গৌড় আদিনা বাদে মালদার ১০টি জনপ্রিয় জায়গা। Top Ten Tourist attraction of Malda expect Gour & Adina.

 গৌড় আদিনা বাদে মালদার ১০টি জনপ্রিয় জায়গা :- ঐতিহাসিক জেলা মালদা পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে একটি অন্য জায়গা দখল করে আছে। মালদা জেলার গৌড় এবং পান্ডুয়া প্রাচীন কাল থেকে সুলতানী আমল পর্যন্ত বাংলার রাজধানী ছিল। একদম বলতে গেলে গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের আমল থেকে পাল সেন যুগ হয়ে মধ্যযুগে ইলিয়াসশাহী এবং হুসেনশাহী  শাসনে এই জেলা ছিল গোটা বাংলার রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে। তাই গোটা মালদা জুড়েই এরকম বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।


ভ্রমণের দিক থেকে বাঙালিদের কাছে মালদা মানেই দুটো নাম সবার আগে উঠে আসে এক তো গৌড় এবং দ্বিতীয় আদিনা। এই দুই এলাকায় প্রচুর প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন যেগুলো ASI এবং রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের তত্ত্বাবধানে আছে, যেগুলো দেখার জন্য আমাদের রাজ্য ছাড়াও, দেশ এবং দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর ভ্রমণ পিপাসু পর্যটক এসে থাকে। বেশিরভাগ পর্যটকরাই যে গৌড় এবং আদিনা টার্গেট করে আসে এবং ঘুরে, এরকম খুব কমই বাইরের পর্যটক থাকে যারা এই দুটি জায়গা বাদে জেলার অন্য অন্য জায়গা গুলোতে ভ্রমনে যায়। এটা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে. গৌড় এবং আদিনাই মালদা জেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং পছন্দের পর্যটনস্থল, কারণ এরকম ঐতিহাসিক নিদর্শন আমাদের রাজ্যের বাকি জেলায় খুব কমই দেখতে পাবেন।

কিন্তু মালদা জেলায় গৌড় আদিনা বাদেও এরকম আরো দারুণ দারুণ জায়গা আছে যেগুলো বাইরের পর্যটক কেনো এই জেলা বা পার্শ্ববর্তী জেলার মানুষের কাছেও অজানা থেকে গেছে, তাই এই ব্লগে আমি গৌড় আদিনা বাদে মালদা জেলার সেরা ১০টি জায়গা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। পর্যটকদের কাছে এই জায়গাগুলো অজানা থাকার প্রধান কারণই হল, জায়গা গুলো নিয়ে প্রচার ও লেখালেখি খুব কম, সেই কারণেই আমার এই লেখাটি, যাতে আপনাদের কিছুটা হলেও হেল্প হতে পারে। যদিও এখন ফেসবুক কল্যাণের অনেক জায়গা সমন্ধে আমরা জেনে যায় কিন্তু সম্পূর্ন তথ্য সহকারে লেখা আপনারা হয়তো পাবেন না, কিন্তু এই লেখায় সম্পূর্ণ তথ্য, সেই জায়গায় ইতিহাস এবং কোথায় এবং কেমন করে সেই সব জায়গা গুলিতে পৌঁছোবেন সেটা বিস্তারিত ভাবে পেয়ে যাবেন। তাই অনুরোধ থাকছে লেখাটি পুরো পড়বার, গৌড়, আদিনাতে তো অনেকেই অনেকবার গিয়েছেন, চলুন তাহলে অজানা, এবং সবার অগোচরে থাকা এই জায়গা গুলো থেকেও আমরা এবার ঘুরে আসি, এবং বাকি সবাই কেও আমরা উৎসাহিত করি এখানে আসার জন্য। 

ভাটরা বিল এবং যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল :- স্যোসাল মিডিয়ার ক্ষমতা কতটা বেশি, তা এই ভাটরা বিলকে দেখে আন্দাজ করা যায়। কয়েকবছর আগে যে যাওয়ার নামটা হাতে গোনা কয়েকজন জানতো, তা আজ স্যোসাল মিডিয়ার কল্যাণে এত জনপ্রিয় হয়েছে যে, এখন সেখানে বিকেল হলেই মেলা বসে যায়, আর ছুটির দিন গুলোতে তো তিল ধারণের জায়গা থাকে না।

যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল।

মালদা জেলার দুটি বিল একটি ভাটরা এবং যাত্রাডাঙ্গা নিয়ে এখন আলোচনা করবো। এই বিলকেই অনেকেই একই বিল মনে করেন, কিন্তু দুটি বিল একদমই আলাদা, এবং অবস্থান খুব একটা পাশাপাশি ও না। এই দুটি বিলের মধ্যে একটি মিল আছে সেটা হল, দুটি বিলই একই দিকে অবস্থিত এবং বর্ষার সময়ে টাঙ্গন নদীর জলে পুষ্ঠ। বছরের অন্য সময়ে এই বিল গুলি আকারে খুবই ছোটো থাকে, এবং বেশিরভাগ এলাকায় কৃষিকাজ করা হয়। কিন্তু বর্ষাকালে পার্শ্ববর্তী টাঙ্গনের জলে এই এলাকা ফুলে ফেঁপে ওঠে, তখন এই এলাকায় মাছের ও একটা বিশাল আমদানি হয়। এই এলাকার মানুষের প্রধান জীবিকা কিন্তু মাছশিকার, যারা বিল গুলোর ওপরের বিশেষভাবে নির্ভরশীল। মাছ চাষ ছাড়াও কৃষিকাজ এবং বর্তমানে পর্যটনের দৌলতে অনেকেরই কর্মসংস্থান হচ্ছে।

ভাটরা বিল বেশী জনপ্রিয় হলেও এই যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল কিন্তু ভাটরা থেকে আরো বেশি সুন্দর। কিন্তু খুব লোকই এখানে আসে। আপনি যাত্রাডাঙ্গাতে আসলে দেখতে পাবেন বিলের মাঝ বরাবর পাকা রাস্তা এবং দুপাশ দিয়ে জলরাশি, এর আসলরূপ দেখতে হলে ভরা বর্ষায় এখানে আসতে হবে, খুবই সুন্দর লাগবে আপনাদের দু পাশ বরাবর জল এবং মাঝ দিয়ে আপনি হেঁটে যাচ্ছেন, এটা কিন্তু আপনারা ভাটরা তে পাবেন না।

কেমন করে যাবেন :- ভাটরা বিল যাওয়ার জন্য আপনাদের মালদা বাইপাস হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই হাতের বাঁদিকে দুটি রাস্তা পর পর নেমে গেছে, এই দুটি রাস্তা দিয়েই যাওয়া যায় এখানে। যারা রায়গঞ্জের দিক থেকে আসবেন তাদের হাতের বাঁ দিকে এবং যারা উল্টোদিক থেকে আসবেন তাদের ডানদিকে কয়েক কি.মি যেতে হবে।

আর যারা যাত্রাডাঙ্গা বড়বিল যেতে চান তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যারা যারা রায়গঞ্জ বা বালুরঘাটের দিক থেকে আসবেন তারা গাজোল পেরিয়ে, নারায়ণপুর ওভারব্রিজ পার করেই বিএসএফ ক্যাম্প বাজার মোড় থেকে হাতের বাঁ দিকে যেতে হবে প্রায় ৪ কি.মি ।একইরকম ভাবে যারা মালদা দিক থেকে আসবেন তারা একইরকম ভাবে নারায়ণপুর বিএসএফ ক্যাম্প মোড় থেকে ডান দিকে যেতে হবে, ওখানে যে কাউকে বলবেন রাস্তা দেখিয়ে দেবে, তাছাড়া গুগল ম্যাপ তো আছেই।


মাগুরা স্লুইস গেট :- মালদা জেলার আরো একটি অজানা এবং সুন্দর জায়গা গুলোর মধ্যে একটি হলো মাগুরা স্লুইস গেট। এই জায়গা গুলো আমাদের রাজ্যে অনেক থাকলেও পুরো গৌড়বঙ্গের এরকম জায়গা খুব কম দেখা যায়। এই জায়গাটি ও স্যোসাল মিডিয়ার মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়েছে, যার ফলে ভ্রমন পিপাসু মানুষের দলে দলে আগমন ঘটছে এখানে। মহানন্দা নদীর পার্শ্ববর্তী রাস্তায় এক স্লুইস গেটটি অবস্থিত। আশেপাশের এলাকার জল এই স্লুইস গেটের মাধ্যমেই মহানন্দা নদীতে গিয়ে মেসে। জায়গাটি কিন্তু বেশ সুন্দর, তার টানেই প্রচুর মানুষ এখানে আসে দেখার জন্য। দেখার পাশাপাশি স্নান, ছবি ভিডিও এগুলো ও চলতে থাকে সমান তালে। কিন্তু গতবছর এক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে যায়, এখানে স্নান করার সময় একজন বা দুজন পর্যটক স্রোতে ভেসে গিয়ে মারা যায়, যার পর থেকে প্রশাসন এখানে নিচে নামা এবং স্নান করার কঠোর ভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখন আপনারা এখানে যেতে পারবেন কিন্তু নিচে নামা একদমই নিষিদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে এই নিষেধাজ্ঞার কতটা এখন পালন হচ্ছে সেটা বলতে পারব না। কিন্তু আমি বলবো অবশ্যই যান, ভালো লাগবে ছবি ও ভাল আসবে কিন্তু সতর্ক থাকবেন, জল বেশি থাকলে নামার দরকার নেই।

কেমন করে যাবেন :- এই মাগুরা স্লুইস গেটটি রতুয়া ২ নং ব্লকের পুখুরিয়া থানার অন্তর্গত। কিন্তু গাজোল থেকে এটি খুবই কাছে, গাজোলের কদুবাড়ি মোড় থেকে এর দুরত্ব মাত্র ১২ কি.মি, রায়গঞ্জ থেকে ৫৮ এবং মালদা থেকে ৪০ কি.মি। গাজোলের কদুবাড়ি মোড় থেকে চাঁচল গামি রাস্তা দিয়ে আলাল ব্রিজ, ব্রিজ ক্রস করে ডানদিকে কিছুটা গেলেই এই জায়গাটি পড়বে। আপনি বাসে কদুবাড়িতে নেমে, ছোটো বড় যেকোনো গাড়ি করে আলালে নেমে ওখান থেকে পায়ে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারবেন।

জগজীবনপুর বুদ্ধবিহার :- মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের বাংলাদেশ বর্ডারের খুব কাছেই একটি ছোট্ট অজানা অচেনা একটি গ্রাম জগজীবনপুর। কয়েকবছর আগেও হয়তো এই গ্রাম নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা ছিলনা। কিন্তু 1987 সালে এই গ্রামের ভাগ্য পাল্টাতে চলেছিলো। গ্রামেরই এক কৃষক চাষের জন্য কোদাল দিয়ে জমি খোরার সময়ে কিছু ধাতব কিছু একটা পেয়েছিলেন, পরবর্তীতে জানা যায় এটি পাল রাজা মহেন্দ্রপালের তাম্রশাসন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক নিদর্শন। তারপর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রচেষ্টায় এখানে তিন ধাপে এখানে খনন কার্য চলে, এবং একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন বেরিয়ে আসে, যাকে জগজীবনপুর মহাবিহার হিসেবে ডাকা হলেও এর নাম নন্দদির্ঘীকা উদ্রঙ্গ মহাবিহার, এই বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে পাল আমলের ও রাজ বংশের অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়।

বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে এখানে সংস্কার কার্য চলছে, কাজ অনেকটাই শেষের পথে, একটা মিউজিয়াম মত এখানে করা হয়েছে, যেখান সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা অনেক প্রত্নতত্ত্ব সামগ্রী আপনাদের অপেক্ষায় বসে আছে, তাই আমি বলবো অবশ্যই এখানে একবার হলেও আসুন ভারতের প্রাচীন ইতিহাসকে কাছ থেকে উপভোগ করুন, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আপনাদের জন্য ডালি সাজিয়ে বসে আছে। আর জগজীবনপুর মহাবিহার সমন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলে সমস্ত কিছু আমার এই ভিডিও তে বলা আছে এক ক্লিকেই দেখে নিতে পারেন নিচে লিঙ্ক থাকলো।

বাংলাদেশের কাছে টাঙ্গন ও মহানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল : - মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের বুলবুলচন্ডী আইহো নামক স্থানে আসলে আপনি এক অদ্ভূত জিনিস দেখতে পাবেন, মহানন্দা ও টাঙ্গন নদীর সঙ্গমস্থল এবং পাশেই অবস্থিত বাংলাদেশ বর্ডার। মহানন্দা নদীর ওপাশেই বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা, মানে আপনি এতকাছ থেকে বাংলাদেশ খুবই কম জায়গায় দেখতে পাবেন, দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি বর্ডারে খুব কাছ থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। এখানে দু দিকে ইন্ডিয়া এবং একদিকে বাংলাদেশ জায়গাটিও খুব নির্জন নিরিবিলি এবং সুন্দরও। অনেকটা সময় এখানে কাটাতে পারবেন, এখান থেকে দাঁড়িয়েই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের কৃষকরা কাজ করছে। এরকম জায়গা যদি পছন্দ করেন তাহলে একবার হলেও এখান থেকে ঘুরে যাবেন।

কেমন করে যাবেন :- আপনাকে ওল্ড মালদার শাহাপুর মোড় থেকে বুলবুলচন্ডীর রাস্তা ধরতে হবে, তাছাড়া মালদা বাইপাস হয়েও এই রাস্তা আসা যায়। বুলবুলচন্ডী পার করে টাঙ্গন ব্রিজ ক্রস করলেই পৌঁছে যাবেন আইহো তে, এই আইহো মোড় থেকে ডান দিকে কিছুদূর গেলেই এই জায়গাটি পেয়ে যাবেন, যে কাউকে বললেই বলে দেবে এই জায়গাটির কথা। যদিও এখানে অনেকগুলো বর্ডার পোস্ট আছে কিন্তু এই জায়গার বর্ডারটি বেশ আকর্ষণীয়, সেই জন্য এই জায়গাটির কথা আমাদের সাজেস্ট করলাম। এখানে বাইক নিয়েও আসতে পারেন অথবা বাসে ও আসতে পারেন বাইক নিয়ে আসলে একটু সুবিধা। বাসে আসলে নালাগোলা যাওয়ার যেকোনো বাসে আপনাকে আইহোতে নেমে বাকি অংশের জন্য হেঁটে বা টোটো করতে হতে পারে।

সিঙ্গাবাদ ভারতের প্রথম ও শেষ স্টেশন : - মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকেরই আরো একটি জায়গা, আদতেও এটা কোনো পর্যটনস্থল না, কিন্তু জায়গাটির একটি আলাদা বিশেষত্ব Historical Importance থাকার জন্য এখানে আপনার একবার ভিজিট করা উচিৎ। জায়গাটি হল একটি প্রান্তিক স্টেশন একদম একদম বাংলাদেশ বর্ডার এলাকায়। এটি একাধারে দেশের লাস্ট এবং ফাস্ট স্টেশন।

Singhabad Station. 

আগে পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল এই রেল স্টেশন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় নেতাজি থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামী এই লাইন হয়েই পূর্ববঙ্গে গিয়েছিলেন। মালদা টাউন স্টেশন তৈরি হওয়ার পূর্বে ওল্ড মালদা স্টেশন থেকে সিঙ্গাবাদ হয়েই ট্রেন ছুটটো পূর্ববঙ্গে। দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পর এটি ভারতের অন্তিম স্টেশন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আবার বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসলে প্রথম স্টেশন পড়বে এটিই। এই ফাস্ট এবং লাস্ট স্টেশন কথাটি স্টেশন বোর্ডে জলজল করছে, সেটা দেখতে পাবেন, যদিও এরকম স্টেশন ভারতে অনেকই আছে। বর্ডারের ওপারেই আছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুর স্টেশন। এখন বর্তমানে একটিমাত্র ট্রেন তাও আবার মালগাড়ি দু দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। তাই স্টেশনটি শুনশান ও জনমানব শূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে।

কেমন করে যাবেন :- এখানে আসার সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম হল বাইক বা নিজস্ব কোনো গাড়ি। তাছাড়া এখানে পৌঁছনো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বুলবুলচন্ডী পর্যন্ত রাস্তা খুবই ভালো এরপর থেকেই রাস্তা একদমই খারাপ। এখানে আসতে হলে আপনাকে ওল্ড মালদার সাহাপুর মোড় বা ডিস্কো মোড় থেকে নালাগোলা গামি রাস্তা হয়ে সোজা যেতে হবে আইহো তে। আপনি মালদা বাইপাস থেকেও এই রাস্তায় চলে আসতে পারবেন। আইহো মোড় থেকে হাতের ডানদিকে একদম এক রাস্তা যা পৌঁছে দেবে বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া সিঙ্গাবাদ, বর্ডার থেকে ৫০০ মিটার আগেই এই স্টেশন। সিঙ্গাবাদ এর ওপরে করা আমার লেখা এই ব্লগটি পড়ে নিতে পারেন এখানে বিস্তারিত ভাবে সমস্ত কিছু বলা আছে -

মানিকচক-রাজমহল গঙ্গাঘাট ও মানিকচক ভূতনী ব্রিজ :- মালদা জেলার মানিকচক। এই এলাকা গঙ্গা এবং ফুলহার নদী দ্বারা বন্যা এবং ভাঙনপ্রবন এলাকা। এখানে অবস্থিত গঙ্গাঘাট, যা অন্য ঘাটগুলি থেকে একটু হলেও আলাদা। আর সাথে সাথে এখানেই আছে পশ্চিমবঙ্গের তৃতীয় দীর্ঘতম সেটা ভূতনী ব্রিজ। যা যোগাযোগ স্থাপন করেছে ভূতনীর চরের, যা অবস্থিত ফুলহার নদীর ওপরে। এই ভূতনী চরটি ভারতের বৃহত্তম নদীদ্বীপ গুলোর মধ্যে একটি।

Rajmahal Ghat, Manikchak. 

মানিকচকের এই ফেরিঘাট অন্য অন্য ঘাট গুলো থেকে কেনো আলাদা, তার কারণ হলো, ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরি হওয়ার পূর্বে এই ঘাটই ছিল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম। নদী ঘাটের ওপারেই আছে ঝাড়খণ্ডের রাজমহল শহর, গঙ্গানদী এখানে বিশাল, নদী পার করে ওপারে যেতে আপনার প্রায় ১ ঘন্টা সময় লেগে যাবে। ফারাক্কা ব্যারাজ তৈরি হওয়ার পূর্বে এই ঘাট থেকে বাস, লরি, বিভিন্ন ছোটো বড় যানবাহন, বড় বড় ফেরিগুলো করেই ওপারে পৌঁছোতো তারপর সড়কপথে দক্ষিণবঙ্গে যেতো। এখনো এখানে আসলে এইসব বড় বড় ফেরিগুলো দেখতে পাবেন যাদের মাধ্যমে এখনো আগের মত যোগাযোগ ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে আসছে।

মানিকচকের ভূতনীর চর অবস্থিত গঙ্গা এবং ফুলহার নদীর মধ্যবর্তী অংশে, এখানেই গঙ্গা এবং ফুলহার নদীর সঙ্গম হয়েছে। ভূতনী একটা বিশাল এলাকা, লোক সংখ্যা প্রায় লাখখানেক, এতো বড় এলাকা হওয়ার সত্ত্বেও মুল ভূখন্ডের সঙ্গে যোগাযোগকারি কোনো ব্রিজ ছিল না, বছরের অন্য সময়ে যাতায়াত করা গেলেও বর্ষাকালে অবস্থা খুবই সঙ্গিন হয়ে উঠতো। ফুলহার নদী বিসাল আকার ধারণ করতো। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার ৭০ বছর পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ব্রিজের উদ্বোধন করেন, বিশাল লম্বা এই ব্রিজটি খুলে যাওয়ায় এলাকার লোকেদের খুবই সুফল হয়েছে।

চাঁচল রাজবাড়ি : - মালদা জেলায় যদি রাজবাড়ি বা জমিদার বাড়ির সংখ্যা কম। তার মধ্যেই সবচেয়ে সুন্দর আকর্ষণীয় রাজবাড়ি যদি বলতে চান তবে সেটা চাঁচলের রাজবাড়ি।বর্তমানে রাজা না থাকলেও প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো এই রাজবাড়ি এখনো মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে, এতো পুরোনো হওয়া সত্বেও এর ভব্যতা কোনো অংশে কমেনি। চাঁচল রাজবাড়িটি তৈরি হয়ে রাজা শরচ্চন্দ্র রায় চৌধুরীর আমলে। তিনি সেই সময় এই রাজবাড়িটি তৈরি করার দায়িত্ব দেন ব্রিটিশ সংস্থা মার্টিন ও বার্ণ কোম্পানিকে। সেইসময় এই কোম্পানিটি আমাদের দেশে বেশ কিছু প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তার মধ্যে কিছু রাজবাড়িও ছিল। মার্টিন ও বার্ণ কোম্পানি ব্রিটিশ এবং দেশীয় শিল্পের মেলবন্ধনে এই রাজবাড়িটি র তৈরি করেন।

Chanchal Rajbari. 

এই রাজবাড়িটির পরিচালন ভার বর্তমানে রাজ্য সরকারের আন্ডারে। সরকারের নির্দেশ অনুসারে রাজবাড়ি ট্রাস্টি বোর্ড এখন এই রাজবাড়ির সমস্ত কিছু পরিচালন করে থাকে। এই রাজবাড়ি বর্তমানে বেশ কিছু ভাগে বিভক্ত। একটা অংশে চাঁচল সিদ্ধেশ্বরী ইন্সটিটিউট বা হাইস্কুল এবং প্রাইমারী স্কুল অবস্থিত। একটি অংশ চাঁচল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং নবতম সংযোজন হয়েছে চাঁচল কোর্ট যা এই রাজবাড়ির একটি অংশেই গড়ে তোলা হয়েছে। একটি অংশ এখনো সর্বসাধারনের জন্য ওপেন আছে সেটা হল রাজবাড়ির ঠাকুরদালান, এখানে এখনো নিত্য পূজা হয়ে আসছে। দুর্গা পূজা খুব সুন্দর ভাবে এখানে উদযাপিত হয় কিন্তু সেই আগের জৌলুস অনেকটাই ফিকে।

কেমন করে যাবেন :- চাঁচল রাজবাড়ি পৌঁছনো একদমই সহজ। তার আগে আপনাকে চাঁচল পৌঁছতে হবে। যারা মালদা বা বালুরঘাটের দিক থেকে আসবেন তারা গাজোলের কঁদুবাড়ি মোড় থেকে বাঁ দিকে সোজা যেতে হবে এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ৩৩ কি.মি আর যারা রায়গঞ্জ থেকে আসবেন তারা ইটাহার চৌরাস্তা থেকে চূড়ামন হয়ে চাঁচল পৌঁছে যেতে পারেন। চাঁচলের একদমই রাস্তার পাশে এই রাজবাড়ি রাস্তা থেকেই দেখতে পাবেন, আর এখানে যদি আসার প্ল্যান করে থাকেন তাহলে অবশ্যই চেষ্টা করবেন দুর্গাপূজার সময়ে এখানে আসার।

সাগরদিঘি :- মালদার সাদুল্লাপুরে অবস্থিত সাগরদিঘী বা সাগরদিঘী ইকোপার্ক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি প্রকল্প, যা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষের তৈরি বৃহত্তম মৎস্য চাষ ও প্রজনন কেন্দ্র। বর্তমানে এটিকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ইকোপার্ক হিসেবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, যাতে একদিকে মৎস প্রজনন কেন্দ্র এবং পর্যটনের বিকাশ একসাথে করা যায়। মালদা শহরের খুব কাছেই অবস্থিত এই নিরিবিলি এই জায়গাটা, একবারে হলেও অবশ্যই ঘুরে যেতে পারেন এখান থেকে টিকিট মাত্র ৫টাকা।

এই সাগরদিঘীর সাথে জড়িয়ে আছে সেন বংশের নাম, সেন রাজা লক্ষণ সেনের আমলে এই দিঘি প্রথম খনন করা হয়। পরবর্তীকালে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে আরো কিছু দিঘী পাশে খনন করা হয়। বর্তমানে এখানে সর্বমোট ২৩টি পুকুর আছে যেখানে মাছ চাষ হচ্ছে। এখানে আসলে দেখতে পাবেন প্রতিটি পুকুরেই একটা আলাদা নাম আছে, সেই নামগুলো কোনো না কোনো এক নদীর নামে এই নামকরণ টা আমার কাছে খুব আকর্ষনীয় লেগেছে। এক বিশাল এলাকা নিয়ে এই সাগরদিঘী গঠিত। যেখানে একসাথে পুকুর গুলি ছাড়াও দেখতে পাবেন কর্মচারীদের থাকার জন্য অনেকগুলো কোয়াটার এবং পর্যটকদের বিনোদন এবং বসে রেস্ট নেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা।

কেমন করে যাবেন :- সাগরদিঘী বা বড় সাগরদিঘী বা ইকো ট্যুরিজম পার্ক বিভিন্ন নামে পরিচিত এই জায়গা ইংরেজবাজার পঞ্চায়েত সমিতির সাদুল্লাপুরে অবস্থিত। এটি পরিচালনা ও ইংরেজবাজার পঞ্চায়েত সমিতিরই করছে। মালদা শহর থেকে এই যাওয়ার দুরত্ব মোটামোটি ৫ কি.মি মতো । মালদা বাইপাস মোড় বা বাঁধাপুকুর ডান দিকে সাদুল্লাপুর রোড হয়ে প্রায় ৩ কি.মি গেলে এই সাগরদিঘী পড়বে, রাস্তার একদম পাশেই, আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন লকডাউন প্রায় বন্ধ মত ছিল, তাই টিকিট ছাড়াই আমরা ভিতরে ঢুকতে পেরেছিলাম এখন হয়তো ওপেন হয়ে গেছে টিকিট মুল্য ৫ টাকা।

প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার :- ইংলিশবাজার শহরের একদম কাছে এই প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার টি অবস্থিত। ইংলিশ বাজার শহরের খুব কাছে হওয়া সত্বেও কিন্তু এই প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ারটি সম্পর্কে অনেককেই অজানা থেকে গেছে। যেটির অবস্থান মালদার নিমাইসরাই ঘাট এলাকায় একদম মহানন্দা এবং কালিন্দী নদীর সঙ্গমস্থলে। নদীর ওপারেই আছে ওল্ড মালদার মঙ্গলবাড়ি।


Ancient Watch tower. 

যদিও এই প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার টির ইতিহাস সমন্ধে আমরা বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। তা সত্বেও বলা যেতে পারে যেহেতু এটি দুটি নদীর পাশে গড়ে তোলা হয়েছিলো সেহেতু এটি শত্রুর আক্রমণের পূর্বাভাস এবং পাহাড়ার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল, অনেকটা সমুদ্রের পাশে যেমন লাইট হাউস তৈরি করা হয়। এর প্রতিষ্ঠা সময় সম্পর্কে কোথাও কোনো কিছুই আমরা পাই নি, সেখানে পাহারারত রক্ষীরাও এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারলেন না। এতদিন এই জায়গাটি অবহেলায় পড়ে ছিল, বেশ কিছু বছর ধরে Archeological দফতর থেকে এখানে চারদিকে ঘিরে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে। এর ইতিহাস না জানা গেলেও এখানে ঘুরতে আসার পক্ষে আদর্শ। ওপরে ওঠার পর পুরো প্রায় ইংরেজবাজার শহরকেই দেখা যায়, পাশে মহানন্দা এবং কালিন্দী, ওপারে ওল্ড মালদা শহরকেও পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

কেমন করে যাবেন :- যারা মালদা বা মালদার দিক থেকে আসবেন, তারা মালদা স্টেশনের পাশে দিয়ে রাস্তা বরাবর প্রায় ৩ কি.মি যাওয়ার পর নিমাইসরাই বাজার থেকে ডান দিকে কিছুদূর গেলেই এই নিমাইসরাই ঘাটটি পড়বে, পাশেই অবস্থিত এই টাওয়ারটি। আর যারা রায়গঞ্জ বা বালুরঘাটের দিক থেকে আসবেন তাদের মঙ্গল বাড়ি থেকে নদী ঘাট পেরিয়ে এখানে চলে আসতে পারেন, অথবা ৪২০ মোড় থেকে থেকে একটু ঘুরে এই নিমাইসরাই ঘাটে চলে আসতে পারেন।

একলাখী সমাধি সৌধ :- মালদার আদিনার ঠিক আগেই একলাখীতে অবস্থিত একটি সমাধি সৌধ যার এক নাম আছে গোলঘর, এটি সমন্ধে কিন্তু অনেককেই অজানা, তার সাথে সাথে এর ইতিহাস। 

Golghar, Eklakhi. 

এই একলাখী সমাধি সৌধ টি তৈরি করান সুলতানী আমলের বাংলার একমাত্র হিন্দু রাজা গণেশ তার ছেলে যদুর জন্যে। এখানে তার ছেলে যদু বা জালালউদ্দিন এবং তার স্ত্রীর সমাধি আছে। রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার, তারপর তিনি নিজ ক্ষমতায় রাজা হয়ে গৌড়ের সিংহাসনে বসেছিলেন। তার ছেলে পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পিতা কে সরিয়ে নিজে ক্ষমতা দখল করেন। রাজা গণেশ এবং তার ছেলে জালালউদ্দিনের পুরো ইতিহাস জানার জন্য আপনারা আমার এই ভিডিও টি দেখতে পারেন...

কেমন করে যাবেন :- এই একলাখী সমাধি সৌধে আসা খুব সহজ, একলাখী এসে মোটামোটি ৩০০ ভেতরে আসতে হবে। অথবা যে কাউকে জিজ্ঞেস করবেন গোলঘর কোথায় আপনাকে দেখিয়ে দেবে। মালদার দিক থেকে গেলে আদিনার ঠিক আগেই এই একলাখী জায়গাটি পড়বে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন