কুলিক নদী। Kulik River, Raiganj Uttar Dinajpur.

।। কুলিক নদী-রায়গঞ্জ।।

ভ্রমণ পিপাসু :- উত্তর দিনাজপুর জেলা তথা রায়গঞ্জ মহকুমার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ নদী হল কুলিক। দৈর্ঘ্যে এই নদী খুব একটা বড় না হলেও গুরুত্বে কোনো অংশে কম নয়। গোটা উত্তরবঙ্গের ভূমিই উত্তর থেকে দক্ষিণে সামান্য ঢালু তাই উত্তরবঙ্গের প্রায় সব নদীই দক্ষিণমুখী।



Kulik River from Kulik Bridge. 

উত্তরবঙ্গের নদীকথা'য় আজকে তুলে ধরবো উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ মহকুমার কুলিক নদী নিয়ে এই জেলার নদী গুলো পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ, বিহার এবং কিছু নদী উত্তরের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়েছে। কুলিক নদীও বাংলাদেশের একটি বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে।


কুলিক নদীর উৎপত্তি :- বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার রায়পুরের কাছে মরার বিল থেকে এই কুলিক নদীর উৎপত্তি হয়েছে। অনেকে এই মরার বিলের আরেকটি নামও আছে, অনেকে একে ঝুমঝুম বিল বলেও অভিহিত করে থাকে। মরার বিল থেকে উৎপত্তি হওয়ার পর এই নদীতে আসে পাশের আরো কয়েকটি বিল ও খালের জল এসে মিলিত হয়ে কুলিক নদীর সৃষ্টি করেছে।

কুলিক নদীর গতিপ্রবাহ :- সমস্ত নদীর ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। নদীর গতি উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ পথটি ভূপ্রকৃতির ওপরে নির্ভর করে। সেইজন্য নদীর প্রবাহপথ মুলত তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়। একটি উচ্চগতি, একটি মধ্যগতি এবং সবশেষে নিম্নগতি।

কুলিক নদীর ক্ষেত্রে সেটা লক্ষ্য করা যায়। কুলিক নদীর উৎপত্তিস্থল ঠাকুরগাঁও জেলার রায়পুরের মরার বিল থেকে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার গোবিন্দপুর পর্যন্ত কুলিক নদীর প্রাথমিক গতি। এই পুরো গতিপথের দূরত্ব ২২ কিমি ।

বাংলাদেশের গোবিন্দপুর থেকে শুরু হয় কুলিক নদীর মধ্যমগতি। গোবিন্দপুর থেকে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জ পর্যন্ত এই গতিপ্রবাহ কে মধ্যমগতি বলা হয়। গোবিন্দপুরের পর থেকে নদীর গতি অনেকটাই কমে যায় যার ফলে নদীতে অনেক বাঁকের সৃষ্টি হয়েছে।

রায়গঞ্জ থেকে বিহার বর্ডার লাগোয়া বিশাহার গ্রাম পর্যন্ত এই নদীর নিম্নগতি। রায়গঞ্জ ব্লকের এই বিশাহার গ্রামে এসে কুলিক নদী নাগর নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। এই পুরো গতিপথের দূরত্ব ১৬ কি.মি । বিশাহার গ্রামের কাছেই গোড়াহারে আবার নাগর নদী মহানন্দা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। তাই এই জায়গাটিতে আসলে আপনারা একসাথে তিনটে নদীর সঙ্গম দেখতে পাবেন। নদীর ওপারেই কিন্তু বিহার।

বিশাহার গ্রাম ।

কুলিক নদীর গতিপথ :- কুলিক নদী মোট দৈর্ঘ্য ৩৬০ কিমি। নদীটি বাংলাদেশের রায়পুর ইউনিয়নের মরার বিল থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের দুই জেলা ঠাকুরগাঁও, রংপুরের গোবিন্দপুর গ্রাম হয়ে এই নদী ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতের উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের বিন্দোলের কৈলাডাঙ্গিতে এসে নদী ভারতের ভূখণ্ডে এসে পড়েছে। এরপর হেমতাবাদ ব্লক হয়ে, বামুহা হয়ে কুলিক নদী রায়গঞ্জ ব্লকে প্রবেশ করেছে। রায়গঞ্জ শহর ঘেঁষে প্রবাহিত হয়ে ৯নং গৌরী গ্রাম পঞ্চায়েতের বিহার লাগোয়া বিশাহার গ্রামে এসে নদীটি নাগর নদীতে পতিত হয়েছে।

কুলিক নামের তাৎপর্য :- কুলিক নদী তার যাত্রাপথে প্রায় ৫০ বারের মত বিভিন্ন জায়গায় একেঁবেঁকে প্রবাহিত হয়েছে। তাই কেউ কেউ মনে করেন অষ্ট নাগের এক নাগ 'কুলিক' এর মতই তার তার গতিপথ, তাই হয়তো এই নদীটির নাম কুলিক নামে অভিহিত করা হয়। আবার কারো কারো মতে এই নদীর তীরে প্রচুর পরিমাণে কুলেখারা বা কলিকা নামক শাক জন্মাতো বলে এই নদীর নাম কুলিক হয়। যদিও সঠিকটা কি সে ব্যাপারে বলা খুব কঠিন। কেউ জানলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।

কুলিক নদী ও মণি :- কুলিক নদী তার সমগ্র গতিপথে প্রায় ৫০ বারের মতো একেঁবেঁকে প্রবাহিত হওয়ার কারণে নদীর বাঁকগুলোতে বহু মণির জন্ম হয়েছে। তার মধ্যে একটি রায়গঞ্জ শিয়ালমণি। এই মণির পারে ও আসে পাশে প্রচুর শেয়াল থাকতো বলে এই এলাকাটির নাম শিয়ালমণি হয়ে যায়। এই অঞ্চলটিকে শিয়ালডাঙ্গি নামেও আগে পরিচিত ছিল। গাইডুবি এলাকায় কুলিক নদীতে আরো একটি বিরাট মনির সৃষ্টি হয়েছিলো, সেই মণির জলে একসময় কিছু গাই বা গরু ডুবে মারা গিয়েছিলো সেই থেকেই এই গাইডুবি নামটি এসেছে।

কুলিক পাখিরালয়ের পাশেই রয়েছে মণিপাড়া গ্রাম। এই মণিপাড়া গ্রামের বদ্বীপের ওপরেই গড়ে উঠেছে কুলিক ইকোপার্ক। এক সময়ে এখানে একটি বড় মণি ছিল সেইজন্য এই মণিপাড়া বলে অভিহিত হয়।


কুলিক নদী নিয়ে আরো কিছু অজানা কথা : - প্রাচীনকাল থেকে এই নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্য চলতো, তাই এই নদীর তীরেই পাটের গোলা ও নীলকর সাহেবদের কুঠি স্থাপিত হয়। সেই সময়ে রায়গঞ্জের বন্দর এলাকা ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র, তখন বন্দরের একদম পাস দিয়েই এই নদী প্রবাহিত হতো। বন্দর বাজারে বহু দূর দূরান্ত থেকে তখন বনিকরা মালপত্র কেনাবেচা করতে আসতো।

প্রাচীনকালে বর্ষার সময়ে নদী পারাপারের সময়ে এখানে বেশ কিছু ঘাট থেকে নৌকা পারাপার করতো। সেরকমই একটি ঘাট ছিল আব্দুলঘাটা, আব্দুলঘাটায় আবদুল নামে এক মাঝি নৌকা চালাতেন তার নামেই এই ঘাটের নাম আব্দুলঘাটা হয়। চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে এই ঘাটে কুলিক নদীতে বহু পূণ্যার্থী স্নান করে, এবং এই অষ্টমীর স্নানকে কেন্দ্র করে একটি বড় মেলাও বসে। কুলিকের খরমুজা ঘাটে মহালয়ার সকালে বহু পিত্রৃপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য তর্পণ করে থাকে।


এই কুলিক নদীর পাশেই গড়ে উঠেছে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখিরালয় কুলিক পক্ষীনিবাস। এখানে প্রতি বছর সাইবেরিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রচুর পরিযায়ী পাখি( তার মধ্যে শামুকখোল পাখির আধিক্য বেশি) এখানে আসে, এখন বর্তমানে এই পাখিরালয়ের পরিকাঠামোর অনেকটা উন্নয়ন হয়েছে। যা রায়গঞ্জ তথা গোটা জেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষন।


বর্ষাকালে এই নদী বিশাল রূপ ধারণ করে বিশেষত বাংলাদেশের জল এবং নাগর নদীর জলে এই নদীতে জল বারে, যার ফলে আসে পাশের এলাকায় প্রচুর বন্যা হত যা প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। যার মধ্যে ১৯৮৭ এবং ২০১৭ সালের বন্যা উল্লেখযোগ্য। এই নদী বন্যা প্রবন হওয়ার কারণ এর মধ্য ও নিম্ন গতিতে নদীর স্বল্পগতি এবং গভিরতা হ্রাস যার ফলে অল্প বৃষ্টিতেই বন্যার সৃষ্টি। যদিও বর্তমানে নদীতে বাঁধ দেওয়ার ফলে এই বন্যা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। এই হল উত্তর দিনাজপুর তথা রায়গঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ কুলিক নদী নিয়ে উত্তরবঙ্গের নদীকথা। পরের পর্ব উত্তরবঙ্গের কোনো এক জেলার নদী নিয়ে আলোচনা করা হবে। আপনাদের এই কুলিক নদীর ব্লগটি কেমন লাগলো কমেন্ট করে অবশ্যই জানাবেন, ধন্যবাদ।

তথ্য সংগ্রহ ও সহযোগিতা - বৃন্দাবন ঘোষ 



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন