ভারত - বাংলাদেশ স্থল বন্দর (ল্যান্ড পোর্ট)
ভ্রমণ পিপাসু :- ভারত বাংলাদেশ দুই প্রতিবেশী দেশ, দুই দেশের মধ্যেই ব্যবসায়িক, পারস্পরিক এক মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান, কারণ দুটি দেশের ১৯৪৭ এর আগে একটিই দেশ ছিল। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় কয়েক লাখ মানুষ বিভিন্ন কাজে বিশেষত চিকিৎসা, ভ্রমণ এবং ব্যবসায়িক কাজে ইন্ডিয়াতে এসে থাকে। দুদেশের মধ্যে প্রতি বছর প্রায় কয়েক বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়ে থাকে।
ভারত - বাংলাদেশের বর্ডার যেটি র্যাডক্লিফ লাইন নামে পরিচিত ছিল, পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বর্ডার, যার দৈর্ঘ্য - ৪০৯৬ কি.মি, যার মধ্যে পড়ছে ভারতের পাঁচটি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম,ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের ছয়টি ডিভিসন - চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর এবং সিলেট।
পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম বৃহত্তম এই বর্ডারের দুপাশের দুদেশের মধ্যে আছে পারস্পরিক গভীর সম্পর্ক। তাই দেশের সরকারের ল্যান্ড পোর্ট অথরিটির উদ্যোগে কিছু স্থলবন্দর সৃষ্টি করা হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে মোট ২৬ স্থল বন্দর আছে তার মধ্যে কিছু এখনো চালু হয়নি আর কিছু বন্দর দিয়ে কেবল মাত্র পণ্যবাহী যান চলাচল করে। আর কিছু বন্দর আছে যেটা দিয়ে রেল চলাচল( যাত্রীবাহী, পণ্যবাহী) করে।
আজকের এই ব্লগে আমি কেবল মাত্র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সাথে বাংলাদেশের যে কটি স্থলবন্দর এবং রেল বন্দর আছে সেগুলো আলোচনা করবো। ভারতের রাজ্য গুলোর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সাথেই বাংলাদেশের বর্ডার সবচেয়ে দীর্ঘতম এবং বেশী সংখ্যক মানুষ এই রাজ্যের বন্দর গুলো দিয়েই চলাচল করে। পশ্চিমবঙ্গের সাথে বাংলাদেশের সর্বমোট সাতটি স্থলবন্দর যেটা দিয়ে যাত্রী এবং পণ্যবাহী গাড়ি যাতায়াত করে, এবং ৫টি রেলবন্দর (রেললাইন বলতে পারেন) আছে। চলুন তাহলে এক এক করে আলোচনা করা যাক......
১. বেনাপোল -পেট্রাপোল বর্ডার :- দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর যেটি ভারত-বাংলাদেশ মধ্যে অবস্থিত এই বেনাপোল -পেট্রাপোল বর্ডার। এটি অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলার বনগাঁ থানার পেট্রাপোলে এবং বিপরীত দিকে বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের পাবনা জেলার শহর্সা উপজেলার বেনাপোলের যশোর রোডের ওপরে। এই যশোর রোড কলকাতা থেকে বাংলাদেশের যশোর হয়ে রাজধানী ঢাকা যে সংযুক্ত করেছে। এই রাস্তা দিয়ে গেলে আপনারা বহু প্রাচীন বড় বড় গাছ রাস্তার দুধারে দেখতে পাবেন, দেখতে ভারী সুন্দর লাগে এই জন্য এই রাস্তাটি পর্যটকদের আকর্ষন করে। যদিও এখন রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য অনেক গাছ কাটা পড়ে গিয়েছে। বর্ডারের একদিকে বেনাপোল এবং একদিকে পেট্রাপোল আগে পুরো বনগাঁ মহকুমা যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
Benapole - petrapole bordar. |
১৯৮৪ তে এই বন্দর প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়। এই বন্দর দিয়েই ভারত - বাংলাদেশ মধ্যে ৯০ % বানিজ্য হয়ে থাকে এবং সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এই বন্দর হয়েই দু দেশের মধ্যে যাতায়াত করে। এখানে একটি রেললাইন বা রেল পোর্ট ও আছে যেটা নিয়ে আমি পরের পয়েন্টে আলোচনা করবো। বাংলাদেশের যেকোনো ছোটো বড় শহর থেকে আপনি বেনাপোলে আসা এবং বেনাপোল থেকে যাওয়ার জন্য বাস পেয়ে যাবেন। সাথে ট্রেন ও আছে। তেমনি ভারতের সাইডে পেট্রাপোলে নেমে ৪০ টাকার অটো ভাড়া করে বনগাঁ স্টেশন তারপর লোকাল ট্রেন ধরে ২০ টাকার বিনিময়ে সোজা কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশন। একইরকম ভাবে কলকাতা থেকে এই পেট্রাপোল বন্দরে পৌঁছে যেতে পারবেন।
২.বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি বর্ডার :- ২০১১ চালু হওয়া দুদেশের মধ্যে চালু নবীন বন্দর গুলির মধ্যে একটি হল এই বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি বর্ডার। এটি অবস্থিত বাংলাদেশের এবং উত্তর প্রান্তে, রংপুর ডিভিশনের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধাতে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার ফুলবাড়িতে।
বাণিজ্যিক দিক থেকে এই বর্ডার অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় এই বর্ডারটি ওপেন করা হয়েছিলো। তার কারণ বর্ডার থেকে নেপাল এবং ভুটানের দূরত্ব একদমই কাছে। সেই জন্য বাংলাদেশের সাথে নেপাল ভুটানের সাথে স্থলবাণিজ্য এই বন্দর মারফৎ ইন্ডিয়ান ট্রাইজিট মাধ্যমে হয়ে থাকে। তেমন নেপাল, ভুটানের কোনো নিজস্ব সমুদ্র বন্দর না থাকায় তারও এই রুট দিয়েই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর দিয়ে আমদানি রফতানি করে থাকে, ফলে এই বন্দর চালু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান এবং ইন্ডিয়া এর চার দেশের পক্ষে অনেকটা লাভজনক হয়েছে।
Banglabandha - Fulbari bordar |
এই বন্দর খুলে দেওয়ার আরো একটি উদ্দেশ্য হল পর্যটন শিল্প। কারণ বাংলাদেশ থেকে প্রায় কয়েক হাজার মানুষ প্রতি বছর পর্যটনের ভারতে এসে থাকে কারণ ভারতে পর্যটনের খরচ বাংলাদেশের সাথে যদি তুলনা করেন তাহলে অনেকটি সস্তা সেজন্য তারা বর্ডার পেরিয়ে ইন্ডিয়াতে এসে থাকে, বাংলাদেশীদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হল উত্তরবঙ্গ, সিকিম, নেপাল এবং ভুটানের পাহাড়ি অঞ্চল, বিশেষ করে দার্জিলিং এবং সিকিম। তাদের এতদিন বেনাপোল, কলকাতা হয়ে উত্তরবঙ্গ আসতে হতো যা ছিল অনেকটাই ঘোরাপথ। কিন্তু এই বন্দর খুলে যাওয়ার পর বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি বর্ডার জিরো পয়েন্ট থেকে উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় স্টেশন NJP এর দূরত্ব মাত্র ১০ কি.মি, শিলিগুড়ির দূরত্ব ১৫ কি.মি হয়ে যায়, তার সাথে সাথে দার্জিলিং ৭৬ কি.মি এবং সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের দূরত্ব হয়ে যায় ১২৩ কি.মি। তাছাড়া নেপাল ভুটান ও ভায়া শিলিগুড়ি হয়ে খুব কম সময়ে কম খরচে পৌঁছে যাওয়া যায়। এই বন্দর টি খুলে যাওয়ার পর যথেষ্ট ই সুবিধা হয়েছে বাংলাদেশী ট্যুরিস্টদের কাছে।যদিও করোনা পরিস্থিতির পর ২০২০ সাল থেকেই এই বন্দর দিয়ে শুধু পণ্যবাহী গাড়িই যাতায়াত করছে, যাত্রীদের যাওয়ার এখনো কোনো পারমিশন দিচ্ছে না, তবে শীঘ্রই আসা করা হচ্ছে যে এটিও খুলে যাবে।
বাংলাবান্ধা-ফুলবাড়ি সীমান্তে পৌঁছতে হলে আপনি যদি বাংলাদেশের হোন তাহলে ঢাকা থেকে পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ধরে এখানে চলে আসতে হবে পঞ্চগড়। তাছাড়া দ্বিতীয় অপশন আছে বাস যেটা আপনারা বাংলাদেশের যেকোনো ছোট্ট বড়ো শহর থেকে পেয়ে যাবেন। পঞ্চগড় থেকে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টের দূরত্ব ৫৮ কি.মি। এটুকু পথ আপনাকে ছোটো গাড়ি বা বাসে যেতে হবে। সেখান থেকে বর্ডার ক্রস করে ফুলবাড়ি সেখান অটো করে খুব কম খরচে NJP স্টেশন বা শিলিগুড়ি বাস স্ট্যান্ড চলে আসতে পারেন। একই রকম ভাবে ইন্ডিয়ার দিক থেকে আসতে হলে প্রথমত শিলিগুড়ি, তার পর, শিলিগুড়ি থেকে অটো করে ফুলবাড়ি জিরো পয়েন্ট।
৩. হিলি বর্ডার :- পশ্চিমবঙ্গে পেট্রাপোল বর্ডারের পর দ্বিতীয় যে বর্ডারটি আছে যেটা বানিজ্য ও যাত্রীরা যাতায়াত করে সেটি হল এই হিলি বর্ডার। দেশ ভাগের সময়ে এই হিলি শহরটিকেও দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়ে। স্টেশনটি পরে যায় বাংলাদেশের সাইডে এবং মেন বাজারটি পরে ভারতের সাইডে। সেইজন্য দু দিকের জায়গাটিকেই হিলি বলা হয়। একদিকে বাংলা হিলি এবং অন্য দিকে ইন্ডিয়ার অংশ কে বলে শুধু হিলি। প্রথম বারের জন্য এই হিলি বর্ডার ওপেন হয়েছিলো ১৯৮৫-৮৬ সালের দিকে তারপর অনেক ডেভেলপমেন্ট হয়েছে। এই বর্ডারটি অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমার হিলিতে। আর বাংলা হিলি অবস্থিত দিনাজপুর জেলার হাকিমপুর উপজেলায়।
Hili Bordar. |
বাংলাদেশের দিক থেকে হিলি পৌঁছতে হলে আমি ট্রেন বা বাস দু ভাবেই আসতে পারেন। ঢাকা থেকে পঞ্চগড় গামি ট্রেন ধরে আপনি হিলি স্টেশনে নেমে বর্ডার চলে আসতে পারেন, খুব কাছেই। আর ভারতের দিক থেকে আসতে হলে প্রথমত ট্রেন বা বাস ধরে বালুরঘাট, এরপর বালুরঘাট থেকে গাড়ি করে হিলি।
৪. চ্যাংড়াবান্ধা- বুড়িমারি বর্ডার :- ভারত বাংলাদেশের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম বর্ডার এই চ্যাংড়াবান্ধা- বুড়িমারি বর্ডার।২০১৮ সালে বর্ডারটি কে পণ্যবাহী যান চলাচল এবং যাত্রীদের Intrigrated Chekpost হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এই বর্ডার হয়ে বাংলাদেশের সাথে নেপাল ও ভুটানের মধ্যেও ব্যবসা বাণিজ্য হয়ে থাকে।
এই চ্যাংড়াবান্ধা- বুড়িমারি বর্ডারটি অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জ মহকুমায়। এবং বাংলাদেশের রংপুর ডিভিশনের লালমনিহাট জেলার পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারি এলাকায়।
Burimari bordar. |
চ্যাংড়াবান্ধাতে রেল স্টেশনও আছে কেউ এখানে আসতে চাইলে NJP বা নিউ কোচবিহার থেকে সরাসরি এখানে আসার ট্রেন পেয়ে যাবেন। বাই রোড আসতে হলে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, বা কোচবিহার থেকে এখানে আসা খুবই সহজ। বাংলাদেশের ঢাকা থেকে এই বর্ডারে পৌঁছতে হলে আপনি প্রথমে বাসে করে লালমনিহাট সদরে সেখান থেকে লোকাল গাড়িতে পাটগ্রাম। পাটগ্রাম থেকে বুড়িমারি জিরো পয়েন্ট মাত্র ১৪ কিমি দূরে। তাছাড়া বুড়িমারিতে রেল স্টেশনও আছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর স্টেশন থেকে লালমনিহাট হয়ে বুড়িমারি চলে আসতে পারবেন।
৫. দর্শনা -গেদে বর্ডার : - বাংলাদেশের খুলনা ডিভিশনের চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবনপুর উপজেলার জয়নগর-দর্শনা বর্ডার ২০০২ সালে এটি ওপেন হয়েছিলো। উলটো দিকেই আছে ভারতের নদীয়া জেলার গেঁদে বর্ডার। এই লাইন কেবলমাত্র যাত্রীদের জন্য কোনো পণ্যযান এই রুট দিয়ে যাওয়ার কোন পারমিশন নেই।
Gede - Darshana bordar. |
এই বর্ডার হয়ে একটি ট্রেন লাইন ও আছে যে পথ দিয়েই দু দেশের মধ্যে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন যাতায়াত করে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে এই জয়নগর, দর্শনা বর্ডার আসার জন্য বাস এবং ট্রেন পেয়ে যাবেন। বর্ডার ক্রস করতে হবে আপনাদের হেঁটে বা প্রচুর ভ্যান পেয়ে যাবেন। উলটো দিকেই আছে গেঁদে স্টেশন সেখান থেকে লোকাল ট্রেন ধরে ৩০ টাকার বিনিময়ে সোজা কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনে, একইরকম ভাবে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে গেঁদে তারপর বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশের দর্শনা।
৬. ভোমরা - ঘোজাডাঙ্গা বর্ডার :- পারস্পরিক বাণিজ্যের জন্য ২০১৩ সালে এই বন্দরটি খোলা হয়। এই বর্ডারের একদিকে আছে বাংলাদেশের খুলনা ডিভিশনের সাতক্ষীরা জেলার ভোমরা। অন্য দিকে আছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট থানার ঘোজাডাঙ্গা। বসিরহাট শহরের খুব কাছেই অবস্থিত এই বর্ডার চেক পোস্ট।
Bhomra - Ghojadanga Bordar. |
বাংলাদেশের দিক থেকে আসতে হলে খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা হয়ে ভোমরা আসতে হবে বাই রোড। সাত ক্ষীরা থেকে ভোমরা জিরো পয়েন্টের দুরত্ব মাত্র ১৫ কি.মি। কলকাতার দিক থেকে এখানে আসতে হলে সবচেয়ে ভালো মাধ্যম ট্রেন। শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদ লোকাল ধরে বসিরহাট তারপর টোটো ধরে বর্ডার।
৭. মহদিপুর- সোনা মসজিদ বর্ডার :- এই বর্ডারটি কেবল মাত্র বানিজ্যিক আমদানি রফতানির জন্যই শুরু করা হয়েছিলো। কারণ বর্ডারটির একদিকে আছে ভারতের মালদা শহর অন্য দিকে আছে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর রাজশাহী। এই বর্ডার রাজশাহী শহরকে মালদার সাথে যুক্ত করেছে।
Mahadipur Bordar. |
এই পুরো এলাকাটি এক সময়ে প্রাচীন গৌড়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেশ ভাগের ফলে এই গৌড়ের বেশিরভাগটা পড়ে ইন্ডিয়াতে এবং বাকিটা পরে বাংলাদেশে। যেমন গৌড়ের বিখ্যাত বড় সোনা মসজিদ টি ইন্ডিয়ার মধ্যে থাকলেও ছোটো সোনা মসজিদটি পড়ছে বাংলাদেশে। সেই জন্য বাংলাদেশের ওপারের অংশটির নামই সোনা মসজিদ। এই বর্ডারটি বিভক্ত হয়েছে গৌড়ের প্রাচীন বিখ্যাত কোতয়ালি গেট দ্বারা। এটির অবস্থান বাংলাদেশের রাজশাহী ডিভিশনের চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার সোনা মসজিদ এলাকায়। আবার ভারতের মালদা জেলার ইংরেজ বাজার সদর ব্লকের গৌড় এলাকায়।
বাংলাদেশের দিক থেকে এখানে আসতে চাইলে আপনি ঢাকা থেকে রাজশাহী হয়ে এখানে চলে আসতে পারেন। রাজশাহী থেকে সোনা মসজিদ আসতে বাসে সময় লাগে প্রায় ৩ ঘন্টা। ছোটো সোনা মসজিদ থেকে প্রায় ৩ কি.মি এগিয়ে আসলেই বর্ডারের কোতয়ালি গেট। আবার ভারতের মালদা শহর থেকে গৌড় রোড ধরে সোজা প্রায় ১০ কি.মি এই বর্ডার।
ভারত - বাংলাদেশ রেল লাইন
১.বেনাপোল - পেট্রাপোল :- বেনাপোল - পেট্রাপোল দিয়ে স্থল বন্দর দিয়ে যোগাযোগ ছাড়াও একটি ট্রেন রুট আছে যেটা দিয়ে দু দেশের মধ্যে ট্রেন চলাচল করছে। ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৪ সালে এই লাইন চালু হয়। তখন পেট্রাপোল স্টেশনটি ছিলো না। সেই সময়ে খুলনা থেকে বরিশাল এক্সপ্রেস শিয়ালদহ পর্যন্ত যাতায়াত করতো। দেশভাগের পর পেট্রাপোল স্টেশনটিকে প্রান্তিক স্টেশন হিসেবে গড়ে তোলা হয়। 1965 খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের সময়ে এই লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
Petrapole Rail Station. |
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের দিকে এই লাইন দিয়ে আবার পণ্যবাহী ট্রেন চালু হয় কিন্তু এটা বেশি দিন চলেনি। ২০০০ সালে আবার দু দেশের সম্মতিতে আবার পন্যবাহী ট্রেন চলাচল শুরু করে। ২০১৭ সালে আগের বরিশাল এক্সপ্রেসের ধাঁচে দু দেশের মধ্যে কলকাতা থেকে খুলনা যাত্রীবাহী ট্রেন 'বন্ধন এক্সপ্রেস' চালু হয়।
২. রাধিকাপুর - বিরল রেল লাইন :- পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুর জেলার সীমান্ত স্টেশন রাধিকাপুর এবং বর্ডারের এপারে আছে বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার বিরল স্টেশন। এই দুটি দুই দেশের দুই প্রান্তের দু'টি সীমান্ত স্টেশন যা শতাব্দী প্রাচীন কাটিহার - পার্বতীপুর রেল লাইনের অন্তর্ভুক্ত। আসাম বিহার লাইনের অন্তর্গত বিহারের বারসই স্টেশন থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর স্টেশন পর্যন্ত এই সেকসনে লাইনের কাজ সম্পূর্ন হয় ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর এই লাইনকে আরো সম্প্রসারিত করা হয় বারসই থেকে কাটিহার পর্যন্ত । তখন রাধিকাপুর এবং বিরল দুটি স্টেশনেরই কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। রাধিকাপুর স্টেশনটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৯২৭ সালে।
Radhikapur - Biral Railline. |
বর্তমানে এই লাইন দিয়ে কেবলমাত্র মালগাড়ি চলাচল করছে। বেশ কিছু বছর তাও বন্ধ ছিল। ২০১৭ সালে দু দেশের চুক্তির পর এই লাইন আবার চালু হয় যা এখনো চলছে। রাধিকাপুরের আগেই আছে সবচেয়ে বড়ো স্টেশন রায়গঞ্জ, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, রাধিকাপুর হয়ে মালট্রেন সোজা পৌঁছে যায় বাংলাদেশের পার্বতীপুর জংশনে।
৩.সিঙ্গাবাদ - রোহনপুর লাইন :- পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের সিঙ্গাবাদ এবং বর্ডার এর ওপারে আছে বাংলাদেশের চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুর স্টেশন. ।ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ এই লাইন দিয়ে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময় থেকেই ট্রেন চলাচল করতো তখন রাজধানী ঢাকার সাথে উত্তরবঙ্গের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল এই লাইন। এখন বর্তমানে এই লাইন দিয়ে একটি ট্রেন চলাচল করছে তাও মালগাড়ি। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সাথে ট্রানজিট মাধ্যমে নেপালের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য হয়।
Singhabad rail station. |
এই সিঙ্গাবাদ স্টেশনে আসলে দেখতে পাবেন সাইন বোর্ডে লেখা আছে ভারতের শেষে এবং প্রথম স্টেশন। সিঙ্গাবাদ স্টেশন এবং পুরো এই লাইন নিয়ে বিস্তারিত ভাবে পড়তে হলে এই লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিন...
৪. গেঁদে দর্শনা রেল লাইন :- গেঁদে বর্ডারের স্থল বন্দর নিয়ে আমি আগের পয়েন্টে লিখেছি এখানে আলোচনা করবো রেল লাইন নিয়ে কারণ গেঁদে দর্শনা বর্ডার হয়ে স্থল বন্দরও যেমন আছে তেমনি রেল লাইন ও আছে যদিও স্থল বন্দর এখন করোনার পর থেকে বন্ধ আছে কিন্তু রেল রুট কিন্তু খোলাই আছে এবং সেটা দিয়ে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম ট্রেন ( তিনটি ট্রেনের মধ্যে) মৈত্রী এক্সপ্রেস চলাচল করে, সপ্তাহে ৫ দিন। যদিও এই বর্ডার নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আমি আগের পয়েন্টে বলেছি তাই এটা আর দীর্ঘায়িত করলাম না।
Gede Station. |
৫.হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল লাইন :- স্বাধীনতার পরবর্তীকালে ভারত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যে সাতটি লাইন চালু ছিল তার মধ্যে এই হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল লাইনটি একটি। কিন্তু ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় থেকে এই লাইন দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক দশকের অপেক্ষার পর ২০২০ সাল থেকে আবার দুদেশের প্রধানমন্ত্রীদের যৌথ উপস্থিতিতে এই লাইন আবার চালু হয়। বর্ডারের একদিকে আছে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ি স্টেশন, স্টেশন থেকে জিরো পয়েন্টের দূরত্ব মাত্র ৪ কি.মি। বর্ডারের উল্টো দিকেই আছে বাংলাদেশের রংপুর সাবডিভিসনের নীলফামারি জেলার চিলাহাটি স্টেশন, ব্রিটিশ আমলে ১৮৬৭ সালে এই স্টেশনের উদ্বোধন হয়।
Haldibari Rail Station. |
২০২০ সাল থেকে এই লাইন দিয়ে কেবলমাত্র মালগাড়ি যাতায়াত শুরু করে ।এই লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাথে উত্তর পূর্ব ভারতের রেল যোগাযোগ এবং ব্যবসা বাণিজ্য আরো সুগম হয়েছে। মালগাড়ির পাশাপাশি এবছর ২৯শে মে থেকে চালু হয়েছে দু দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী এক্সপ্রেস ট্রেন নাম মিতালি এক্সপ্রেস। এটি ভারত বাংলাদেশের মধ্যে চালু হওয়া তৃতীয় ট্রেন। এই ট্রেন ভারতের শিলিগুড়ি শহরকে সরকারি যুক্ত করেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। এই ট্রেন NJP স্টেশন থেকে জলপাইগুড়ি টাউন, হলদিবাড়ি, চিলাহাটি, নীলমাফারী হয়ে ঢাকা পৌঁছোবে। এই ট্রেন চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের ট্যুরিস্টদের দার্জিলিং, সিকিম, ভুটান আসা আরো সহজ হয়েছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন