উত্তর দিনাজপুর জেলার ১০টি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল
ভ্রমণ পিপাসু :- আমি আগের ব্লগে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ১০ টি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। তাই আমি এই ব্লগে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পাশাপাশি আমার নিজের জেলা উত্তর দিনাজপুর জেলার সেরা ১০টি জায়গা নিয়ে আলোচনা করবো। দেশভাগের আগে কিন্তু পুরো দিনাজপুর জেলা একটিই জেলা ছিল, দেশভাগের জন্য এই দিনাজপুর জেলাকে দুই দেশের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। ভারতের অংশে থাকা পশ্চিম দিনাজপুর জেলাকে আবার ১৯৯২ সালের ১লা এপ্রিল দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সদর শহর বালুরঘাটই থেকে যায় এবং নতুন সৃষ্টি হওয়া উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর শহর করা হয় রায়গঞ্জকে।
দিনাজপুর নামের উৎপত্তি হয়েছে ভাতুরিয়ার রাজা গণেশের এক উপাধি 'দনুজমর্দনদেব' থেকে এই দনুজ থেকেই দিনাজপুর কথাটি এসেছে বলা মনে করা হয়। এই রাজা গণেশ ছিলেন সুলতানী আমলের একমাত্র হিন্দু রাজা। তার ঢিপী কিন্তু এই জেলার হেমতাবাদ ব্লকের ভাতুরা গ্রামে আছে। এই উত্তর দিনাজপুর জেলার রাজ্য,দেশ তথা বিশ্বে প্রসিদ্ধ তিনটে জিনিসের জন্য এক কুলিক পক্ষীনিবাস যা পাখির সংখ্যার বিচারে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পক্ষীনিবাস, দুই রায়গঞ্জের মোহিনীগঞ্জের তুলাইপাঞ্জি চাল, যে চাল বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে শুরু করে অলিম্পিক গেমসের মত বড় আসরে গিয়েও তার নাম এবং জেলার নাম উজ্জ্বল করেছে, আর তিন বিঘোরের বেগুন যে বেগুনের স্বাদ এবং আকার অতূলনীয়। শীতকালে আপনি যদি এই জেলায় আসেন তাহলে ভ্রমনের সাথে সাথে এই তিনটে জিনিসের সংমিশ্রণে একদম জমে যাবে। এর বাইরেও এই জেলায় লুকিয়ে থাকা এরকম অনেক জায়গা আছে যেগুলো সমন্ধে আমাদের জেলার মানুষেরাই অবগত নই। এই জেলার ইতিহাস ও গৌরব নিয়ে ঘাটাঘাটি এবং লেখালেখি অনেক কম হয়েছে এটাও একটা বড় কারণ তার পাশাপাশি জেলার মানুষের কিছুটা অবচেতনতাও কিছুটা দায়ী। এই ব্লগে আমি উত্তর দিনাজপুর জেলার সবার পরিচিত জায়গাগুলো বাদেও কিছু অজানা জায়গা যে তুলে ধরবো, তার সাথে সাথে সেই সমস্ত জায়গা গুলো কোথায় আছে তার ইতিহাস কি, কেন গুরুত্বপূর্ণ আপনি কেমন করে পৌঁছোবেন, সমস্ত তথ্য থাকবে। এরকম কমপ্লিট ব্লগ এই জেলা নিয়ে কিন্তু আগে কেউ লেখেনি এটা হলফ করে বলতে পারি।
১.কুলিক পক্ষীনিবাস :- রায়গঞ্জ শহর থেকে মাত্র ২ কি.মি দূরে অবস্থিত এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পক্ষীনিবাস কুলিক পক্ষীনিবাস(Raiganj Wildlife Santuary)। যা অবস্থিত কুলিক নদীর তীরে। কুলিক এই জেলার ছোট্ট একটি নদী যার উৎপত্তি বাংলাদেশ থেকে।
এই কুলিক পাখিরালয়ে আবাসস্থল সাইবেরিয়া তথা ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পরিযায়ী পাখিদের। এক কথায় স্বর্গরাজ্যও বলতে পারেন। প্রতি বছর প্রায় ১৬০ ধরণের পরিযায়ী পাখি কয়েক হাজার কি.মি পথ অতিক্রম করে এই কুলিকে কয়েক মাসের জন্য তাদের ঘর স্থাপন করে। এত ধরণের পাখি এখানে এসে থাকলেও আধিক্য দেখা যায় মাত্র কয়েকটি পাখিরই, ওপেন বিল স্টর্ক বা শামুকখোল , নাইট হেরন, করমরেন্টস্ প্রভৃতি পাখির। কয়েকটি এই পক্ষীনিবাসের স্থানীয় কিছু পাখিও আপনারা দেখতে পাবেন। ওপেন বিল স্টর্ক বা শামুকখোল পাখির সবচেয়ে বেশি মাত্রায় আপনি এখানে দেখতে পাবেন। এত সংখ্যক পাখি, পাখিদের এতো ঘনত্ব, আপনি আর অন্য কোনো জায়গায় পাবেন না এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।
এখন প্রতি বছর প্রায় ১ লাখের ওপরে পাখি এই পক্ষীনিবাসে এসে থাকে, এই জন্য ১৯৭০ সাল থেকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই অঞ্চলটিকে স্যাঞ্চুয়ারি হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। ১৯৮৫ সালে এটিকে রায়গঞ্জ ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঞ্চুয়ারির মর্যাদা দেওয়া হয়। রায়গঞ্জ শহর থেকে আপনি খুব সহজে ছোটো গাড়ি, বাস বা টোটো ভাড়া করে এখানে চলে আসতে পারেন।
২. বাহিন জমিদারবাড়ি :- রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরে বাহিন গ্রাম। এই বাহিন গ্রামেরই নাগর নদীর একদম পারে গড়ে উঠছিল প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো বাহিন রাজবাড়ি, যেটি মুলত একটি জমিদারবাড়ি। নদীর উল্টো দিকেই আছে বিহার রাজ্য, বিহারের কাটিহারের বারসই ব্লক। দুই রাজ্যের মাঝে এই জমিদার বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিলো। তৈরি করেছিলেন জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী।
- আরো পড়ুন - বাহিন জমিদার বাড়ির সম্পূর্ন ইতিহাস
বাহিন জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠাতা জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন উত্তর দিনাজপুর জেলার চূড়ামন জমিদারবাড়ির জমিদার মহেন্দ্রপ্রসাদ রায় চৌধুরীর দত্তকপুত্র। পারিবারিক বিবাদের ফলে তিনি বাহিন চলে আসেন। তিনি অনেক ভেবে চিন্তেই এই জায়গাটিকে নির্বাচন করেছিলেন। জমিদার সত্যনারায়ন রায়চৌধুরীর সময়ে এই জমিদারির অবসান ঘটে। তারপর থেকে বসবাসের অভাবে এই জমিদারবাড়ি অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। বর্তমানে এই জমিদার বাড়ির অবস্থা খুবই সঙ্গিন বেশ কিছুদিন এই জমিদার বাড়ি ভারত সেবাশ্রমের দেখাশোনাতে ছিল, কিন্তু জরাজির্ণ এই বাড়ির সংস্কার সেভাবে না হওয়ায় দিনে দিনে অবস্থা আরো খারাপ হয়ে আসছে। বেশ কিছুদিন হলো এই জমিদারবাড়িকে হেরিটেজ কমিশন থেকে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, এখন শুধুই সংস্কারের অপেক্ষা। সংস্কার হলে যেমন ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পন্ন এই বাড়ি ধংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে তেমনি পর্যটনের খুবই বিকাশ ঘটবে। বর্তমানে এই বাড়িটিকে একটি পুলিশ ফাঁড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
রায়গঞ্জ শহর থেকে মাত্র ১৫ কি.মি দূরে এই বাহিন গ্রাম ।রায়গঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে আপনি ছোটো গাড়ি অটো এবং টোটো ও পেয়ে যাবেন এই জমিদারবাড়িতে বা বলতে গেলে বাহিনে আসার জন্য। আপনি চাইলে একটি টোটো রিজার্ভও করে নিতে পারেন আর বাইক থাকলে তো কোনো ব্যাপারই নেই।
৩. কানকি বাবা রামদেব মন্দির :- উত্তর দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহত্তম মন্দির গুলোর মধ্যে একটি এই কানকির রামদেব বাবা মন্দির। রামদেব বাবা পশ্চিমী রাজস্থানের এক লোকদেবতা। তার মন্দির রাজস্থান, গুজরাট এই সমস্ত এলাকায় থাকলেও আমাদের এদিকে অর্থাৎ পূর্ব ভারতের দিকে খুবই কম আছে। শুনেছি কলকাতায় একটা মন্দির আছে। আর একটি এই কানকির মন্দির। কানকি উত্তর দিনাজপুর জেলার ৩১ নং জাতীয় সড়কের পার্শ্ববর্তী চাকুলিয়া ব্লকের অন্তর্গত বর্ধিঞ্চু একটি পঞ্চায়েত। জাতীয় সড়কের একদম পাশেই অবস্থিত এই মন্দির। একে কানকি ধাম হিসেবেও ডাকা হয়।
লোকগাথা অনুসারে বাবা রামদেবের জন্ম পশ্চিম রাজস্থানের একটি ছোটো রাজ্যের কাশমের গ্রামে রাজা আজমাল এবং রানী নৈনাদেবীর ঘরে। প্রথমে রাজা আজমালের কোনো সন্তান ছিল না, তারপর তারা দ্বারকা মন্দিরে গিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে তাদের ঘরে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিলো সেইজন্য তাকে শ্রী কৃষ্ণ অবতার হিসেবেও ডাকা হয়। তাকে নিয়ে অনেক লোকগাথা, কল্পকথা প্রচলিত আছে। বাবা রামদেব ট্রাস্ট এবং তার ভক্তদের অর্থে এই বিশাল মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিলো। মন্দির প্রাঙ্গণের মধ্যে মূল মন্দিরটি ছাড়াও আরও কিছু মন্দির থাকার জন্য রুম , প্রাসাদের ব্যবস্থা আরও অনেক কিছু আছে। মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলে আপনাদের স্বর্ণ মন্দিরের মত অনুভব হবে। অনেকটা সময় এখানে কাটাতে পারবেন।
- আরো পড়ুন - উত্তরবঙ্গের সেরা ১০ টি অসাধারণ মন্দির ।
কেমন করে যাবেন : - আপনি যদি ট্রেনে আসতে চান তাহলে শিলিগুড়ি কলকাতা রুটের যেকোনো ট্রেন ধরে আপনাকে নামতে হবে বিহারের কিশানগঞ্জ স্টেশন বা ডালখোলা স্টেশনে। কিশানগঞ্জ বা ডালখোলা থেকে গাড়ি বা অটো পেয়ে যাবেন এখানে আসার জন্য। কিশানগঞ্জ স্টেশন থেকে মাত্র ১৫ কি.মি দূরে কানকি। কানকিতে ও একটি স্টেশন আছে কিন্তু সব ট্রেন দাঁড়ায় না। আপনি যদি বাসে আসতে চান তাহলে সরাসরি কানকি বাস স্ট্যান্ডে নেমে যেতে পারবেন। মন্দির সেখান থেকে মাত্র ১০০ মিটার।
৪. মারনাই গ্রাম :- উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার ব্লকের অন্তর্গত মারনাই গ্রাম। জেলায় এরকম খুব কম গ্রামই আছে যেখানে এত কিছু দেখার আছে এবং যা ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ, মারনাই গ্রাম তার মধ্যে অন্যতম। এরকম গ্রাম খুঁজে পাওয়া খুবই মুস্কিল যেখানে একসাথে জমিদার ও জোতদারের সহাবস্থান লক্ষ্য করা যায়, মারনাই তে আসলে কিন্তু আপনারা সেটা দেখতে পাবেন যে জমিদার পালচৌধুরী এবং জোতদার দে বাড়ি একই গ্রামে বসবাস করছে। ইটাহার থেকে ১৭ কিমি দূরে এবং রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিমি দূরে অবস্থিত সুই এবং মহানন্দার তীরে অবস্থিত এই গ্রাম।
এই গ্রামে আসলে আপনি দেখতে পাবেন দুটো পুরোনো জমিদার বাড়ি, এবং দুই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠিত দুটি প্রাচীন শিব মন্দির। এবং আরো অনেক কিছু।মারনাই জমিদারবাড়িটি জমিদার মহেন্দ্রনাথ পাল চৌধুরী ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করান। এই জমিদার বাড়িতে একটি ভূগর্ভস্থ ঘর ছাড়াও প্রায় ৩০ টা মত ঘর ছিলো।এছাড়াও জমিদার বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটি কাছারীবাড়িও আছে যেটি মারনাই জমিদার বাড়িরই একটি অংশ। নুনিয়া বাড়ি অর্থাৎ জোৎদারদের বাড়ি, প্রতিষ্ঠাতা বিহারীলাল দে। নুনিয়া কথাটি নুন থেকে এসেছে, নুনের ব্যবসা করতো বলে এই নামটি এসেছে।
এছাড়াও এই মারনাই তে আসলে আপনি দুটি প্রাচীন শিব মন্দির দেখতে পাবেন একটি নুনিয়াদের প্রতিষ্ঠিত ভূতেশ্বর শিব মন্দির অপরটি এই মন্দিরকে দেখে পাল চৌধুরীদের প্রতিষ্ঠিত প্রমথেশ্বর জিউ মন্দির। যেটি বর্তমানে হেরিটেজ মন্দির হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
এছাড়াও এই গ্রামে আছে মহানন্দা এবং সুঁই নদীর মিলনস্থল, জেলার প্রাচীনতম চিকিৎসালয়,জেলার দ্বিতীয় প্রাচীন স্কুল আরো অনেক কিছু, যার জন্য আপনারা আমার মারনাই এর ওপরে লেখা এই ব্লগটি পড়ে ফেলতে পারেন, এখানে সম্পূর্ন details পেয়ে যাবেন...
৫. রায়গঞ্জ ক্যাথিড্রাল চার্চ :- উত্তর দিনাজপুর আসবেন আর রায়গঞ্জের এই চার্চ দেখবেন না এটা হতেই পারে না। রায়গঞ্জের কুলিক পক্ষীনিবাস যতটা জনপ্রিয় কিন্তু তার তুলনায় রায়গঞ্জের এই সেন্ট জোসেফ ক্যাথিড্রাল চার্চ এতটা জনপ্রিয় ও চির পরিচিত না। কিন্তু আমার কথা যদি শোনেন তাহলে অবশ্যই আপনাকে এই চার্চ থেকে একবার ঘুরে যাওয়া উচিৎ, এতো সুন্দর এবং এত বৃহৎ চার্চ আপনি আমাদের রাজ্যে খুবই কমই দেখেছেন। রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৭ কি.মি দূরে ছটপড়ুয়াতে অবস্থিত উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম এই চার্চ।
এই চার্চের ইতিহাস যদি দেখা হয় তাহলে দেখা যায় ১৯৬২ সাল থেকে এই চার্চের যাত্রা শুরু তখন একটি মাত্র ছোট ঘর থেকে অ্যালবিনাস কুজুর এই চার্চের সূত্রপাত করেন। বর্তমানে আমরা চার্চের যে আধুনিক রূপ দেখতে পাই তার উদ্বোধন হয় ২০১০ সালে। একদমই পুরোপুরি ইউরোপীয় আদলে গঠিক, গ্রীক ও রোমান স্টাইলে বিদেশ থেকে আনা বিভিন্ন উচ্চমানের মার্বেল, টাইলস্ গ্লাস সাহায্যে এই চার্চ নির্মাণ করা হয়, এরকম গঠনের চার্চ আমাদের দেশে একদমই নতুন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও হয়েছিলো খুব জমকালো ভাবে। ক্ষেত্রফলের দিক থেকে একসময় এটি চার্চ ছিল ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম চার্চ। এর উচ্চতা ৯০ ফিট।
কেমন করে যাবেন - রায়গঞ্জ থেকে বাসে যেতে চাইলে শিলিগুড়ি মোড় বা বাস স্ট্যান্ড থেকে যেকোনো লোকাল বেসরকারি কালিয়াগঞ্জ গামি বাসে উঠলেই আপনাকে নামিয়ে দেবে। তা না হলে সবচেয়ে ভাল হবে বাস স্ট্যান্ড বা শিলিগুড়ি মোড় থেকে হেমতাবাদগামী যেকোনো অটো তে উঠে পড়ুন আপনাকে একদম চার্চের সামনে নামিয়ে দেবে। ২৫ ডিসেম্বরের সময়ে এখানে বিরাট মেলা বসে এবং প্রচুর লোকের সমাগম হয়, তাছাড়াও বছরের সারা বছরই এই চার্চ খোলা থাকে, যেকোনো দিন আসতে পারেন বিকেল ৫ টার মধ্যে।
৬. কালিয়াগঞ্জের কুনোরে টেরাকোটার মৃৎশিল্প এবং মালগাঁও এর কার্পেট শিল্প :- কালিয়াগঞ্জের ব্লকের এ দুটি জায়গা হস্তশিল্পের জন্য খুবই বিখ্যাত যার খ্যাতি জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রথমে আসি কুনোরের পোড়া মাটির শিল্পে। যা কুনোরের হাটপাড়া গ্রামের প্রায় সকল পরিবারই এই কাজের সাথে যুক্ত। পুরনো গতানুগতিক যন্ত্রে ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতার। বিভিন্ন ধরণের টেরাকোটার সূক্ষ কাজ এখানে আসলে দেখতে পাবেন যা জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের বাইরেও যায়।
কুনোরের পাশেই আছে মালগাঁও গ্রাম যেটি কালিয়াগঞ্জ ব্লকেরই অন্তর্গত। রায়গঞ্জ থেকে কিন্তু মাত্র ১০ কি.মি দূরে এই গ্রাম। এই গ্রামের খ্যাতি জেলা, রাজ্য ছাড়িয়ে বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই গ্রামের অনেকগুলো পরিবার কার্পেট শিল্পের সাথে যুক্ত। কার্পেট শিল্প কিন্তু আমাদের রাজ্যে খুবই কম দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দেখা যায় উত্তরপ্রদেশের ভাদোহী, মির্জাপুর, বারানসী এই সমস্ত এলাকায়। কিন্তু এই সমস্ত এলাকা থেকে কাঁচামাল এনে মালগাঁও তে এখন ভালো মাপের কার্পেট তৈরি হচ্ছে, এখন এখানে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি ক্লাস্টারও গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে আধুনিক উপায়ে এখন কার্পেট তৈরি হচ্ছে। আপনি চাইলে এ দুটি জায়গায় এসে নিজের ইচ্ছে মত জিনিস ক্রয়ও করতে পারবেন, বিভিন্ন মেলা উৎসবে যে সমস্ত স্টলগুলো বসে সেগুলো থেকে অনেক কমে পাবেন এটা বলতে পারি।
৭. বামোরের তারাসুন্দরী মন্দির :- হেমতাবাদের ব্লকের বামোর গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন তারাসুন্দরী মন্দির যা বর্তমানে হেরিটেজ কমিশন থেকে হেরিটেজ মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সংস্কারের কাজও করা হয়েছে।
এই মন্দিরটির প্রতিষ্ঠাকাল মোটামোটি মুঘল আমলের, বর্তমানে যে রূপে আমরা এখন মন্দিরটিকে দেখতে পাচ্ছি সেটা দেখে কখনোই আমাদের মনে হবে না যে মন্দিরটি এত প্রাচীন। প্রতি বছর দীপ্নানিতা অমাবস্যায় কালি মূর্তি গড়ে এখানে কালী পূজার আয়োজন করা হয়।হেমতাবাদ থেকে ১৭ কিমি দূরে বিষ্ণুপুর হাটের খুব কাছেই অবস্থিত এই মন্দির।
৮. করণদীঘি ব্লকের নীলকুঠি :- করনদিঘী থেকে প্রায় ১৪ কিমি দূরে অবস্থিত নাগর নদীর পাড়ে অবস্থিত বেলবাড়ি মৌজার নীলকুঠি গ্রাম, যেখানে ব্রিটিশ আমলে একটি নীলকুঠি স্থাপিত হয়। পরে এর থেকেই এই গ্রামে নাম হয়ে যায় নীলকুঠি। পুরো আদিবাসী অধ্যুষিত এই গ্রামে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক নীলকুঠি টি বর্তমানে হেরিটেজ কমিশন দ্বারা সংস্কার করে একটি পর্যটন কেন্দ্র এবং পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে নাগর নদীর পাড় নীল চাষের পক্ষে উপযুক্ত থাকায় এখানে নীলচাষ হতো ফলে এখানে একটি নীলকুঠিও গড়ে ওঠে। কুঠিটির সাথে পার্শ্ববর্তী নাগর নদীর সংযোগ ছিল। এবং চারপাশ পরীখা দিয়ে ঘেরা ছিল। এখানে ছয়টি বড় চৌবাচ্চা আছে যেখানে নীল গাছ এনে ভিজিয়ে রাখা হতো। পাশে একটি উনোন ও ছিলো যেখানে নীলগুলো জাল দেওয়া হতো। বর্তমানে সংস্কার হওয়ায় পর পুরনো অনেক কিছুই এখন হারিয়ে গেছে।
- ভিডিও দেখুন - ঐতিহাসিক নীলকুঠি, করনদিঘী
আপনি চাইলে রায়গঞ্জ বা করনদিঘী যেকোনো জায়গা থেকেই এখানে আসতে পারেন, রায়গঞ্জ থেকে এর দূরত্ব ৩২ কি.মি, বোতলবাড়ি-রসাখোয়া রোড হয়ে সাবধান তারপর নীলকুঠি। করনদিঘী থেকে সাবধান হয়ে নীলকুঠি মাত্র ১৪ কিমি।
৯. রায়গঞ্জের বিন্দোলের ভৈরবী মন্দির : - উত্তর দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির গুলোর মধ্যে অন্যতম বিন্দোলের এই ভৈরবী মন্দির। রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ২৬ কি.মি দূরে বিন্দোল লুপ্তপ্রায় কাঞ্চন নদীর তীরে এই ভৈরবী মন্দিরটি অবস্থিত। এই মন্দিরটি ইট চুন সুরকি দিয়ে গড়ে উঠে, তার দেওয়ালে পোড়া মাটির কারুকার্য খচিত ইটগুলি মন্দিরের শোভা বর্ধন করে।
এই মন্দিরে কোনো দেবী মূর্তি নেই। আছে মার্তন্ড ভৈরবের একটি কালো পাথরের মূর্তি। যেটি পার্শ্ববর্তী কাঞ্চন নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছিলো। বর্তমানে এই মন্দিরটি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন দ্বারা হেরিটেজ মন্দির হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কিছু সংস্কার সাধনও হয়েছে। উত্তর দিনাজপুরের জেলার যে তিনটে হেরিটেজ মন্দির আছে তার মধ্যে এটি একটি। গ্রামবাসি উদ্যোগে প্রতি বছর শ্রাবণী পূর্ণিমার দিন এখানে বিশেষ পূজোর আয়োজন করা হয়।
এখানে আসা খুবই সহজ। সর্বপ্রথম আপনাকে রায়গঞ্জ পৌঁছতে হবে। এবং রায়গঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে বিন্দোলের অনেক সরকারি বেসরকারি বাস পেয়ে যাবেন এছাড়াও ছোটো অনেক গাড়ি চলাচল করে এই রুটে, মন্দিরটি একদমই রাস্তার ওপরে অবস্থিত।
১০. হাপতিয়াগছ, চোপড়া :- উত্তর দিনাজপুরে আরো একটি সুন্দর জায়গা যেখানে আপনি ঘুরতে বা সময় কাটাতে যেতে পারেন সেটা হলো হাপতিয়াগছ ক্যানাল ব্রিজ। যেটি তিস্তা প্রজেক্টের একটি অংশ। যা উত্তর দিনাজপুর জেলার সর্ব উত্তরে চোপড়া ব্লকে অন্তর্গত। এখানকার প্রধান আকর্ষণই হচ্ছে নদীর ওপর দিয়ে নদী, নিচে মহানন্দা নদী ওপরে তিস্তা ক্যানাল যাকে ইংরেজি ভাষায় Aqueduct বলে, এরকম দ্বিস্তরীয় জলপ্রবাহ আমাদের রাজ্যে আর কোথাও নেই।
জলপাইগুড়ির গজলডোবা থেকে তৈরি তিস্তা ক্যানাল এই জায়গায় এসে মহানন্দা নদীরকে ক্রস করেছে। খুব সুন্দর লাগে জায়গাটি, এটি একদমই বাংলাদেশের বর্ডারে অবস্থিত। পাশেই আছে বাংলাদেশের তেতুঁলিয়া। এখানেই আছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র যা এই তিস্তা ক্যানেলের জল আটকে উৎপাদন করা হচ্ছে। তার পাশাপাশি এখানেই ২০১৬ উদ্বোধন করা হয়েছে উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, যেটা সম্পর্কে অনেকেই আমরা জানি না। প্রায় ৫ কি.মি এলাকা জুড়ে ক্যানেলের মাঝের অংশ জুড়ে এই সৌর প্যানেল বসানো হয়েছে, যা আমাদের রাজ্যের তুলনায় যথেষ্টই বড়। এর ফেস- ২ ও শুরু হয়েছে পার্শ্ববর্তী তিস্তা ক্যানেলের ওপরে। খুবই দারুণ একটা বৈচিত্র্যময় জায়গা অনেক কিছু আছে এখানে দেখার, আছে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সুন্দর সুন্দর চায়ের বাগান। কিন্তু এখানে খুব কম লোকই এসে থাকে।
- ভিডিওটি দেখুন - হাপতিয়াগছ এক অসাধারণ জায়গা
ইসলামপুর শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিমি দূরে অবস্থিত এই হাপতিয়াগছ। এখানে আসতে হলে আপনাকে নামতে হবে কলাগছ বা সোনাপুর মোড়ে। কলাগছ থেকে দূরত্ব একটু বেশি হলেও টোটো, অটো পাশাপাশি ছোটো গাড়ি ও পেয়ে যাবেন। আর সোনাপুর মোড় থেকে দূরত্ব একটু কম কিন্তু একমাত্র ভরসা টোটো কিংবা অটো রিজার্ভ করা। ভাড়া নিতে পারে ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। আর কলাগছ থেকে ভাড়া ৪০ টাকা পারহেড।
১১ . ভূপালপুর রাজবাড়ি ও স্বামীনাথের মন্দির :- উত্তর দিনাজপুর জেলার ৯ টি ব্লকের মধ্যে সবচেয়ে বর্ধিঞ্চু এবং ঐতিহাসিক দিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি ব্লক। এই ব্লকে প্রচুর ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো নিয়ে অন্য একটি ব্লগে আলোচনা করবো। এখন আমরা আলোচনা করবো ইটাহারের দুর্গাপুরের ভূপালপুর রাজবাড়ি এবং তার সাথে দুর্গাপুরের স্বামীনাথের মন্দির এই দুটি একসাথে আলোচনার কারণ হল দুটি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
- আরো পড়ুন - উত্তর দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে পুরোনো স্কুল
ইটাহারের চুরামন রায়চৌধুরী জমিদার বাড়ি গড়ে উঠেছিলো যা ছিল উত্তর দিনাজপুর জেলার বৃহত্তম জমিদারী। তাদের শরিকরাই বাহিন জমিদারবাড়ি তৈরি করেন। মহানন্দা নদীর বন্যাতে এই বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেলে, এই বাড়ির বংশধরেরা দুর্গাপুরে চলে আসে। জমিদার ভূপাল চন্দ্র রায়চৌধুরীর এই অনবদ্য জমিদার বাড়িটি তৈরী করান। এই বাড়ি তৈরির দায়িত্বভার অর্পণ করেন মার্টিন ও বার্ণ কোম্পানিকে। তার নামেই এই এলাকার নাম হয় ভূপালপুর। আর দুর্গাপুরের নাম হয় তার মা দুর্গাময়ী দেবীর নামে।
জমিদার ভূপাল চন্দ্র রায়চৌধুরীর মা দুর্গাময়ী চৌধুরী তার স্বর্গীয় শাশুড়ি পদ্মাবতী দেবীর শুভ সংকল্প অনুসারে ১৩২১ বঙ্গাব্দে ২৫শে বৈশাখ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন হাসুয়া নামক স্থানে, এই খানেই এই মূর্তিটি পাওয়া যায়। পরে ভূপাল চন্দ্র রায়চৌধুরী স্বপ্নাদেশ পেয়ে বুদ্ধ পূর্ণিমার দিন এই পূজার সূচনা করেন। মন্দিরের বিষ্ণুর একটি কষ্টি পাথরের মূর্তি বিদ্যমান। পূজা উপলক্ষে এখানে একটি বড় মেলার আসরও বসে যা উত্তর দিনাজপুর জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলা ।
এই মন্দির টি রায়গঞ্জ শহর থেকে ৯ কি.মি দূরে এবং রাজবাড়িটি ৭ কিমি দূরে তাই এখানে আসা খুবই সহজ। আপনি টোটো, ছোটো গাড়ি, বাস সব পেয়ে যাবেন রায়গঞ্জ থেকে এখানে আসার। স্বামীনাথের মন্দিরে আসার জন্য প্রথমে রাজবাড়ী মোড়ে নেমে সেখান থেকে টোটো করে ২ কি.মি এই জায়গাটি।
১২. রাধিকাপুর বর্ডার :- এই রাধিকাপুর জায়গাটির অনেকের কাছেই পরিচিত পেয়েছে ট্রেনের জন্য, বিশেষ করে রাধিকাপুর এক্সপ্রেসের জন্য। এই রাধিকাপুর নামটা এত পরিচিতি পেলেও বেশিরভাগই নয়তো জানেন না এই রাধিকাপুর জায়গাটি কোথায়। এই রাধিকাপুর হল বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া কালিয়াগঞ্জ ব্লকের অন্তর্গত একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। এটিকে ভারতের শেষ স্টেশনও বলতে পারেন। বর্তমানে এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক স্টেশন হিসেবে স্বীকৃত। এই রাধিকাপুর হয়েই মালগাড়ির মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পাদিত হয়।
পড়ুন - উত্তর দিনাজপুরের সবচেয়ে প্রাচীন দুর্গাপূজা উদগ্রাম রাধিকাপুর
উত্তর দিনাজপুর জেলার সীমান্ত স্টেশন রাধিকাপুর এবং বর্ডারের এপারে আছে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বিরল স্টেশন। এই দুটি দুই দেশের দুই প্রান্তের দু'টি সীমান্ত স্টেশন যা শতাব্দী প্রাচীন কাটিহার - পার্বতীপুর রেল লাইনের অন্তর্ভুক্ত। আসাম বিহার লাইনের অন্তর্গত বিহারের বারসই স্টেশন থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর স্টেশন পর্যন্ত এই সেকসনে লাইনের কাজ সম্পূর্ন হয় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর এই লাইনকে আরো সম্প্রসারিত করা হয় বারসই থেকে কাটিহার পর্যন্ত । তখন রাধিকাপুর এবং বিরল দুটি স্টেশনেরই কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। রাধিকাপুর স্টেশনটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৯২৭ সালে।
এর বাইরেও উত্তর দিনাজপুর জেলায় এরকম আরো দারুণ জায়গা ঐতিহাসিক স্থান আছে যার মধ্যে ইসলামপুর জমিদার বাড়ি, চোপড়ার সাপনিকলা ফরেস্ট, রায়গঞ্জের দেবপুরী হেমতাবাদের রাজা গণেশ এর গড় (যদি ও বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই), কালিয়াগঞ্জের ফরিদপুর বর্ডার প্রভৃতি, এবং উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপরা ও ইসলামপুর ব্লকের সুন্দর সুন্দর সব চায়ের বাগান।
ধন্যবাদ ভ্রমণ পিপাসু 🙏
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন