উত্তর দিনাজপুর জেলার মারনাই এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। Marnai, Itahar, Uttar Dinajpur, Tourist Places.

 মারনাই উত্তর দিনাজপুর

ভ্রমণ পিপাসু :- উত্তর দিনাজপুর জেলা ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধ এলাকা, কিন্তু এই জেলার ইতিহাস চর্চা খুব কম তাই এই জেলায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান, নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে এই সব জায়গা নিয়ে কোনো ধারনা-ই নেই। উত্তর দিনাজপুরের সেরকমই একটি এলাকা হল ইটাহার ব্লকের মারনাই গ্রাম। এই মারনাই প্রাচীনকালে এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো, এবং একবাক্যে বলা যায় উত্তর দিনাজপুর জেলার ঐতিহাসিক দিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এলাকা।


মারনাই এর অবস্থান উত্তর দিনাজপুর জেলার ইটাহার ব্লকের সুঁই নদীর তীরবর্তী এলাকায়। এই সুঁই নদী একাধারে মহানন্দা নদীর উপনদী এবং শাখা নদী। মারনাই এর ঘৃততলার কাছে এই নদী মহানন্দা নদীতে পতিত হয়েছে। মহানন্দা এবং সুঁই নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ার এখানে প্রচুর শষ্য উৎপাদন হতো। মার-নাই নামটি তারই ইঙ্গিত বহন করে হয়তো। নদীর ওপারেই আছে মালদা জেলা। ঐতিহাসিক এই এলাকা সমন্ধে অনেকেই জানে না, সেই উদ্দেশ্যেই আমার এই লেখা টা। ব্লগটা পুরো পড়ুন, আর ভালো লাগলে অবশ্যই একবারের জন্য হলেও ঘুরে যান এই মারনাই থেকে।

মারনাই কেমন করে পৌঁছোবেন : - আমি আপনাদের আগেই বলেছি মারনাই এর অবস্থান উত্তর দিনাজপুরের ইটাহার ব্লকে। সদর শহর রায়গঞ্জ থেকে এর দূরত্ব ৩৫ কিমি এবং ইটাহার থেকে ১৭ কিমি দূরে। এছাড়া মালদা জেলার গাজোল থেকে এই মারনাই এর দুরত্ব ২০ কি.মি ।

আপনি যদি রায়গঞ্জ থেকে যান তাহলে ইটাহার পার করে চেকপোস্ট থেকে ৭ কিমি আগে মারনাই মোড় থেকে ডান দিকে ৪ কি.মি গেলেই মারনাই । একইরকম ভাবে আপনি যদি মালদার দিক থেকে আসেন তাহলে গাজোল হয়ে ইটাহার চেকপোস্ট পার করে মারনাই মোড় থেকে বাঁ দিকে যেতে হবে। 

মারনাই এর ইতিহাস :- মারনাই ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে যেতে উনবিংশ শতকে একদম চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে। মারনাই গ্রামের জমিদার ব্যবস্থা কিন্তু একরকম অদ্ভূত এবং বিরল, কেনো সেটা আপনি এই পয়েন্ট টা পুরো পড়লেই বুঝে যাবেন। আমরা সকলেই জানি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিসের সময়ে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূচনা হয়। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য দেশের বিভিন্ন বড় বড় জমিদাররা তাদের জমিদারি ভাগ করে দেন ছোটো ছোটো জমিদার ও জোতদারের মধ্যে। সেইরকম ভাবে যেহেতু এই এলাকা তখন দিনাজপুর জমিদারির অংশ ছিল, সেই অনুযায়ী ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে দিনাজপুর মহারাজার কাছ থেকে মারনাই এর তখনকার জমিদার মহেন্দ্রনারায়ণ পাল চৌধুরী এবং জোতদার বিহারীলাল দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বত্বে জমি পান। আপনি কিন্তু একই গ্রামে মধ্যে জমিদার এবং জোতদারের সহাবস্থান খুবই কম দেখতে পাবেন, হয়তো পাবেনই না, গোটা দেশেই যা বিরল ঘটনা, কিন্তু মারনাই ছিল ব্যতিক্রমি একটি গ্রাম, আমি পয়েন্টের শুরুতেই বলেছিলাম যে মারনাই জমিদারি ব্যবস্থা একদমই আলাদা গোটা দেশের ইতিহাসে বিরল।

এই পালচৌধুরী জমিদার বাড়ি এবং জোতদার দে বাড়ি কে কেন্দ্র করেই মারনাই এর ইতিহাস আবর্তিত হয়ে আসছিলো। জমিদার মহেন্দ্রলাল পালচৌধুরী ১৮৯৫ সালে মারনাই জমিদারবাড়ি তৈরি করেন। জোতদার দে দের ও একটা সুন্দর বাড়ির এখনো কিছুটা অবশিষ্ট আছে। এই পরিবার কে নুনিয়া বাড়ি হিসেবে ডাকা হতো কারণ তারা নুনের ব্যাবসা করতেন। নুনের ব্যাবসা করে তারা প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, নুন ছাড়াও তারা কাপড় এবং লোহার ব্যবসার যুক্ত ছিলেন। তাদের উদ্যোগেই মারনাই তে গড়ে উঠেছিলো ভূতেশ্বর জিউ মন্দির, এর দেখা দেখি মারনাই এর জমিদার রাও প্রমথেশ্বর জিউ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন, এর থেকে বোঝাই যাচ্ছে এই দুই পরিবারের মধ্যে একটা রেষারেষি চলছিলো। আবার মারনাই এর শরচ্চন্দ্র হাইস্কুলের সাথে এই দুটি পরিবারই যুক্ত ছিলেন।

মারনাই জমিদারবাড়ি :- মহেন্দ্রনারায়ণ পাল চৌধুরী উদ্যোগে ১৩০১ বঙ্গাব্দে এবং ইংরেজির 1895 সালে মারনাই জমিদারবাড়ির পত্তন হয়। তার মধ্যস্থলে ছোটো একটি উঠোন রেখে চারপাশ ঘর গড়ে তোলা হয়। উত্তর, দক্ষিণ, এবং পূর্বদিকে দুইতলা এবং পূর্ব দিকে একতলা ঘর নির্মাণ করা হয়। এই বাড়ির পূর্বদিকে সুধা নামে একটি পুকুর,ও খনন করা হয়, তার ঘাট ও সুন্দর ভাবে বাঁধানো হয়। বাড়ির দোতলা থেকে এই সুধার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতেন, এই কারণের বাড়ির পূর্ব দিকটি একতলা করা হয়েছিলো। 

মারনাই জমিদারবাড়ি।

এই বাড়িটিতে সর্বমোট ২৯টি ঘর ছিল, আর ভূগর্ভস্থও একটি ঘর ছিল, যেখানে জমিদার বাড়ির মূল্যবান সম্পদ রাখা থাকতো। এই বাড়ির পশ্চিমদিকে একটি ঠাকুর দালান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো যেখানে জমিদারি আমলে প্রত্যহ লক্ষ্মীনারায়নের পুজো হতো।

কাছারীবাড়ি :- জমিদারবাড়ি দক্ষিণদিকে একটি কাছারিবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছিলো। এটি জমিদারবাড়িই কাছারীবাড়ি ছিলো। আমরা গিয়ে যা দেখলাম এখনো এই কাছারী বাড়ির কিছু অংশে লোক বসবাস করছে, বাকি অংশ এখন থাকার অনুপযুক্ত। এই কাছারিবাড়িতে বছরের শেষে হালখাতার উৎসব পালিত হতো। সেদিন সকালে জমিদার হাতিতে চরে গ্রাম প্রশিক্ষণ করতেন, এর সাথে সাথে একটি শোভাযাত্রাও বের হতো। শোভাযাত্রা উপলক্ষে হাতি গুলোকে বিশেষ ভাবে সাজানো হতো। শোভাযাত্রার শেষে জমিদার কাছারী বাড়িতে বসলে প্রজারা এক এক করে এসে তহশীলদারের কাছে তাদের কর প্রদান করতেন। সেদিন হালখাতা উৎসব পালিত হতো এবং উৎসব উপলক্ষে প্রজাদের ভোজনের ব্যবস্থা করা হতো। এই প্রথা প্রায় বহুদিন ধরেই চলেছিল।

কাছারীবাড়ি। 

প্রমথেশ্বর জিউ মন্দির : - মারনাই এর জমিদার বাড়ির জমিদার শশীভূষন পাল চৌধুরী 1919 সালে দক্ষিণবঙ্গের শান্তিপুর থেকে কারিগর এনে দক্ষিনেশ্বর মন্দিরের আদলে জমিদার বাড়ি থেকে অনতিদূরে এই মন্দিরটি তৈরী করেন । জমিদার শশীভূষন পাল চৌধুরী খুবই জেদি মানুষ ছিলেন। গ্রামেরই নুনিয়াদের দ্বারা তৈরি ভূতেশ্বর মহাদেব জিউ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ঠিক পরের বছরই তিনি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটির অপূর্ব কারুকাজ সত্যি দেখার মত।

প্রমথেশ্বর জিউ মন্দির ।

মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৫০ ফিট। মন্দিরটি দক্ষিণ মুখী হলেও পূর্ব এবং পশ্চিমে দুটি দরজা আছে। মন্দিরটি পঞ্চরত্ন শৈলীতে তে নির্মিত। তারমধ্যে মাঝের চূড়া বা রত্নটিকে বহুদূর থেকে দেখা যায়। মন্দিরটি তৈরী করতে তখনকার সময়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যায় হয়েছিলো।

এই মন্দিরে কয়েকবার চুরির ঘটনাও ঘটেছে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রুপোর শিব মূর্তিটি এবং মন্দিরের মূল দরজার সামনে লাগানো বড় ঘন্টাটিও চুরি হয়ে যায়। যায় হোক এমন কারুকাজ করা মন্দির কিন্তু উত্তর দিনাজপুর জেলায় আর দেখা যায়না। স্বাধীনতার পর জমিদার চলে যাওয়ার জন্য পাল চৌধুরী বংশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হতে থাকে। ফলে মন্দিরটি আর সংস্কার হয়নি, যার ফলে মন্দিরটি জরাজির্ণ অবস্থায় চলে যায়। অনেক আবেদন, নিবেদন ও বাধাবিঘ্নের পর ২০২০ সালে মন্দিরটি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন দ্বারা সংস্কার করা হয়। বর্তমানে এটি হেরিটেজ মন্দিরের তকমা পেয়েছে, যার জন্য জেলার ইতিহাসবিদ ও গবেষক বৃন্দাবন ঘোষের অবদান অনস্বীকার্য।

নুনিয়া বাড়ি :- নুনিয়া কথাটি এসেছে নুন বা লবন থেকে, সেটা আমি আগেই বলেছি। এই নুনিয়াদের যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। নুনিয়া বাড়ির জোতদার বিহারীলাল দে দিনাজপুরের রাজার কাছ থেকে চিরস্থায়ী স্বত্বে জমি পান। এই নুনিয়াদের প্রচুর জমি ছাড়াও তাদের অনেক ব্যাবসা ছিল। নুনের ব্যাবসা ছাড়াও লোহা এবং কাপড়ের ব্যবসা ছিল প্রধান। মালদার মহানন্দা থেকে নৌকা বোঝাই করা হতো, তারপর সেটি সুঁই নদী হয়ে মারনাই আসতো। সেই সময়ে কাপড়ের ব্যবসা করে তাদের প্রচুর লাভ হয়েছিলো। তাই তারা মারনাই একটি বিশাল বড় বাড়ি তৈরি করেন, যেটি এখনো অবশিষ্ট আছে। এবং এখনো এখানে ওই বাড়ির লোকেরা বসবাস করছে। এই বাড়ি ছাড়াও তারা কলকাতার হ্যারিসন রোডে, মালদা এবং কৃষ্ণনগরের বাড়ি তৈরি করেন। এর থেকেই এদের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধে আন্দাজ করা যায়।

নুনিয়া বাড়ি।


ভূতেশ্বর মহাদেব জিউ :- নুনিয়াদের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে হয়তো একটা আন্দাজ আপনারা পেয়ে গেছেন আগের পয়েন্টেই। এই বংশের লোকেরা মহাদেব শিবের উপাসক ছিলেন। এই নুনিয়া পরিবারের বাবুরাম দে নিজের জমিতে অধিক ফসল লাভের আসায় শিবের উপাসনা করতেন। তাই তিনি নিজ বাড়িতে বাংলার ১৩২৫ সালে ভূতেশ্বর মহাদেব জিউ নামে একটি শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন।

ভূতেশ্বর জিউ মন্দির ।

এই মন্দিরে একটি সুউচ্চ চূড়া রয়েছে। দেখানে একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ এবং একটি সাদা পাথরের বৃষ প্রতিষ্ঠিত আছে। এই মন্দিরের নামে ৫০০ বিঘে জমিও ছিলো। শিব চতুর্দশী এবং চৈত্র সংক্রান্তির দিন খুব ধুম ধাম সহকারে শিবের পূজা হতো। এই ভূতেশ্বর শিব মন্দির কে দেখেই পরের বছর জমিদার শশীভূষন পাল চৌধুরী প্রমথেশ্বর জিউ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন মারনাই তে। যদিও প্রমথেশ্বর জিউ এর মতো এই ভূতেশ্বর জিউ মন্দিরে ও সংস্কারের প্রয়োজন।

জেলার দ্বিতীয় সবচেয়ে পুরোনো স্কুল স্কুল শরচ্চন্দ্র হাইস্কুল:- মারনাই শরৎচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৯৯ সালে। এটি উত্তর দিনাজপুর জেলার দ্বিতীয় সবচেয়ে পুরোনো স্কুল(চূড়ামন প্রহ্লাদ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের পরেই) এবং তার সাথে সাথে এই বিদ্যালয়ের সাথেও জড়িয়ে আছে মারনাই জমিদারবাড়ির নাম। মারনাই জমিদারবাড়ির জমিদার মহেন্দ্র নারায়ণ পালচৌধুরীর ছেলে জমিদার উপেন্দ্র নারায়ণ পালচৌধুরীর উদ্যোগেই এই স্কুলের পথচলা শুরু। তার প্রচেষ্টায় ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে মারনাইতে একটি মিডল স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। নুনিয়া বাড়ির শরচ্চন্দ্র দে এই স্কুলের উন্নতিতে ১০ হাজার রৌপ্য মুদ্রা দান করেছিলেন বলে এই নাম শরচ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় রাখা হয়.. এই স্কুল সমন্ধে একটি বিস্তারিত ব্লগ আছে আমার নিচে লিঙ্ক দিলাম আপনাদের সুবিধার্থে....

উত্তর দিনাজপুর জেলার দ্বিতীয় সবচেয়ে পুরোনো স্কুল

শরচ্চন্দ্র হাইস্কুল। 


ভারত সেবাশ্রম সংঘ :- হিন্দু মিলন মন্দির বা ভারত সেবাশ্রম সংঘ মারনাই এর একদম সদর এলাকায় অবস্থিত। প্রতি বছর শীতকালে এখানে ৩ দিন ব্যাপী উৎসব পালিত হয়, এই সময়টা মারনাই তে আসার উপযুক্ত সময়।

ভারত সেবাশ্রম সংঘ। 

মহানন্দা ও সুঁই নদীর সঙ্গমস্থল :- মারনাই মহানন্দা এবং সুঁই নদী দ্বারা পরিবেশটিত থাকার জন্য এই এলাকার কৃষিকাজে খুবই উন্নত। মারনাই থেকে কিছুটা দূরে ঘৃততলাতে সুঁই ও মহানন্দার মিলনস্থল। এই সুঁই নদী একাধারে মহানন্দা নদীর শাখা নদী এবং উপনদী। এই সুঁই নদী পারাহরিপুরের কাছে মহানন্দা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে মারনাই এর কাছে এসে মহানন্দার সাথেই মিলিত হয়েছে। এরকম ধরণের নদী কিন্তু খুব কম দেখা যায়। সূচ বা সুঁই এর মতো শূখ্য ধারা জন্য হয়তো এই নদীর নাম সুঁই। যদিও এই জায়গাটিতে আসার জন্য রাস্তা খুবই খারাপ বর্ষাকালে তো একদমই অনুপযুক্ত।

মহানন্দা ও সুঁই নদীর সঙ্গমস্থল ।


1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন