পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘোরার মত সেরা ১০টি জায়গা। West Medinipur Top Ten Tourist Attraction.

 পশ্চিম মেদিনীপুরে ঘোরার মত সেরা ১০টি জায়গা

ভ্রমণ পিপাসু :- পশ্চিমবঙ্গই এমন একটি রাজ্য, যে রাজ্যের উত্তরে পাহাড় আছে দক্ষিণে সমুদ্র। এরকম রাজ্য কিন্তু ভারতবর্ষে খুঁজে পাবেন না। এর সাথে সাথে অরণ্য, মালভূমি, নদী কি নেই এই রাজ্যে, প্রকৃতি যেনো উজাড় করে দিয়েছে আমাদের এই রাজ্যের জন্য। কিন্তু এর সাথে সঠিক সরকারি উদ্যোগ এবং রাজ্যের মানুষের সচেতনতা যদি সঠিকভাবে কাজ করে তাহলে অন্য অন্য রাজ্যের মত পশ্চিমবঙ্গও ভারতের পর্যটন মানচিত্রে একটি অনন্য রাজ্যে পরিণত হবে। যেমন বর্তমানে এখন কেরালা, রাজস্থান, গুজরাট আছে।


আমরা বাঙালি মাত্রই ভ্রমণ পিপাসু, কিন্তু আমাদের রাজ্যের কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিচিত জায়গাকে যদি বাদ রাখা যায়, তাহলে বাঙালিরা রাজ্যের বাইরে বিভিন্ন জায়গাগুলোতে ঘোরার ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেয়। আমি ভারতের প্রায় ৬০% রাজ্যই ঘুরে নিয়েছি এবং পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলাই, এখনোও চলছে, পাহাড় বা সমুদ্রকে বাদ দিয়েও পশ্চিমবঙ্গে এমন অনেক অনেক কিছু আছে যা আমরা জানি না সেগুলোই ব্লগের মাধ্যমে আপনাদের সামনে তুলে ধরবো, সাথে থাকবে ভ্রমণ প্ল্যান, কেমন করে পৌঁছোবেন। এই ব্লগে আমি তুলে ধরবো বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঘাঁটি মেদিনীপুর জেলার সেরা জায়গা। আমার এই ভ্রমণ পিপাসু সাইট ছাড়াও একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে (Bhraman Pipasu vlogs) এবং ফেসবুক পেজ - ভ্রমণ পিপাসু বলে সেগুলো সাবস্ক্রাইব ও ফলো করে নিতে পারেন, ভিডিও মাধ্যমে জায়গা গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চলুন তাহলে এই ব্লগ টা এবার শুরু করা যাক...

বীরসিংহ বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান :- এই মেদিনীপুর জেলা বড় বড় বিখ্যাত সব মানুষদের জন্ম দিয়েছে। তার একটি কারণ হয়তো এই জেলা আগে থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে অন্য জেলাগুলি থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। সেরকমই একজন মানুষ ছিলেন বিদ্যাসাগর। যার জন্ম ঘাটাল ব্লকের অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রাম। বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বেশি কিছু হয়তো বলার প্রয়োজন পড়বে না, কারণ সকলেই প্রায় সবকিছুই জানেন।

এখানে আসলে কি কি দেখবেন :- এখানে দেখার মত অনেক কিছুই আছে। দিক নির্দেশক বোর্ডও দেওয়া আছে। প্রথমে দেখে নেবেন জন্মভিটে বিদ্যাসাগর স্মৃতি মন্দির, তারপর একে একে সংগ্রহশালা, পাঠাগার, প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুল, বিদ্যাসাগরের শিক্ষককে বাড়ি এরকম আরো কিছু। সব আসে পাশেই আছে।


এখানে কেমন করে পৌঁছোবেন মেদিনীপুর থেকে এই বীরসিংহ গ্রামে যাওয়ার প্রধাণত দুটি রাস্তা আছে একটি কেশপুর দাসপুর, ঘাটাল হয়ে, দ্বিতীয়টি ক্ষীরপাই হয়ে। মেদিনীপুর থেকে বাস ও পেয়ে যাবেন আপনাকে নামতে হবে রাধানগর স্টপেজে তারপর বিদ্যাসাগর তোরন থেকে বীরসিংহের দূরত্ব প্রায় ৫ কি.মি, টোটো, অটো পেয়ে যাবেন। আর ট্রেনে চাইলে নিকটবর্তী স্টেশন চন্দ্রকোনা রোড কলকাতা থেকে আসতে হলে বাস পেয়ে যাবেন হাওড়া থেকে ঘাটাল বা চন্দ্রকোনার।

শহিদ ক্ষুদিরাম বসুর জন্মস্থান :- ভারতবর্ষের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম শহীদ বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর জন্ম এই মেদিনীপুরে। মেদিনীপুরের কেশপুর ব্লকের অন্তর্গত মোহবনী গ্রাম। এই গ্রামেই তার জন্ম হয়েছিলো। যদিও তার জীবনের বেশিরভাগটাই কেটেছে মেদিনীপুরে অবস্থিত তার মাসির বাড়িতে। যদিও এখানে এখন তার পৈতৃকবাড়ির কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই, সরকারি উদ্যোগে এখানে এখন সৌন্দর্যায়ন করা হয়েছে, এখানে আছে একটি অনুষ্ঠান মঞ্চ, পাঠাগার পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা, পার্ক প্রভৃতি, তার পাশাপাশি ক্ষুদিরামে এক পূর্ণাবয়ব আবক্ষমূর্তি বসানো হয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষনের জন্য অনেক ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়েছে। এখানে আসলে অবশ্যই আপনাদের ভালো লাগবে দারুণ একটা দিন কাটাতে পারবেন।


মেদিনীপুর শহর থেকে এই মোহবনী গ্রামের দূরত্ব ৩৬ কি.মি। মেদিনীপুর থেকে কেশপুর পেরিয়ে নেড়াদেউল মোড় থেকে বাঁ দিকে কিছুটা গেলেই এই গ্রাম। নেড়াদেউল মোড়ে শহীদ ক্ষুদিরাম একটি তোরনও করা আছে। মেদিনীপুর থেকে চন্দ্রকোনা টাউনের বাস ধরে এই নেড়াদেউল মোড় আপনাকে নেমে টোটো করতে হবে, আর বাইক বা নিজস্ব গাড়ি থাকলে তো কোনো ব্যাপারই নেই।

গনগনি :- গনগনি যাকে বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হিসেবেও ডাকা হয়। এটির অবস্থান জেলার গড়বেতার শহরের খুব কাছে। গড়বেতা শহর থেকে প্রায় ২ কিমি দূরে শিলাবতী দক্ষিণ পাড়ে নদী ও বায়ুর অনেক বছরের ক্ষয় কার্যের লাল মাটির এমন এমন সব আশ্চর্য ভূমিরুপ সৃষ্টি হয়েছে যা দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। সেইজন্য একে আমেরিকার কালোরাডো নদীতে সৃষ্ট গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাথে তুলনা করে বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হিসেবে ডাকা হয়। যদিও আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাথে আকারে অনেকটাই ছোটো এবং কম, এছাড়া এটি কেবল শিলাবতী নদীর দক্ষিণ পার্শ্বে আছে উত্তর দিকে এরকম কিছু নেই। কয়েক বছর হল পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় হয়ে হয়েছে এই গনগনি যার জন্য অনেকটাই দায়ী বর্তমানের সোস্যাল মিডিয়া।

গনগনি। 

গনগনিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা এবার পারিপার্শ্বিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সরকারি উদ্যোগও চোখে পড়ছে। আসে পাশে এখন প্রচুর ছোট বড়ো হোটেলও গড়ে উঠেছে এই গনগনিকে কেন্দ্র করে। মেদিনীপুর বা বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে এর দূরত্ব বেশী না। আপনি চাইলে ও মেদিনীপুর বা বিষ্ণুপুর থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে এসে একদিনের জন্য এখানে ঘুরে যেতে পারেন, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এখানে আসার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

এবার আসি এখানে কেমন করে আসবেন, আপনি যদি বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের ট্যুর প্ল্যান করে থাকেন তাহলে একদিনে জন্য গনগনিও আপনাদের প্ল্যানে অ্যাড করে নিতে পারেন বিষ্ণুপুর থেকে এর দূরত্ব ২২ কিমির মত হবে। মেদিনীপুর থেকেও এখানে সোজা চলে আসতে পারেন, বাস বা ভাড়া গাড়ি করে। বাসে আসলে গড়বেতাতে নেমে তারপর বাকি ২ কি.মি জন্য টোটো রিজার্ভ করে নিতে হবে।

পটচিত্রের গ্রাম নয়া :- পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলার নয়া গ্রাম প্রায় ৮০টি মত মুসলিম পরিবারের বাস। তারাই যুগের পর যুগ ধরে বিভিন্ন ভেষজ রং ও তুলির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলছেন রাধা কৃষ্ণের প্রেমলীলা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, দুর্গা - কালি এবং তার সমন্ধে নানা ধরনের কাহিনী। এগুলো হলো বিখ্যাত পটচিত্র, যা, GI ট্যাগ ও পেয়েছে, যার জন্য বিখ্যাত পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার নয়া গ্রাম। এখন যুগ পাল্টেছে তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জামা কাপড়, শাড়ি, গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রীর ওপরে এই কাজ গুলো ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে, এদের প্রত্যেকের পদবী চিত্রকর, আপনারা হয়তো জানেন না প্রতিটি পটচিত্রের সঙ্গে যুক্ত আছে একটি করে গান ও গল্প। প্রতি বছর জানুয়ারি মাঝামাঝি এখানে সরকারি উদ্যোগে মেলার আয়োজন করা হয় যাকে পটমায়া বলে। আসলে অবশ্যই এই মেলায় আসবেন সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। তাই অবশ্যই একবারের জন্য এসে ঘুরে যেতে পারেন এই গ্রাম থেকে আর আপনি যদি হাতের কাজ পছন্দ করে থাকেন তাহলে কোনো কথাই নেই। খুবই ভালো লাগবে জায়গাটি। 

পটচিত্র পিংলা নয়া ।

গোপগড় :- মেদিনীপুর শহর থেকেই যদি আসে পাশে ঘুরতে চান তাহলে সবচেয়ে আদর্শ জায়গা হলো। বর্তমানে এই ঐতিহাসিক জায়গাটিকে ইকোপার্ক হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ৫ কি.মি দূরে অবস্থিত এই জায়গা গোটা জেলার মধ্যে উচ্চতম স্থান। উচু ঢিপীর ওপরে অবস্থিত জঙ্গল দিয়ে ঘেরা এই ইকোপার্ক সময় কাটানো জন্য একদম আদর্শ জায়গা। ভিতর ঢোকার পর আপনি বুঝতে পারবেন যে ভেতরটা ঠিক কত বড়।

ইকোপার্কের ভেতরে যে গড়টি অবস্থিত স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে মহাভারতের সময়কার বিরাট রাজার গোশালা হিসেবে মনে করা হয়। কথিত আছে এখানে গোপদের থাকার জন্য গোপঘর বা গোপগৃহ ছিলো, পাণ্ডবরা অজ্ঞতবাসের সময়ে এই জায়গাটিতেই আত্মগোপন করে ছিলেন। এই গোপদের থাকার জায়গাই অপভ্রংশ হয়ে গোপগড় নামে পরিচিতি লাভ করে।

সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫.৩০ পর্যন্ত এই পার্ক খোলা থাকে। আপনি মেদিনীপুর শহর থেকে টোটো বা নিজস্ব গাড়ি করে গুড়গুড়িপালের রাস্তা হয়ে এই গোপগড়ে চলে আসতে পারেন রাস্তার পাশেই একদম, গাড়ি পার্কিং এরও ব্যবস্থা আছে এখানে।

প্রয়াগ ফিল্ম সিটি :- পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘোরার জায়গা গুলোর মধ্যে একটি হল এই প্রয়াগ ফিল্ম সিটি, যেটা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না। মেদিনীপুর জেলার এই ফিল্ম সিটির আসে পাশের এমন অনেকে আছেন তারা জানেনই না তাদের ঘরের পাশে এত বড়ো এত সুন্দর একটা ঘোরার জায়গা আছে। ১৬০০ একর জুড়ে বিস্তৃত এই ফিল্ম সিটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফিল্ম সিটি, হায়দরাবাদের রামোজী ফিল্ম সিটির পরেই। তৈরি করতে খরচা হয়েছিল প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এটি ডিসাইন করেছিলেন বিখ্যাত আর্ট ডিরেক্টর নীতীশ রায়। এই ফিল্ম সিটিটি অবস্থিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোনা রোডের কাছে অবস্থিত ডুকিতে।

প্রয়াগ ফিল্ম সিটি 

পুরো একটা ফিল্ম সিটিকে প্রয়াগ গ্রুপের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছিলো, কি নেই এখানে একটা শহরের যা যা থাকে সবকিছুই এখানে আছে। কিন্তু প্রয়াগ গ্রুপের কর্ণধার গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে অবহেলা, অযত্ন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ফিল্ম সিটি। অনেক সিনেমা, সিরিয়ালের শুটিং ও এখানে হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দেবের যোদ্ধা। ভবিষ্যতে হয়তো আরো হবে, এই জায়গাটির রক্ষণাবেক্ষণ যদি আরো একটু ভালো করে করা যেতো তাহলে পর্যটকদের আরো বেশি করে এখানে আকর্ষীত করা যেতো।


এবার আসি এখানে কেমন করে আসবেন ট্রেন আসতে চাইলে হাওড়া থেকে পুরুলিয়া লোকাল ধরে নামতে হবে চন্দ্রকোনা রোড স্টেশনে তারপর আপনাকে টোটো রিজার্ভ করে আসতে হবে এখানে, ভেতরে ঘোরার জন্যও টোটো আপনাকে করতে হবে কারণ এত বড় জায়গা আপনি হেঁটে ঘুরতে পারবেন না। এছাড়া আপনি বাসে আসতে চাইলে হাওড়া বা মেদিনীপুর থেকে চন্দ্রকোনা রোডে আসতে হবে তারপর যেতে হবে ডুকি। আপনি স্টেশন বা বাস স্ট্যান্ডে নেমে একটা টোটো একবারের জন্য রিজার্ভ করে নিবেন, টোটো ভেতরটা আপনাকে ঘুরিয়ে আবার স্টেশনে ছেড়ে দেবে। আর আপনি যদি বাইকে আসেন তাহলে তো সবচেয়ে বেস্ট হয়। এখানে ঢোকার প্রবেশ মুল্য 300 টাকা। টাকা টা একটু বেশি মনে হচ্ছে কিছু ভেতরে এত সুন্দর সুন্দর একটা জিনিস দেখতে পাবেন যে সেটা অন্য কোথাও পাবেন না। সারাটা দিন কেমন করে কেটে যাবে টেরই পাবেন না।

এবার আসি কেমন করে পৌঁছবেন - যদি লোকাল ট্রেনে আসতে চান তাহলে হাওড়া থেকে মেদিনীপুর বা খরগপুর লোকাল ট্রেন ধরে নেমে পড়ুন বালিচক স্টেশনে সেখান থেকে ছোটো গাড়ি বা ট্রেকার পেয়ে যাবেন। আর যারা বাস বা গাড়িতে আসবেন তারা ডেবরা থেকে বাঁ দিকে ঢুকে যাবেন তারপর বালিচক হয়ে পৌঁছে যান নয়া গ্রামে।

শালবনী :- শালবনী পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার আরো একটি সুন্দর জায়গা। শালবনীতে আছে জিন্দলদের সিমেন্ট কারখানা এবং আরো কিছু ছোটো খাটো কারখানা, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নোট প্রিন্টিং প্রেস এবং সবচেয়ে শালবনির আরাবাড়ি ফরেস্ট যেখানে ভারতের প্রথম যৌথ বন সংরক্ষন প্রকল্প চালু করা হয়েছিলো।

শালবনীতে আলাদা করে যদি ঘুরতে আসতে চান তাহলে বিশেষ কিছু হয়তো দেখার নেই আমার মতে, তবে আসতে চাইলে আসতে পারেন সুন্দর রাস্তা কিছু রিসর্টও এখন গড়ে উঠেছে এই শালবনীতে পর্যটকদের জন্য। আপনি যদি মেদিনীপুর থেকে গনগনি, প্রয়াগ ফিল্ম সিটি বা বিষ্ণুপুর যান তাহলে রাস্তাতেই পড়বে এই শালবনী, মেদিনীপুর থেকে যার দূরত্ব ২৫ কি.মি। তাই বলেছিলাম আলাদা করে আসার চেয়ে এই জায়গা গুলো যাওয়ার পথেই শালবনীটা ঘুরে নিতে পারেন।

নাড়াজল রাজবাড়ি :- মেদিনীপুরের মধ্যে সবচেয়ে বড় জমিদারি ছিল এই নাড়াজল জমিদারবাড়ি, কেউ কেউ একে রাজবাড়ি বলেও থাকে। মেদিনীপুর শহর থেকে প্রায় ৪০ কি.মি দূরে জেলার দাসপুর ব্লকের অন্তর্গত শিলাবতী ও কংশাবতী নদীর মাঝে অবস্থিত নাড়াজল গ্রামের গড়ে উঠেছিলো এই রাজবাড়ি। এই রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন উদয় নারায়ণ ঘোষ। এই নাড়াজল রাজবাড়ির রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে এক বিরাট মেলা ও বসে। এই নারাজল রথযাত্রা এই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম রথযাত্রা।

প্রধান ফটক। 

এই রাজবাড়িতে আসলে কি কি দেখবেন, এক বিশাল রাজবাড়ি দেখার পাশাপাশি পুরোনো নারাজল রাজ কলেজের ধ্বংসাবশেষ, সিংহদুয়ারের ডান পাশেই রয়েছে ঠাকুরবাড়ি, এখানে আছে বেলজিয়াম গ্লাসের তৈরি নাট মন্দির, গোবিন্দ জিউ মন্দির, সীতারাম জিউ মন্দির। এছাড়াও একটু দূরেই আছে রাজবংশের তৈরি হাওয়ামহল, আর আছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লঙ্কাগড় জলহরি একটা বড় পুকুরের ওপরে এই বাড়িটিকে তৈরি করেন রাজা মোহনলাল খাঁ। এছাড়াও বাস স্ট্যান্ড থেকে রাজবাড়ি আসার পথে দেখতে পাবেন ৬টি আটচালা বিশিষ্ট শিবমন্দির, এর উল্টো দিকেই আছে ২৫ চূড়া বিশিষ্ট রাসমঞ্চ। এখান থেকেই রথযাত্রা শুরু হয়। এছাড়াও আপনি চাইলে প্রায় ১ কি.মি দূরেই দুদিকে কংশাবতী এবং শিলাবতী নদীর পাড়েও ঘুরে আসতে পারেন। 

নাড়াজোল রথযাত্রা।

এখানে আসবেন কেমন করে যারা কলকাতা থেকে আসবেন তারা বাইরোড কোলাঘাট, পাঁশকুড়া দাসপুর হয়ে এই রাজবাড়িতে চলে আসতে পারেন। আর মেদিনীপুর থেকে কেসপুর হয়ে কেসপুর মোড থেকে ডান দিকে সোজা গেলে এই নাড়াজল পড়বে। ট্রেনে আসতে হলে নিকটবর্তী স্টেশন মেদিনীপুর বা পাঁশকুড়া।

রাসমঞ্চ 

মন্দিরময় পাথরা :- মেদিনীপুর শহর থেকে মাত্র ১২ কি.মি দূরে কংশাবতী তীরে অবস্থিত ছোট্ট একটি জনপদ পাথরা। এই পাথরাতেই লুকিয়ে আছে বাংলার এক প্রাচীন ইতিহাস। একসাথে প্রায় ৩৪ টি মন্দির এই পাথরার আসেপাশে গড়ে তোলা হয়েছিল, সেইজন্য পাথরাকে বলা হয় মন্দিরময় পাথরা। এত সংখক মন্দির একসাথে কিন্তু খুব কম জায়গাতেই দেখা যায়। কিন্তু মেদিনীপুর শহরের এত কাছে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এই জায়গাটি সম্পর্কে অনেকেই অজানা। তার একটা কারণ এর প্রচার তেমনভাবে হয়নি, কিন্তু বর্তমানে সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন অনেক পর্যটকই এখানে আসছে।

মন্দিরময় পাথরা ।

এবার একটু পাথরার ইতিহাস নিয়ে একটু অলোকপাত করা যাক। পাথরার এই মন্দিরগুলি নির্মাণের সাথে জড়িয়ে আছে স্থানীয় প্রভাবশালী ঘোষাল ও মজুমদার পরিবারের নাম। আলীর্বদী খাঁ আমলে এই এলাকার দায়িত্ব পেয়েছেন ঘোষাল পরিবার, কিন্তু এই ঘোষাল পরিবারের বিদ্যানন্দ ঘোষাল রাজস্ব নবাবকে পাঠানোর পরিবর্তে তা মন্দির নির্মাণ কার্যে ব্যয় করতে থাকেন, তাতে ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব তাকে হাতির পায়ে পিসে হত্যা করার আদেশ দেন, কিন্তু আশ্চর্য্যজনক ভাবে সেই হাতি তার শরীরে পা তুলতে গিয়েও সরিয়ে নেয়, এই দৃশ্য দেখে সকলে অবাক হয়ে যান, সেই থেকেই জায়গার নাম হাতির "পা- উতরা" বা পাথরা হয়ে যায়। তারপর নবাব আলীর্বদী তাকে রেহাই দেন।

Pathra. 

জমিদারবাড়ি পরিবারের লোকেরা এই জায়গা ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার পরে মন্দির গুলো দিন অযত্নে ও অবহেলায় দিন দিন নষ্ট হচ্ছিল, তারপর স্থানীয় মহ ইয়াসিন পাঠান উদ্যোগ নেন, তারই প্রচেষ্টায় মন্দির গুলোর বেশিরভাগই এখন ASI অধিকারে আছে তারাই মন্দিরগুলোর সংস্কার করছে। 

এখানে আসতে হলে আপনাকে মেদিনীপুর শহর থেকেই আসতে হবে, দূরত্ব মাত্র ১২ কি.মি। মেদিনীপুর শহর থেকে হাতিহালকা রোড হয়ে নদীর ধার রাস্তা দিয়ে সোজা পৌঁছে যাবেন একদম পাথরা, আসা খুবই সহজ আপনি বাইক নিয়ে আসলে ভালো নাহলে একটি টোটো রিজার্ভ করে নিতে হবে এখানে আসার জন্য।

কুড়ুমবেড়া ফোর্ট :- মেদিনীপুর জেলার প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো ঐতিহাসিক নিদর্শন হল এই কুড়ুমবেড়া ফোর্ট। কিন্তু আমরা কি এর ইতিহাস সম্পর্কে জানি? প্রাচীনকালে এই এলাকা ওড়িশার গজপতি বংশের শাসকের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এটি। প্রথম অবস্থায় এটি কিন্তু একটি মন্দির হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল পরবর্তীতে মুসলিম শাসনকালে, এই মন্দিরটিকে একটি দুর্গ হিসেবে গড়ে তোলা হয়। বাংলায় কিন্তু পাথরের দুর্গ খুব একটা দেখা যায়না, আমার মতে একটি ও নেই, সেদিক থেকে এই কুড়ুমবেড়া ফোর্ট কিন্তু ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে। এটি অবস্থিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়ারি ব্লকের গগনেশ্বর গ্রামে।

 এই স্থাপত্যের মাঝে একটা মসজিদ আছে যেটা পরবর্তীতে তৈরি করা হয়। হয়তো মুসলিম শাসনে এটাকে ফোর্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। থাকতে পারে স্থানীয় ভাষায় *কুড়ুম* অর্থ *পাথর* অর্থাৎ পাথরের *বেড়া* দেওয়া *সীমাবদ্ধ এলাকা।* ঐতিহাসিক দলিল অনুসারে ১৪৩৮ থেকে ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওড়িশার সূর্যবংশীয় রাজা গজপতি কপিলেন্দ্র দেব ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে এই মন্দিরটির নির্মাণ করেন। এই অঞ্চলে যেহেতু ল্যাটেরাইট মাটির আধিক্য বেশি সেইজন্য এর ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার তৎকালীন আফগান শাসক সুলেমান কররানী তার ছেলে বায়জিদকে প্রেরণ করেন ওড়িশা দখল করার জন্য তিনি ওড়িশা রাজকে পরাজিত করলে মেদিনীপুর সহ এই এলাকা মুসলিম শাসনে আসে এরপর আফগান থেকে তা মোগল দের অধিকারে যায় ঔরঙ্গজেবের সময় মুসলিম সেনাপতি তাহির খান এটি দখল করেন। এই দুর্গের ভিতরে একটি মসজিদ ও লক্ষ্য করা যায়। এই দুর্গের গঠনেও সেই কারণে হিন্দু ওড়িশা রীতি এবং মুসলিম রীতি স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। 

এখানে যাবেন কিভাবে??

যারা মেদিনীপুর থেকে আসবেন তারা বেলদা থেকে কেশিয়ারি যাওয়ার রাস্তায় কুকাই বাসষ্ট্যাণ্ড ,সেখান থেকে বাঁ দিকে গেলে গগনেশ্বর গ্রাম,সেখানেই এই কুরুমবেড়া ফোর্ট। খরগপুর থেকে আসলে কেশিয়ারি পার করে কুকাই বাসষ্ট্যাণ্ড হয়ে এই গ্রামে আসতে পারবেন, ট্রেনে আসতে চাইলে নিকটবর্তী স্টেশন বেলদা। কলকাতা থেকে আসতে চাইলে ট্রেনে মেদিনীপুর, খরগপুর বা বেলদা স্টেশনে নামতে হবে।

মোগলমারী বৌদ্ধ বিহার :- ঐতিহাসিক নিদর্শনের দিক থেকে সমৃদ্ধ জেলা মেদিনীপুরে আরো একটি ঐতিহাসিক স্থান মোগলমারী বৌদ্ধ বিহার। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকে প্রতিষ্ঠিত এই মহাবিহার নালন্দা মহাবিহারের সমসাময়িক এবং এটি আমাদের রাজ্যের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম মহাবিহার।

মোগলমারী নামটি হওয়ার পেছনেও একটি ইতিহাস আছে, মধ্যযুগে এই জায়গাটিতে মোগল এবং পাঠানদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিলো, এবং সেই যুদ্ধে বহু মোগল সৈন্য মারা গিয়েছিলো, সেটা থেকেই জায়গাটির এই নাম হয়েছে। চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাংও এসেছিলেন এই মহাবিহারে, তার লেখা সি ইউ কি গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। ২০০৩-৪ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অশোক দত্তের উদ্যোগে এখানে খনন কাজ শুরু হয় যা প্রায় ৯ দফায় চলে, খনন কাজের ফলে এখান থেকে ৯৫টি বৌদ্ধ মূর্তি এবং কিছু স্বর্ণ মুদ্রা পাওয়া গেছে। তাই ইতিহাস কে যদি খুব কাছ থেকে অনুভব করতে চান তাহলে অবশ্যই এই জায়গাটি থেকে ঘুরে যেতে পারেন।

কেমন করে আসবেন, মেদিনীপুর থেকে এই মোগলমারী আসা খুবই সহজ, রাস্তা একদম একটাই, কিন্তু দূরত্ব টা একটু বেশি প্রায় ৬৫ কি.মি। আপনি বাই রোড আসতে চাইলে বেলদা পার হয়েই দাঁতনের কিছু আগেই এই মোগলমারী, বাস স্ট্যান্ড থেকে এই বৌদ্ধ বিহার মাত্র হাঁটা পথের দুরত্ব। ট্রেনে আসতে চাইলে নিকটবর্তী স্টেশন বেলদা বা নেকুরসেনি। আপনি কলকাতা থেকে আসতে চাইলে বাই রোড বা ট্রেনে সরাসরি এখানে চলে আসতে পারেন।

কর্ণগড় :- মেদিনীপুর থেকে খানিকটা দূরেই শালবনী ব্লকের অন্তর্গত কর্ণগড়ে অবস্থিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই হিসেবে পরিচিত রানীর গড় ছিল। তিনি ছিলেন কর্ণগড় রাজপরিবারের শেষ রাজা অজিত সিংহ এর স্ত্রী। অজিত সিংহ এর মৃত্যুর পর তিনি ১৮১২ সাল পর্যন্ত জীবিত ছিলেন তাদের সাথে নাড়াজল রাজ পরিবারের খুব ভাল সম্পর্ক ছিলো। রানী মৃত্যুর আগে তার বংশের সমস্ত সম্পত্তি নাড়াজল রাজপরিবারকে দিয়ে যান।


 


রাণী শিরোমনী তার সময়ে সংঘটিত চূয়ার বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন,এবং যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন সেইজন্য তাকে মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই বলা হয়। ভারতীয় রেল তাকে সম্মান জানানোর জন্য একটি ট্রেন যেটি হাওড়া থেকে আদ্রা পর্যন্ত চলে তার নামে রানী শিরোমনি নামে করেছে। এই কর্ণগড়ে একটি বৃহৎ মন্দির ও আছে যা মাহামায়া মন্দির নামে খ্যাত যা রানী শিরোমনি নামেও পরিচিত।

মেদিনীপুর থেকে সড়কপথে আসতে চাইলে ভাদুতলা মোড় থেকে ডান দিকে গেলেই কর্ণগড়, আগে মন্দির পড়বে কিছু দূরেই গড়টি। কলকাতা থেকে ট্রেনেও সরাসরি চলে আসতে পারেন ভাদুতলাতে স্টেশন ও আছে কিন্তু সব ট্রেন দাঁড়ায় না।

ক্ষীরপাই :- সবচেয়ে মেদিনীপুর জেলার আরো একটি জায়গার আপনাদের সন্ধান দিচ্ছি, যেই জায়গাটায় আপনাদের মেদিনীপুর আসলে অবশ্যই যাওয়া উচিত তবে এই জায়গাটিতে কোনো দর্শনীয় স্থান নেই, আপনি এখানে যাবেন একটি খাওয়ার খেতে যেই খাওয়ারটি গোটা ভারতবর্ষে কেবলমাত্র এখানেই পাবেন জায়গাটি হল ক্ষীরপাই এবং খাওয়ারটি হল বাবরসা, এটি একটি মিষ্টান্ন। এর সৃষ্টি এবং নামকরনের পেছনে ও এক ইতিহাস আছে চলুন সেটা একটু আলোচনা করি। ১৭৪০ এর পর থেকে বর্গীরা প্রায় বাংলা আক্রমণ করতো, সেই সময়ে মেদিনীপুরের ক্ষীরপাই ও তার আশেপাশের অঞ্চলের মানুষদের বর্গীদের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং তাদের পরাজিত করেন একজন ফরাসী জেনারেল এডওয়ার্ড বাবরসা তারপরেই সেখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই জেনারেল কে সম্মান জানাতে স্থানীয় এই মিষ্টান্নের নামকরণ করেন তার নামে আর একটি মত অনুযায়ী দিল্লির এক মোগল সম্রাট বাবরের সম্মানার্থে এই খাওয়ারের নাম দেওয়া হয়. এটি একদম সম্রাটের দরবার পর্যন্ত ও যেতো শোনা যায়। যদিও এর কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, লোক মুখে প্রচারিত।

Babarsa



কেমন করে যাবেন এখানে আসতে হলে সরকপথে যদি আসতে চান তাহলে মেদিনীপুর থেকে কেসপুর চন্দ্রকোনা রোড হয়ে এই ক্ষীরপাই আসা সহজ। ট্রেনে আসতে চাইলে চন্দ্রকোনা রোডে নেমে তারপর গাড়ি করতে হবে। মেদিনীপুর থেকে বাস ও পেয়ে যাবেন এখানে আসার ।

ধন্যবাদ 




Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন