো যাত্রাপথে প্রান্তে প্রান্তে যাত্রীদের অনুভব হবে পৃথিবীর অনাবিল সবরূপ, এই রূপ দেখার পর যে কোনো মানুষেরই মনে হবে এ যেনো পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ।

Trans Siberian Railway 

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ সম্পর্কে এমন কথা বলা হয় যে, আপনি যদি একবার এই রেলপথে যাত্রা করেছেন তাহলে আপনার পৃথিবীর সমস্ত রুপ রং দেখা হয়ে যাবে। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত রূপ আপনারা এই যাত্রায় অনুভব করতে পারবেন, তা হবেই কেনো দুটি মহাদেশ তিনটি দেশ, দুর্গম পার্বত্য এলাকা, সাদা বরফে ঢাকা সাইবেরিয়ার এলাকা, প্রচুর নদী, হ্রদ এতকিছু পিছনে ফেলে এই রেললাইন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে চলছে, এ যাত্রা যেনো সত্যি এক বৈচিত্র্যের লীলাভূমী, তাই যাবেন নাকি এই যাত্রায় একবারের জন্য? যদি না যেতে চান তবেও জেনে রাখতে পারেন পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্গমতম এবং দীর্ঘ লাইন সম্পর্কে, জানা থাকলে ক্ষতি তো নেই, ব্লগটি পড়া থাকেন অনেক অজানা জিনিস, ফ্যাক্ট আপনারা জানতে পারবেন, আর যদি যাওয়ার ইচ্ছা কোনোদিন অল্প হলেও থেকে থাকে তাহলে তো অবশ্যই কাজে লাগবে এই ব্লগটি, চলুন তাহলে শুরু করা যাক.....


ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের ইতিহাস :- ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলওয়ে পুরোপুরি সোভিয়েত রাশিয়ার মালিকানাধীন যা রাশিয়ার জার শাসনাকালে জার নিকোলাসের আমলে ১৮৯১ সালে এই দীর্ঘ রেলপথের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তীকালে জার শাসনের অবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পরাশক্তি হয়ে ওঠার পেছনে ও এই রেলপথের অনেক বড় হাত আছে।

পৃথিবীতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার পর ধীরে ধীরে পৃথিবীতে সবকিছুর সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে। এই ক্ষেত্রে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে ব্রিটিশরা তাদের হাত দিয়েই ব্রিটেনে সর্বপ্রথম রেলপথ, স্থাপিত হয়ে, গ্রেট ব্রিটেনের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ইউরোপের অন্য অন্য দেশের মত রাশিয়াও পৃথিবীর ষষ্ঠ দেশ হিসেবে ১৮৩৬ সালে জার প্রথম নিকোলাসের আমলে রেললাইন স্থাপিত হয়, যার দৈর্ঘ্য ছিল খুবই কম।

Vladivostok City. 

কিন্তু রাশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ অঞ্চল সাইবেরিয়ার সাথে দেশের রাজধানীর সাথে সেরকম কোনো উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। রাশিয়ার মোট আয়তনের প্রায় ৬০% এই সাইবেরিয়া যা খুবই দূর্গম অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, বছরের বেশিরভাগ সময়ে এই অঞ্চলে বরফের সাদা চাদরে ঢেকে থাকার পাশাপাশি তাপমাত্রা প্রায় সবসময় থাকে মাইনাসে, আর শীতকালে তো সেটা মাইনাস ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত চলে যায়, সেইজন্য এই এলাকা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে জনবিরল এলাকার মধ্যে পড়ছে। এত প্রতিকূল পরিবেশের জন্য এখানে জীবনধারন করা খুবই কস্টকর ব্যাপার। স্বাভাবিক জীবন যাত্রা এবং জীবনধারনের জন্য এই জায়গা উপযুক্ত না হলেও, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক, প্রতিরক্ষার দিক থেকে এই জায়গা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে জার শাসনের আমলেই বিরাট পরিকল্পনার বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাশিয়ার পূর্ব প্রান্ত, এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলীয় এলাকা দেশের রাজধানী মস্কোর সাথে হবে। এই এলাকা চীন এবং আমেরিকার খুবই নিকটবর্তী এই সব মিলিত কারণের ফলশ্রুতি হিসেবে রাজধানী শহর মস্কো থেকে পূর্ব সাইবেরিয়ান সবচেয়ে শহর ভ্লাডিভোস্তক পর্যন্ত এই পাতার কাজ শুরু হয় ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে, তিনটি ধাপে এই প্রজেক্টের কাজ শেষ হতে প্রায় ১৩ বছর সময় লেগে যায়। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে জুন মাসে এই বিশাল প্রজেক্টের অনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়। এই প্রজেক্টের পর রাশিয়ার কৃষি থেকে শুরু কর, ব্যবসা বাণিজ্য, এবং বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই রেলপথ যথেষ্ঠ সাহায্য করছিলো মিত্রপক্ষকে।

Moskow Station. 

ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ :- তিনটি ধাপে এই রেলপথের নির্মাণ কাজ শেষ। ১৮৯৯ সালে শেষ হয় প্রথম দফা যা ভ্লাডিভোস্তক থেকে ইরকুটস্ পর্যন্ত। দ্বিতীয় ধাপ যা মাইসোবা থেকে পূর্ব ধার বরাবর শিরকা নদী ব্রিজ পর্যন্ত এই রেলপথ নির্মাণ করতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছিল, এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক থেকে শুরু করে সকলকেই। তৃতীয় ধাপ ছিল অনেকটা সহজ এবং অনেকটাই সমতল এলাকার মধ্য দিয়ে। এই পুরো রেলপথ নির্মাণে প্রকৃতির রেষানল এবং নিষ্ঠুরতা খুব ভালো ভাবেই অনুভূত হয়েছিল।

Route Map. 

এই ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথ রুটে পরিচালিত হয়। প্রধান রুট টি হলো রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকে পূর্ব সাইবেরিয়ান শহর ভ্লাডিভোস্তক পর্যন্ত যার দূরত্ব ৯২৮৯ মিটার। এই রুট বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় রুটটি মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর হয়ে যা এই লাইনের মধ্যে দীর্ঘতম রুট। তৃতীয় রুটটি চীনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে রাজধানী বেজিং পর্যন্ত। এই পুরো রেলপথের যাত্রাতে আপনারা পাবেন প্রায় দুই মহাদেশের ৮৭টি বড় শহর, অজস্র স্টেশন, ভল্গা আমুরের মত বড় বড় ১৬ টি নদী, বিরাট বৈকাল হ্রদ, এবং তটভূমি, পাহাড়, বড় বড় সবুজ মাঠ ও চারনভূমি প্রভৃতি। এই পুরো যাত্রা পথ অতিক্রম করতে একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের প্রায় ৭ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। যা মুলত পর্যটকদের চালিত হয়ে আসছে। ডাবল লাইন বিশিষ্ট এই লাইন দিয়ে এখন মালগাড়িও বেশী মাত্রায় চলাচল করছে।

এই লাইনে যাত্রা করার কয়েকটি প্রধান কারণ :- পৃথিবীতে যতগুলো ট্রেন লাইন আছে তার মধ্যে এই লাইন সবচেয়ে বিখ্যাত ও জনপ্রিয়। এই লাইনে একবার জন্য জার্নি করার জন্য দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকেরা মুখিয়ে থাকে, কারণ এই রেলপথ এক তো আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারের এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। তার পাশাপাশি এই ট্রেনযাত্রা পর্যটকদের সারাজীবনের সম্বল হয়ে থেকে যায়। তাই আপনি যদি ট্রেন যাত্রা করতে খুবই আগ্রহী থাকেন আর আপনার ইচ্ছে থাকে পৃথিবীর এই দীর্ঘতম ট্রেন যাত্রার আনন্দ উপভোগ করার, তাহলে আপনাকে অবশ্যই জেনে রাখা প্রয়োজন, কেন আপনি জীবনে একবার হলেও এই ট্রেন যাত্রা করবেন তার কয়েকটি কারন -

এক - এই যাত্রা আপনাকে অসাধারণ সব অভিজ্ঞতা দেবে, আপনি গোটা বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পেয়ে যাবেন এই রেলপথে ৭ দিনের ভ্রমনে। পাহাড়, সমুদ্র, বড় বড় নদী থেকে শুরু করে, সবুজের শোভায় আবৃত তৃণভূমি, ছোটো ছোটো গ্রাম থেকে শুরু করে বড় বড় শহর সমস্ত কিছু।

দুই - এই ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেল যাত্রায় আপনি রাশিয়া, মঙ্গোলিয়ার পাশাপাশি চীনের প্রবেশ করে ঘুরে আসতে পারবেন।

তিন - এর পাশাপাশি এই যাত্রায় আপনি দেখে ফেলতে পারবেন নীল রঙের জলের বৈকাল লেক, যা পৃথিবীর গভীরতম লেক,এই বৈকাল লেকের পাশ দিয়ে কয়েকশো কি.মি এর মনমুগ্ধকর ট্রেন যাত্রা এটাও একটা লাইফ টাইম এক্সপিরিয়েন্স।

চার - এছাড়াও এই যাত্রায় আপনি বিভিন্ন ধরণের সাইবেরিয়ান, মঙ্গোলিয়ান এবং চীনা মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারবেন খুব কাছ থেকে তাদের ভাষা থেকে শুরু করে কালচারকে অনুধাবন করতে পারবেন।

পাঁচ - যেকোনো ধরণের ট্রাভেলার হোন না কেনো, সমস্ত ধরণের অর্থাৎ লাক্সারিয়াস থেকে শুরু করে, মিডিয়াম এবং বাজেট ট্যুরিস্ট সবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে এই ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলপথের ।

ছয় - ইতিহাস কে অনেক সামনে থেকে অনুধাবন করার সুযোগ থাকবে আপনাদের।

সাত- এই পুরো যাত্রাপথে আপনাকে ১০ টি আলাদা আলাদা টাইম জোনের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, যেটাও কিন্তু একদমই আলাদা অভিজ্ঞতা।


ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেলযাত্রার খরচা :- ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেললাইন হলো এমন একটা লাইন যেখানে সব ধরণের যাত্রীদের জন্য যাওয়ার সুবিধা আছে। ট্রান্স সাইবেরিয়ান লাইনে প্রধানত দুটি রুট আছে। একটি রুট হল সরাসরি রাশিয়ার মধ্যে দিয়ে মস্কো থেকে ভ্লাডিভোস্তক পর্যন্ত, এই রুট ট্রাভেল খরচা অনেকটা কম পড়বে। দ্বিতীয় যে রুটটা যেটা ট্রান্স মঙ্গোলিয়ান এবং ট্রান্স মান্চুরিয়ান রেলপথের মাধ্যমে মঙ্গোলিয়া এবং চিনের ভেতর দিয়ে যাত্রা। এই রুটে আপনার খরচা আরো কিছুটা বেড়ে যাবে এবং মঙ্গোলিয়া এবং চিনের ভিসাও প্রয়োজন হবে।

আমি 2nd ক্লাস এবং 3rd ক্লাসের ভাড়া টা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। আপনি যদি সরাসরি রুটে মস্কো থেকে ভ্লাডিভোস্তক পর্যন্ত গেলে 2nd ক্লাস জন্য ভাড়া লাগবে প্রতিজন প্রায় ৩০০ ইউরো ( ২৬৩০০) টাকা। এবং 3rd ক্লাসের ভাড়া - ১৫০ ইউরো।

এবার আপনি যদি দ্বিতীয় রুট হয়ে যেতে চান তাহলে আপনাদের খরচা প্রায় পড়ে যাবে ৪৫০ - ৬০০ ইউরোর মধ্যে আর 3rd ক্লাসের জন্য এর অর্ধেক ভাড়া। এই ভাড়া ননস্টপ যাত্রার ভাড়া এবং এতে আপনাদের সময় লাগবে প্রায় ৬ - ৭ দিন। আপনি Stoppage দিয়ে স্টে করেও এই যাত্রা করতে পারেন। ট্রেন টিকিটের জন্য বিভিন্ন আপনি অনলাইন সাইট বা ট্রাভেল এজেন্টের সাথে Contact করতে পারেন এছাড়াও রাশিয়ার যেকোনো স্টেশন থেকেও সরাসরি টিকিট কেটে নিতে পারেন।


এখন প্রশ্ন আসতে পারে আপনি কখন এই যাত্রা করবেন, এই ট্রেন যাত্রা উপভোগ করার জন্য আপনি সারাবছরই যেতে পারেন বছরের বিভিন্ন সময়ে আপনি ভিন্ন রূপ দেখতে পাবেন, এছাড়াও স্থানের বদলে প্রকৃতির গঠন ও রূপের বদল ঘটবে দেখতে পাবেন, এতো বিভিন্নতা আপনি আর কোথাও একসাথে পাবেন বলে মনে হয়না।তবে আগস্ট থেকে অক্টোবর এই সময় টা বেস্ট টাইম। একটা দারুণ Experience হবে আপনার এই ৬ দিনের যাত্রাতে। যা আপনাদের চির জীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে।

লেখায় ✒️ বিশ্বজ্যোতি ভৌমিক। 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন