উত্তর পূর্ব ভারত ভ্রমনের ক্ষেত্রে এই বিশেষ জায়গা গুলো যা আপনাদের অবশ্যই যাওয়া উচিৎ। must visited places of North East India.

 ।। উত্তর পূর্ব ভারত ভ্রমনের জনপ্রিয় জায়গা ।।


ভ্রমণ পিপাসু :- ভারতের সাতটি রাজ্য যাদের একত্রে "সেভেন সিস্টারস্" স্টেট বলা হয়ে থাকে, ন উত্তর পূর্ব ভারত বলা হয়ে থাকে, রাজ্য গুলো হল - আসাম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যাল্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং মেঘালয়। স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকে গোটা ভারতের যেভাবে উন্নতি হয়েছে, কিন্তু উত্তর পূর্ব ভারতের এই রাজ্যগুলো সেই তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে থেকেছে, সেই জন্য সরকারী উদাসীনতা অনেকটা দায়ী। কিন্তু উত্তর পূর্ব ভারতের মানুষগুলো কিন্তু খুবই সহজ সরল সাধাসিধে, এর পাশাপাশি এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিক্ষার হারও ভারতের মূল ভূখন্ডের চেয়ে অনেকটাই বেশি।


যেহেতু এই ব্লগের বিষয়বস্তু হল উত্তর পূর্ব ভারতের পর্যটন, সেহেতু এই অঞ্চলে সেরা কয়েকটি পর্যটনস্থল নিয়ে আলোচনা করা যাক। পর্যটনের দিক থেকে আমরা উত্তর পূর্ব ভারতকে চিনিই বা কত টুকু? এমনিতেই উন্নয়নের অভাব, সরকারি উদাসিনতা এগুলো তো এই অঞ্চলের পর্যটনের অনুন্নয়নের জন্য দায়ী, তার সাথে আরো একটি বড় কারণ হল, উত্তর পূর্ব ভারতের সব গুলো রাজ্যই প্রায় স্বাধীনতার পরবর্তীকাল থেকে বহু বছর জঙ্গি কার্যকলাপ বড় মাত্রায় মাথাচাড়া দিয়েছিলো, সেই জঙ্গি তৎপরতা অনেকটা এখন হ্রাস পেলেও মানুষের মধ্যে যে এই এলাকা সমন্ধে একটা ভীতি ছিল, সেটা এখনো থেকে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে এখানকার পর্যটনে। এছাড়াও এখানকার পর্যটন স্থান গুলো নিয়ে সাধারন মানুষের কাছে তেমন কোনো ধারণা নেই এর পেছনেও অনেক কারন আছে। তবে বর্তমানে সরকারি প্রচার এবং স্যোসাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন কিন্তু এই অঞ্চলে পর্যটকদের আনাগোনা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু সেগুলো সীমাবদ্ধ থেকে গেছে বাধা ধরা এবং চেনা পরিচিত কয়েকটি জায়গার মধ্যেই, চিরাচরিত এই জায়গা গুলো বাদেও এই উত্তর পূর্ব ভারতে হিডেন ও কতগুলো জায়গা আছে যেগুলো স্বর্গের থেকে কোন অংশে কম নয়। এই ব্লগে আমি উত্তর পূর্ব ভারতের বাধা ধরা কয়েকটি জায়গা বাদেও একদমই অফবিট কিছু জায়গা নিয়ে আলোচনা করবো, কিছু জায়গার নাম হয়তো আপনারা শোনেননি, এই ব্লগে সেই জায়গা গুলো সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য থাকবে খুবই বিস্তারিত ভাবে, চলুন তাহলে এক এক করে জেনে নেই এই জায়গা গুলো সম্বন্ধে...

১. তাওয়াং - অরুণাচল প্রদেশ :- ভারতের পূর্ব দিকে প্রথম রাজ্য হলো এই অরুণাচল প্রদেশ, যে কারণে দেশের মধ্যে সর্ব প্রথম সূর্যদোয়ের সৌভাগ্য অর্জন করে এই রাজ্য। অরুণাচল প্রদেশ নাম হওয়ার পূর্বে এই রাজ্যকে বলা হতো NEFA (নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি। তিন দিক থেকে তিন দেশের ভৌগলিক আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বেস্তিত এই রাজ্য ভৌগোলিক এবং সামরিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশের কাছে। ১৯৬২ ভারত-চীন যুদ্ধ অনেকটা সংঘটিত হয়েছিলো এই অরুণাচল প্রদেশে। সেই কারণে রাজ্যে প্রবেশের পর থেকেই প্রচুর আর্মি ক্যাম্প এবং প্রবেশে ও আর্মির অনুমতি প্রয়োজন। এই অরুণাচল প্রদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হল এই তাওয়াং। চীনা সীমান্তে অবস্থিত এই তাওয়াং একটি বড় মনাস্ট্রি ও আছে, তিব্বতী ধর্মগুরু দলাই লামা তিব্বত থেকে পালিয়ে সর্ব প্রথম এই তাওয়াং মনাস্ট্রিতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই কারণেও এই মনাস্ট্রিটি এত গুরুত্বপূর্ণ।

Tawang Monastery

প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো এই মনাস্ট্রি তৈরি হয়েছে ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। তাওয়াং আপনারা অরুণাচল প্রদেশ ট্যুরের সাথে ঘুরে নিতে পারবেন। গৌহাটি থেকে প্রথম দিন ভালুকপঙ বা নামেরি, দ্বিতীয় দিন দিরাং এবং তৃতীয় দিন দিরাং থেকে তাওয়াং, এই ভাবে তাওয়াং কে কেন্দ্র করে অরুণাচল প্রদেশের পূর্ব পাস টা ঘুরে নিতে আপনাদের ৭-৮ দিন লেগে যাবে।

কেমন করে যাবেন - গৌহাটি পর্যন্ত ফ্লাইট বা ট্রেনে এসে, আপনাকে বাকি পথ গাড়ি অথবা বাসে যেতে হবে। ভালুকপঙ থেকে আপনাকে গাড়ি ভাড়া করতেই হবে বাসের অপশন নেই। এছাড়া অরুণাচলে প্রবেশের জন্য ILP পারমিট করতে হবে, যা আপনারা অনলাইন বা আধার কার্ড দিয়ে অফলাইনে তেজপুর বা ভালুকপঙ থেকে ড্রাইভারের সাহায্যে করে ফেলতে পারেন। এই ট্যুরে গাড়ি ভাড়ার জন্যই সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। বিস্তারিত অন্য ব্লগে নিশ্চয়ই আলোচনা করবো।

অটল ব্রিজ এবং ভুপেন হাজারিকা ব্রিজ :- ভারতের আসাম রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে অরুণাচল বর্ডারের একদম কাছেই অবস্থিত ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং এবং নিজস্ব প্রযুক্তির দুই অসাধারণ কীর্তি, যেগুলো হলো অটল ব্রিজ যার আরেক নাম বগিবিল সেতু এবং ভুপেন হাজারিকা সেতু। এই ব্রিজ দুটি খুব পাশাপাশি অবস্থিত তাই একই পয়েন্টে আলোচনা করছি, যাতে আপনারা একই দিনে এই ব্রিজ দুটি একবারে দেখে আসতে পারেন।

Bogibeel Bridge - Atal Bridge 

প্রথমে আসি বগীবিল সেতু নিয়ে যার এখন বর্তমান নাম অটল ব্রিজ। আসামের ধেমাজী জেলার একটি জায়গা বগীবিল থেকেই এর নাম বগীবিল পড়েছে। এই ব্রিজ এশিয়ার দ্বিতীয় দীর্ঘতম রেল এবং রোড ব্রিজ, এবং ভারতের পঞ্চম দীর্ঘতম ব্রিজ। আসামের ব্রহ্মপুত্র নদীর ওপরে এই ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে, যা আসামের দুই জেলা ধেমাজী এবং ডিব্রুগড়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কি.মি। ভারতীয় কোম্পানি HCC এই ব্রিজের নির্মাণ কাজের দায়িত্বে ছিল।

আপনি ট্রেনে বা বাইরোড দুভাবেই এই ব্রিজ দেখতে আসতে পারবেন। ট্রেন আসতে চাইলে ডিব্রুগড় বা তিনসুকিয়ার যেকোনো ট্রেন ধরলে আপনাকে এই ব্রিজ হয়েই নিয়ে যাবে, তখন দীর্ঘ এই ব্রিজকে আপনারা রেল থেকে উপভোগ করতে পারবেন, নিচে বিশাল ব্রহ্মপুত্রকে দেখতে পাবেন। আপনারা যদি গাড়ি ভাড়া করে এখানে আসেন তাহলে ব্রিজে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় এখানে কাটাতে পারবেন, অথবা ধেমাজী বা ডিব্রুগড় পর্যন্ত এসে সেখান থেকে এই ব্রিজ ঘুরে নিতে পারবেন। বাংলাদেশের নবনির্মিত পদ্মা সেতুর ডিজাইন ও অনেকটা এই ব্রিজের আদলেই তৈরি।

অটল সেতু থেকে প্রায় ১২৬ কি.মি উত্তরে অরুণাচল প্রদেশের বর্ডারের কিছু আগেই আসামের তিনসুকিয়া জেলায় ব্রহ্মপুত্রের বৃহত্তম উপনদী লোহিতের ওপরে নির্মিত এই ব্রিজের নাম হলো ধোলা - সাদিয়া ব্রিজ যা দেশের মধ্যে বর্তমানে দীর্ঘতম ব্রিজ, এই ব্রিজের দৈর্ঘ্য হল ৯.১৫ কি.মি। এই ব্রিজের বর্তমান নাম হলো ভূপেন হাজারিকা ব্রিজ।

আসামের তিনসুকিয়া জেলায় অবস্থিত এই ব্রিজের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০০৯ সালে, এবং ২০১১ সাল থেকে এর নির্মাণ কার্য শুরু হলে ২০১৭ তে এসে কাজ সমাপ্ত হয়। আসামের ধোলাকে সাদিয়ার সাথে এই ব্রিজ যুক্ত করলেও চিনের বর্ডারের খুব কাছে অবস্থিত হওয়ার জন্য ব্রিজ ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্রিজ নির্মাণ হওয়ার ফলে পূর্ব অরুণাচল প্রদেশে পৌঁছতে সময় অনেকটাই কমে গিয়েছে। আপনি বাইরোড বা ট্রেনে তিনসুকিয়া পর্যন্ত এসে তিনসুকিয়া থেকে এই ব্রিজ দেখে ফেলতে পারেন, ভারতীয় প্রযুক্তিবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং কতটা এগিয়ে গিয়েছে সেটা এই ব্রিজ দুটি দেখলেই স্পষ্ট বুঝে যাবেন।

৩. চেরাপুঞ্জি-মেঘালয় :- এবার আসি উত্তর পূর্ব ভারতের আরো একটি ছোট এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর খুবই সুন্দর একটি রাজ্যে, যার নাম মেঘালয় বা মেঘের দেশে। যেই রাজ্যের অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে এই পর্যটনের ওপরে। এই রাজ্যকে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড ও বলা হয়ে থাকে। নর্থ ইস্টের মধ্যে এই মেঘালয় রাজ্যেই পর্যটকদের কাছে খুবই পরিচিত এবং বাইরের পর্যটকদের আসার পরিমাণ সবচেয়ে বেশী এই রাজ্যে। এর পেছনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে এই মেঘালয়ের সরকার এবং সাধারণ জনগণ। গারো, খাসি এবং জয়ন্তীয়া এই তিনটি প্রধান পাহাড় নিয়ে মেঘালয় রাজ্য গঠিত। মেঘালয়ের রাজধানী শিলং কে সবাই এক ডাকে চিনলেও এখানকার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হলো চেরাপুঞ্জির। এই চেরাপুঞ্জি ভারতের সবচেয়ে আদ্র জায়গা, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে এই চেরাপুঞ্জিতেই।


চেরাপুঞ্জি আপনি আলাদা করে না এসে একবারে মেঘালয় বা শিলং ঘোরার সাথে সাথেই চেরাপুঞ্জিটাও একবারে ঘুরে নিতে পারেন, প্রকৃতি মেঘালয়কে যদি আপনি সামনে থেকে অনুভব করতে চান তাহলে আপনাকে এই চেরাপুঞ্জিতেই আসতে হবে। পুরো চেরাপুঞ্জি ভালো ভাবে ঘুরতে মোটামোটি দুরাত এবং এবং পুরো মেঘালয় ভালো ভাবে ঘুরতে মোটামোটি ৫ দিন যথেষ্ট। চেরাপুঞ্জি প্রধানত বিখ্যাত তার সুন্দর সুন্দর ঝর্ণা গুলোর তার পাশাপাশি আরো কিছু জায়গা আছে যেগুলো আমি নিচে সংক্ষেপে উল্লেখ করে দিচ্ছি -

১. ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ।

২. নোয়াখালিকাই ফলস্ ।

৩. মাওসমাই কেভ (Mawsmai Cave)

৪. দেইন্থলেন ফলস্ ( Dainthlen falls)

৫. মৌসিনরাম ভিলেজ ।

৬. ওয়াকাবা ফলস্ ।

৭. মাওলিনলং ভিলেজ ( Mawlynlong Village)

আপনারা শিলং থেকে একটা গাড়ি রিজার্ভ করে সাইটসিং জায়গা গুলো ছাড়াও আশেপাশের আরো কিছু এলাকা আপনারা দুদিনে ঘুরে ফেলতে পারেন। ওপরের জায়গা গুলো ছাড়াও আরো এরকম অনেক জায়গা আছে এই চেরাপুঞ্জির আসে পাশে ঘুরে ফেলার জন্য।

৪. মাজুলী দ্বীপ - আসাম :- আমরা ভূগোল বইতে হয়তো সকলেই পড়ে এসেছি যে পৃথিবীর বৃহত্তম নদীদ্বীপ - মাজুলী সম্পর্কে যেটি আসামের ব্রহ্মপুত্র নদীতে অবস্থিত। যদিও বর্তমানে পৃথিবীর বৃহত্তম নদী দ্বীপ মাজুলী নেই। তবে যাইহোক এই বৃহৎ দ্বীপকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো 2021 জানুয়ারি তে, সত্যি এই দ্বীপের আকার এতটাই বৃহৎ যে এখানে নামার পর আপনার কোনো দিক থেকেই মনে হবে না আপনি একটি দ্বীপে আছেন, কি নেই, বড় গাড়ি থেকে সব কিছুই চলছে। জনসংখ্যাও প্রায় ১ লাখ ৭০ হাজার। এতো বৃহৎ সংখ্যক জনসংখ্যা এই দ্বীপটিতে বসবাস করার জন্য আসাম সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে এই দ্বীপকে আলাদা জেলা হিসেবে ঘোষনা করেছে, ভারতের মধ্যে এটিই একমাত্র দ্বীপ যার স্বতন্ত্র জেলা পরিচয় আছে।



১২৫৫ স্কোয়ার কি.মি বিশিষ্ট এই দ্বীপ ধীরে ধীরে ব্রহ্মপুত্রের গ্রাসে আয়তন হ্রাস পাচ্ছে। এই দ্বীপ একাধারে কয়েকশো বছর ধরে আসামিস সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়ে আসছে। অসমিয়া ধর্মগুরু শঙ্করদেবের সময় কালে এখানে বহু সংখ্যক অসমিয়া বৈষ্ণব সত্র বা নামঘর গড়ে ওঠে, যেগুলো এখনো এখানে আসলে দেখতে পাবেন। সত্র বা নামঘর কথার অর্থ হলো ধর্মীয় মঠ, যেই সত্রগুলো অসমিয়া ধর্মীয় সংস্কৃতিকে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। মাজুলীতে আসলে দেখার মত পর্যটনস্থল গুলিই হল এই সত্র গুলি, যেমন - সামাগুরি সত্র, গড়ামুখ সত্র, কমলাবাড়ি, দক্ষিনপাট, প্রমুখ।

এবার আসি এখানে কেমন করে আসবেন, আপনারা তো আসামের অনেকেই ঘুরতে আসেন কিন্তু কত জুনই বা যান এই মাজুলীতে, সত্যি এইবারে যদি কোনো সময়ে আসাম আসেন তাহলে ঘুরে যেতে পারেন অসমিয়া সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র থেকে, আমি ব্লগের শুরুতেই বলেছিলেন বাধাধরা কয়েকটি জায়গার বাইরে কিছু অজানা, নতুন ধরনের কিছু জায়গার খোঁজ এই ব্লগে দেবো। আপনি যদি মাজুলী আসতে চান তাহলে আপনাকে সর্বপ্রথম জোরহাট আসতে হবে, পূর্বে মাজুলী দ্বীপ এই জোরহাট জেলার অংশ ছিল। জোরহাটের নিমাতি ঘাট থেকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাজুলীর কমলাবাড়ি ঘাটের মধ্যে সব বড় ফেরি চলে। এই কমলাবাড়ি হল মাজুলীর মেন এলাকা, এই কমলাবাড়ি ঘাট ছাড়াও এখানে আরো এক দুটো ঘাট আছে। আপনি চাইলে সকালে গিয়ে ঘুরে আবার বিকেলে ব্যাক করে চলে আসতে পারবেন জোরহাটে। সরকারি ফেরি পরিষেবা খুব কম দামেই পৌঁছে যেতে পারবেন। আমার করা মাজুলীর এই ইউটিউব ভিডিও টি দেখতে পারেন...

৫. লোকটাক লেক এবং কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক :- মণিপুর তথা আমাদের দেশের আরো একটি ইউনিক এবং অফবিট জায়গা যা অনেকের কাছেই এখনো অজানা থেকে গেছে, ভারতে ১০০ ওপরে ন্যাশনাল পার্ক থাকলেও এই কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক মত ন্যাশনাল পার্ক ভারতে একটি আছে। এই কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক হল বিশ্বের একমাত্র ভাসমান ন্যাশনাল পার্ক যা অবস্থিত উত্তর পূর্ব ভারতের বৃহত্তম হ্রদ লোকটাক হ্রদের ওপরে। উত্তরপূর্ব ভারতে এমন কয়েকটি রত্ন লুকিয়ে আছে যেগুলো সম্পর্কে আমাদের একদমই ধারণা নেই, প্রচার পেলে এই জায়গা গুলো নিশ্চয়ই বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

Keibul Lamjao National Park

১৯৬৬ সালে এই এলাকাটিকে Wildlife Sanctuary এবং ১৯৭৭ সালে একে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এই জাতীয় উদ্যানটি সাংগাই ডিয়ারের জন্য প্রধানত বিখ্যাত। 

মণিপুর তথা সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের বৃহত্তম মিষ্টি জলের হ্রদ হল এই লোকটাক লেক। যা সমগ্র মণিপুর রাজ্যের অনেকটা সরবরাহ করে থাকে। এই হ্রদের ওপরে বহু বছর ধরে এক ধরণের উদ্ভিদ বড় হয়ে হয়ে ভাসমান "ফুমডিস" এর সৃষ্টি করেছে। এরকম হাজার হাজার ফুমডিস এই হ্রদের ওপরে তৈরি হয়েছে, যা এই হ্রদের সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে, আপনি এখানে আসলে ভাসমান বিভিন্ন হোমস্টে তৈরি হয়েছে যেগুলোতে আপনারা চাইলে থাকতেও পারেন। এই ফুমডিস গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম ফুমডিসে গড়ে উঠেছে এই কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক।

এই লোকটাক লেক ও কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কের সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর হলো মৈরাং। যা অবস্থিত মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলায় ।ইম্ফল থেকে এই মৈরাং এর দুরত্ব মাত্র ৪৫ টাকা। আপনি যদি বাসে আসতে চান তাহলে অনেক কম খরচে এখানে চলে আসতে পারবেন, এবং শেয়ার গাড়িতে আসলে আরো ভালো হয় আপনি সরাসরি কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্কের একদম গেট পর্যন্ত চলে আসতে পারবেন আরো কম সময়ে।

৬. INA ওয়ার মেমোরিয়াল :- মণিপুরের আরো একটি অদেখা জায়গা যে জায়গাটি ইতিহাসের দিক বাঙালি তথা ভারতবাসির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই জায়গাতেই নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ব্রিটিশদের পরাজিত করে সর্বপ্রথম ভারতের মাটিতে দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।

জায়গাটি হল মৈরাং যেখানে লোকটাক হ্রদটি অবস্থিত। মৈরাং আসলে আপনার একসাথে দুটি জায়গা দেখা হয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেতাজির নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ঘাঁটি গেরেছিলো জাপানি অধিকৃত বার্মাতে। এই বার্মা থেকেই আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের মূল ভূখন্ডে আক্রমণ শুরু করে নেতৃত্বে ছিলেন INA কমান্ডার শওকত মালিক, তার নেতৃত্বেই INA মণিপুরের মৈরাং দখল করে সেখানে ভারতীয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এই মৈরাং এ একটি INA মিউজিয়ামও বর্তমানে গড়ে তোলা হয়েছে। এবং নেতাজির একটি আবক্ষ মূর্তিও গড়ে তোলা হয়েছে। এই মিউজিয়ামের আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যাবহূত বিভিন্ন সামগ্রী এখানে আসলে দেখতে পাবেন। এই মৈরাং আসা খুবই সহজ, রাজধানী ইম্ফল থেকে এর দূরত্ব মাত্র ১ ঘন্টা। এখানে আসতে আপনারা কেইবুল লামজাও ন্যাশনাল পার্ক ও সাথে সাথে দেখে ফেলতে পারবেন।

৭. ইন্ডিয়া-মিয়ানমার বর্ডার - মোরে :- মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে ১১০ কি.মি দূরে অবস্থিত ভারতের সীমান্ত শহর মোরে। কিন্তু আপনি এই মোরে তে কেনোঐ আসবেন। এখানে আসলে আপনি খুব কাছ থেকে মিয়ানমারকে তো দেখতে পাবেনই তার সাথে সাথে বিনা ভিসা ও পাসপোর্টে আপনি একদিনের জন্য মিয়ানমার ঘুরে আসতে পারবেন, শুধু আপনারা দরকার হবে একটি আধার কার্ড। একদিনের জন্য ঘুরে মিয়ানমার বর্ডারের ওপারে অবস্থিত মিয়ানমারের মার্কেট থেকে কেনাকাটা এবং খাওয়া দাওয়া সব কিছুই করে আবার বিকেলের মধ্যে ফিরে আসতে হবে। এই সুবিধা একমাত্র আপনি এই মোরে বর্ডারেই পাবেন ।

মোরে মণিপুর ।

এই বর্ডারে আপনি কেমন করে আসবেন, কি কি প্রসেস আছে, কি কি করণীয়, সমস্ত কিছুর জন্য আমার লেখা এই ব্লগটি পড়ে নিতে পারেন আমি নিচে লিঙ্ক দিয়ে দেবো, খুবই কিন্তু আকর্ষণীয় জায়গা এরকম একটি জায়গায় আসতে কে না চায়, তাহলে দেরি না করে চলে আসুন। লিঙ্ক.....

৯. হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল - নাগাল্যাল্ড :- এমনিতেই উত্তর পূর্ব ভারত সংস্কৃতির দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ। কারণ এই উত্তর পূর্ব ভারতের প্রতিটি রাজ্যেই অনেক ধরণের জনজাতি সম্প্রদায় আছে তাদের ভাষা থেকে খাওয়ার সংস্কৃতি সব কিছুই ভিন্ন। সেরকমই একটি রাজ্য নাগাল্যাল্ড, যেই রাজ্যে ১৬ টি আলাদা ধরনের জনজাতি সম্প্রদায় আছে, তাদের মিলিত একটি অনুষ্ঠান হল এই হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল। যা প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

Hornbill Festival. 

হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল মত এত ইউনিক ফেস্টিভ্যাল ভারতে খুব একটা পাবেন না যার খ্যাতি বর্তমানে দেশ ছাড়িয়ে দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে, বিদেশ থেকেও প্রচুর ট্যুরিস্ট এখন এই ফেস্টিভ্যাল দেখতে নাগাল্যাল্ডে ছুটে আসছে। প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে চলা এই প্রোগ্রামে নাগাল্যাল্ডের বিভিন্ন সম্প্রদায়রা তাদের কালচার, তাদের পোষাক, খাওয়ার, খেলা এবং আরো বিভিন্ন কিছু তুলে ধরে। তার সাথে সাথে তো বিভিন্ন কালচারাল প্রোগ্রাম চলতেই থাকে। এখানে আসতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে ডিসেম্বর মাসের প্রথম উইকে আসতে হবে এবং এখানে আসতে দারুণ একটা অনুভুতি হবে আপনাদের। এবার আসি এখানে আসবেন কেমন করে - এই হর্নবিল ফেস্টিভ্যাল প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় কোহিমা শহরের কাছে অবস্থিত কিসামা ভিলেজে যাকে নাগা হেরিটেজ ভিলেজও বলে, এই গ্রামে আসলে আপনি নাগাল্যাল্ড সমস্ত উপজাতিদের ছোঁয়া পাবেন। আমি যখন গিয়েছিলাম সেই সময়ে ফেস্টিভ্যাল শেষ হয়ে গিয়েছিলো, শুধুমাত্র ভিলেজটি দেখেই চলে আসতে হয়েছিলো। আপনারা আসলে অবশ্যই এই ফেস্টিভ্যালের সময়ে আসবেন। কোহিমা থেকে অনেক শেয়ার গাড়ি চলে এখানে আসার জন্য না পেলে আপনাকে গাড়ি ভাড়া করতে হবে। কোহিমা থেকে এই কিসামা ভিলেজের দূরত্ব মাত্র ১২ কি.মি।

নাগা হেরিটেজ ভিলেজ 

১০. জুকো ভ্যালি - নাগাল্যাল্ড :- আমার মতে উত্তর পূর্ব ভারতের সবচেয়ে সেরা জায়গা যদি বলা যায় তাহলে প্রথমেই আসবে নাগাল্যাল্ডের এই জুকো ভ্যালি। শুধু উত্তর পূর্ব ভারত কেনো, গোটা ভারতে খুঁজলে এরকম পাহাড়ের গঠন ও এরকম ভ্যালি আরো কোথাও পাবেন না। সত্যি অদ্ভূত এই জুকো ভ্যালি স্কটল্যান্ডের পাহাড়ের সাথে এই ভ্যালির অনেকটা মিল আছে। পাহাড়প্রেমী এবং ট্রেকারদের কাছে এই ভ্যালি একদমই স্বর্গ মনে হবে।

Dzokou Valley 

৮০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই ভ্যালি কিন্তু দুটি রাজ্য মণিপুর এবং নাগাল্যাল্ডের বর্ডার শেয়ার করছে তবে নাগাল্যাল্ডেই বেশিরভাগটা পড়ছে। এই জুকো ভ্যালি ট্রেক করার জন্য নাগাল্যাল্ড হয়ে প্রধানত দুটি ট্রেক রুট আছে। একটি বিশ্বেমা ভিলেজ হয়ে এবং একটি জাখামা ভিলেজ হয়ে। কিন্তু এখন মণিপুর হয়েও বেশ কিছু ট্রেক রুট ওপেন হয়েছে। সাধারণ পর্যটকরা বিশ্বেমা ভিলেজ হয়ে গিয়ে জাখামা ভিলেজ হয়ে ফিরে আসে। এই রুটে গেলে গাড়ি আপনাকে বিশ্বেমা ভিলেজ জুকো পয়েন্ট পর্যন্ত ছেড়ে দেবে তারপর আপনাদের ট্রেক রুট শুরু হবে, প্রথম এক ঘন্টার একদম খাড়া রাস্তা, এরপর আপনি ভ্যালিতে পৌঁছোবেন। তারপর আবার ও দু একটা ঘন্টা চলার পর থেকে জুকোর প্রধান ভ্যালিতে প্রবেশ করে যাবেন, আসল সৌন্দর্য শুরু হবে এখন থেকেই। এই ট্রেকে মোটামোটি ৫-৬ ঘন্টা লাগবে, কিন্তু নামার সময়ে, সময় কিছু আপনাদের কম লাগবে।

জুকো আসার ক্ষেত্রে সবার আগে আপনাকে ILP বানাতে হবে। নাগাল্যাল্ডের প্রবেশদ্বার ডিমাপুর থেকে সরাসরি গাড়ি পেয়ে যাবেন, এই বিশ্বেমা ভিলেজ পৌঁছানোর জন্য, সবচেয়ে আদর্শ সময় এখানে আসার হল জুন মাস কারণ এই সময়ে জুকো লিলি বলে একটি ফুল ভ্যালি জুড়ে ফোটে, বেশ সুন্দর লাগে এই সময়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন