। মুর্শিদাবাদ জেলার কিছু জমিদারবাড়ি ও রাজবাড়ি ।
ভ্রমণ পিপাসু :- ঐতিহাসিক জেলা মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন। তেমনি অতীত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে বহু পুরোনো জমিদারবাড়ি। মুর্শিদাবাদ জেলার প্রায় প্রতিটা ব্লকেই যদি আপনি যান তাহলে প্রায় প্রতিটা জায়গায় একটি করে জমিদারবাড়ি খুঁজে পাবেন, আমার তো মুর্শিদাবাদ জেলা ঘুরে আসার পর তাই মনে হয়েছে। কিছু জমিদারবাড়ির অবস্থা একদমই ভগ্নপ্রায়, আবার কিছু কিছু জমিদারবাড়িতে এখনো জমিদারবাড়ির বংশধরেরা থাকায় সেগুলো অনেকটা ভালো অবস্থায় আছে।
আজকের এই ব্লগে আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করবো বা তুলে ধরার চেষ্টা করবো মুর্শিদাবাদের কিছু প্রাচীন ঐতিহাসিক জমিদারবাড়ি। এত জমিদারবাড়ি একসাথে কোনো জেলায় হয়তো পাবেন না। এই জেলায় এত জমিদারবাড়ি থাকার জন্য ধরে নেওয়া যেতেই পারে এই জেলা প্রাচীন কাল থেকেই খুবই বর্ধিষ্ণু এলাকা ছিল, সেই মুর্শিদাবাদ কিছু চেনা কিছু অজানা, এবং অফবিট জমিদারবাড়ি আপনাদের সামনে আমি তুলে ধরবো, এরকম একসাথে একটি ব্লগে সমস্ত জমিদারবাড়ি আপনি আগে কোনো জায়গায় পাবেন না। চলুন তাহলে এক এক কর শুরু করি.....
১. ধুলিয়ান জমিদারবাড়ি :- মুর্শিদাবাদের জমিদারবাড়ি নিয়ে আলোচনাটা শুরু করা যাক একদম মুর্শিদাবাদের উত্তর থেকে। মুর্শিদাবাদের উত্তরে অবস্থিত ধুলিয়ান যা শামশেরগঞ্জ থানার অন্তর্গত, একদম গঙ্গা নদীর তীরবর্তী একটি শহর, নদীর ওপর দিকেই আছে মালদা।ধুলিয়ানের পর থেকেই গঙ্গা নদী দুটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে একটি পদ্মা নামে বাংলাদেশে গিয়েছে অপরটি ভাগীরথী নামে আমাদের রাজ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এই গঙ্গাঘাটের ঠিক কিছুটা দূরেই কাঞ্চনতলা এলাকায় এই জমিদারবাড়ি গড়ে তোলা হয়েছিলো। প্রাচীনকালে এখানে অনেক কাঞ্চন গাছের অধিক্য থাকায় এই জায়গাটির নাম কাঞ্চনতলা হয়ে যায়।প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরোনো এই জমিদারবাড়ি এখনো তার অতীত ঐতিহ্য ও যৌবন ধরে রেখেছে ধুলিয়ান জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার জগৎবন্ধু রায়। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জের মানুষ।
গঙ্গার ভাঙনের কবলে পড়ায় ১৮২৫ সালের দিকে জমিদার জগৎবন্ধু রায় বাংলাদেশের মালুচি গ্রাম থেকে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানের কাঞ্চনতলাতে এসে এই জমিদারবাড়ির পত্তন করেন। এখানে খুব ধুমধামের সাথে দুর্গাপূজা এবং জগদ্ধাত্রী পূজা হয়ে থাকে, বছরের এই দুটি সময়েই আপনি এই জমিদারবাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন, বাকি সময় প্রবেশাধিকার থাকে না। এই জমিদারবাড়ির দুর্গাপূজা বাইশ পুতুলের পূজা নামে পরিচিত। রথের দিন থেকেই রীতি মেনে এই দুর্গা পূজার প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয়। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা 'জলসাঘর' এবং 'দেবী' সিনেমার শুটিং পার্শ্ববর্তী নিমতিতা জমিদারবাড়িতে হলেও এই জমিদারবাড়িতেও কিছুটা অংশের শুটিং হয়েছিলো।
এখানে আসা খুবই সহজ আপনি সড়ক বা রেল যেকোনো মাধ্যমে এখানে চলে আসতে পারেন। সড়কপথে আসলে NH-34 ধরে ধুলিয়ান মোড়ে নেমে সেখান থেকে মাত্র ১ কি.মি দূরে এই জমিদারবাড়ি। ট্রেনে আসতে চাইলে আপনি ধুলিয়ান-গঙ্গা বা ফারাক্কা স্টেশনে নেমে এখানে চলে আসতে পারেন।
২. নিমতিতা জমিদারবাড়ি :- ধুলিয়ান থেকে কিছুটা দক্ষিণে গেলেই পড়বে নিমতিতা গ্রাম, যা মুর্শিদাবাদের সুতি থানার অন্তর্গত। এই নিমতিতাতেই একদম পদ্মা নদীর ধারে গড়ে হয়েছিলো প্রাচীন নিমতিতা জমিদারবাড়ি। যে জমিদারবাড়িতে শুটিং হয়েছিলো সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা "জলসাঘর" তার সাথে সাথে এখানে "দেবী" এবং "তিনকন্যা"সিনেমার ও শুটিং হয়েছিলো। কিন্তু সকলে জলসাঘর সিনেমার কথাটিই জানে, কিন্তু এছাড়াও আরো দুটি সিনেমার শুটিং হয়েছিলো, সেই উদ্দেশ্যে সত্যজিৎ রায় এই বাড়িতে বহুবার ভিজিট করেছিলেন, একবার নজরুল ইসলাম ও এসেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এই জমিদারবাড়ি অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সরকারি উদ্যোগের অভাব এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অনীহা এবং অবহেলায় এখন এই জমিদারবাড়ি ধংসের অপেক্ষায় দিন গুণছে।
নিমতিতা জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাংলাদেশের পাবনা জেলার চৌধুরীরা। তারা মুর্শিদকুলি খাঁ আমলে উচ্চপদে নিযুক্ত ছিলেন। গঙ্গার ভঙ্গনের জন্য তারা গঙ্গার পূর্ব পার থেকে পশ্চিম পাড়ে চলে আসেন। এই পরিবারের দুজন ভাই দ্বারকানাথ চৌধুরী, গৌরসুন্দর চৌধুরী চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুযোগে জমিদারি পত্তন করেন। এবং পদ্মা নদীর ধারে এই সুবিশাল ১৫০ ঘর এবং ৫টি উঠোন বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়ি নির্মাণ করেন। এখানে আসলে আপনি গঙ্গা এবং পদ্মা নদীকে একসাথে দেখতে পাবেন, এই জায়গাটি তে গঙ্গা নদী দুটি বিভক্ত হয়েছে। অপরদিকেই আছে বাংলাদেশ, তাই এখানকার নৌকা গুলোতে দেখতে পাবেন ভারতের পতাকা লাগানো।
ব্রিটিশ আমলে এই জমিদারবাড়ি গান বাজনা, নাট্য চর্চার কেন্দ্রস্থলে পরিনত হয়েছিলো, সেই জন্য প্রায় ৩০০ কি.মি দূর কলকাতা থেকে এখানে বহু জ্ঞানীগুণী মানুষজন ছুটে আসতো। এই জমিদারবাড়িতেই একসময় মুর্শিদাবাদ জেলার সবচেয়ে যাকঁযমকপূর্ন দুর্গাপূজা হয়ে থাকত, যা আজ সব কিছুই অতীত। এত বিশাল জমিদার বাড়ি মুর্শিদাবাদে খুব কমই আছে। এখানে আসলে খুব সুন্দর একটা দিন এখানে কাটাতে পারবেন সাথে অতীত ইতিহাসকে খুব সামনে থেকে অনুভব করতে পারবেন।
এখানে আসবেন কেমন করে, এখানে আসা খুবই সহজ, আপনি ট্রেন বা সড়কপথে দু ভাবেই এখানে চলে আসতে পারেন। সড়কপথে আসতে হলে NH - 34 ধরে নিমতিতার কাছে সাজুর মোড়ে নেমে পড়তে হবে তারপর টোটো ধরে এই জমিদারবাড়ি। অথবা ট্রেনে আসতে চাইলে নিমতিতা স্টেশনে সরাসরি নেমে পড়বেন, তবে এই স্টেশনে কিন্তু সমস্ত ট্রেন দাঁড়ায় না।
৩. লালগোলা রাজবাড়ি :- মুর্শিদাবাদের পদ্মা নদীর বাংলাদেশ বর্ডার সংলগ্ন একটি গ্রাম লালগোলা। নদীর অপরদিকেই আছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলা। লালগোলা শিয়ালদহ লাইনের লাস্ট স্টেশন। তাই এখানে আসার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্ত সুবিধা আছে। এই লালগোলাতেই গড়ে তোলা হয়েছিলো একটি রাজবাড়ি। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এই রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির সূচনা করেন দলেল রায় ও রাজনাথ রায় নামে দুই ভাই, এদের নীল এবং রেশমের ব্যাবসা ছিল, পরবর্তীতে তারা জমিদারি লাভ করে এবং এই জমিদারির সূচনা করে। এই রাজবাড়ি বর্তমানে একটি মুক্ত সংশোধোনাগারে পরিণত করা হয়েছে। এটাই আমাদের রাজ্যের প্রথম মুক্ত সংশোধোনাগার।
এই রাজবাড়ি চত্বরে আছে অনেকগুলো মন্দির, তার মধ্যে লক্ষী জর্নাদন মন্দির, বিখ্যাত কালি মন্দির, দুর্গা মন্দির যেখানে এখনো দুর্গা পূজা হয়ে থাকে , শিব মন্দির লালগোলেশ্বর মন্দির। এছাড়াও আছে প্রধান রাজবাড়ি যেটি এখন জেলে পরিনত করা হয়েছে, এছাড়াও আছে একটি রাজবাড়ি গেস্টহাউস যেখানে বহু বিখ্যাত মানুষেরা এসে থেকেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামেন্দ্র, সুন্দর ত্রিবেদী, কাজী নজরুল ইসলাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেইজন্য রাজবাড়ির কালি মন্দিরে দেওয়ালে এইসব বিখ্যাত ব্যাক্তিদের ছবি দেখতে পাবেন। মনে করা হয় বঙ্কিমচন্দ্র তার বিখ্যাত উপন্যাস আনন্দমঠের প্রেক্ষাপট রচনা করেছিলেন এখানেই। এই রাজবাড়ি গেস্ট হাউসটি বর্তমানে অবস্থা একদমই জরাজীর্ণ। এছাড়াও আপনারা কালমেঘা দুর্গা মন্দিরটিও দেখে নিতে পারেন। এই রাজ পরিবারের শেষরাজা যোগীনদরো নারায়ণ রায়, তিনি এই রাজবাড়িটিকে সরকারে হতে তুলে দেন।
আমি আগেই বলেছিলাম লালগোলা আসা খুবই সহজ আপনি কলকাতা দিক থেকে ট্রেনে চাইলে শিয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে সরাসরি লালগোলা চলে আসতে পারবেন। বাইরোড আসতে হলে 34 নং জাতীয় সড়ক ধরে বহরমপুর হয়ে অথবা যারা উত্তরবঙ্গ থেকে আসবেন তারা উমরপুরে নেমে এই লালগোলা চলে আসতে পারেন।
৪. কান্দি রাজবাড়ি :- মুর্শিদাবাদ জেলাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে ভাগীরথী নদী। এই ভাগীরথী নদীর পশ্চিমপার রাড়বঙ্গের অংশ। মুর্শিদাবাদ জেলার এই অংশের ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়া খুবই শুষ্ক যা পূর্ব পারের থেকে একদমই আলাদা। এই অংশের মধ্যে পড়ছে কান্দি মহকুমা, যার কেন্দ্রবিন্দু কানা ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে অবস্থিত কান্দি শহর। এই কান্দি শহরেই অবস্থিত প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো কান্দি রাজবাড়ি । এই রাজ পরিবার বাংলার মহাজাগরন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো তার সাথে এই রাজ পরিবার থেকে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিরা বেরিয়েছিলেন যাদের আমরা চিনি। এই জমিদার বাড়িতে এখনো জমিদারবাড়ির বংশধরেরা বসবাস করছে, এখানে ছবি তোলা এবং ভিডিওগ্রাফি করার অনুমতি আছে চাইলে একদিনের জন্য এই কান্দি থেকে এসে ঘুরে যেতে পারেন, কান্দি রাজবাড়ি ছাড়াও কিছু সুন্দর সুন্দর অসাধারন মন্দির ও সাথে সাথে দর্শন করে নিতে পারবেন।
কান্দি রাজবাড়ি ছাড়াও কান্দি রাধাবল্লভ মন্দির যার ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যময়, এবং যার ইতিহাস বহু প্রাচীন। কান্দি রাজবাড়ি নবম শতকে লাল বাবুর পরিবারের গঙ্গা গোবিন্দ সিংহ দ্বারা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই জন্য এই বাড়িকে "লাল বাবুর বাড়ি" হিসেবে ও ডাকা হয়। গঙ্গা গোবিন্দ সিংহ সেন রাজা বল্লাল সেনের সমসাময়িক ছিলেন, এবং বল্লাল সেন এবং দিল্লীর পাঠান সুলতানদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। আর রাজপরিবারের নিজস্ব মন্দির রাধাবল্লভ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করছিলেন জমিদার গৌরাঙ্গ সিংহ। বৃহৎ এই মন্দিরে রাধা কৃষ্ণ, জগন্নাথদেব, গোপাল, গোপিনাথ মদনমোহন দেব প্রভৃতি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে।
এখানে কেমন করে পৌঁছবেন, কান্দি আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো আপনি সবার আগে বহরমপুর পৌঁছে, বহরমপুর থেকে সরকপথে কান্দি চলে আসতে পারেন। একদিনের জন্য ঘোরাঘুরির জন্য বেস্ট।
৫. পাঁচথুপি :- মুর্শিদাবাদ মানে শুধু নবাবি বা ব্রিটিশ ইতিহাস না। মুর্শিদাবাদের সাথে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন রাজা, জমিদার, জমিদারবাড়ির অজানা ইতিহাস। মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এরকমই কিছু অজানা কাহিনী। সেরকমই একটি জায়গা হলো মুর্শিদাবাদের বড়য়াঁ ব্লকের অন্তর্গত একটি সমৃদ্ধ জনপদ পাঁচথুপি। এই পাঁচথুপি নামের পেছনেও আছে আরো একটি ইতিহাস। পাল আমলে এখানেই পাঁচটি বৌদ্ধ স্তূপের অস্তিত্ব ছিল, সেই থেকেই এই গ্রামে নাম পঞ্চথুপি এবং বর্তমানে পাঁচথুপি এসেছে। এখানে আছে একটি জমিদারবাড়ি যার আবার তিনটি ভাগ, বড়, মধ্যম, নতরফ এবং কিছু মন্দির। এই পাঁচথুপি নিয়ে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গল্প আছে যার নাম" সপ্তর্ষি আর হারানো বিকেল"। সানডে সাসপেনসে ও এই গল্পটি আপনারা পেয়ে যাবেন।
মহারাজা আদিশূরের রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সোমঘোষের অধস্তন রাজা নরপতি ঘোষ প্রায় ৫০০ বছর আগে ময়ুরাক্ষী নদীর তীরে এই পাঁচথুপিতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই গ্রামে এখনো তার বংশধরেরা বসবাস করে থাকে। এই গ্রামের প্রায় সবকটি দুর্গা মন্দির দেখতে পাবেন যেখানে দুর্গা পূজা হয়ে থাকে। এই গ্রামে আসলে প্রথমেই দেখে নেবেন সিংহবাহিনী মন্দির। তারপর দেখে নেবেন পাঁচথুপি পুরাতন বাড়ি, এরপর চলে আসুন রাইজি বাড়িতে, অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই রাইজি বাড়ির বর্তমান অবস্থাও খুব জরাজির্ণ। এই বাড়িতেও দুর্গা মন্ডপ আছে। এরপর আপনারা চলে আসুন জমিদার জগন্নাথ ঘোষের প্রতিষ্ঠিত পঞ্চায়াতন মন্দির দেখতে এই মন্দিরের আরেক নাম নবরত্ন মন্দির। এবার চলে আসুন পাঁচথুপির মল্লিকপাড়াতে এখানকার প্রধান জমিদারবাড়ি দেখতে। এই মল্লিকপাড়া নামটি এসেছে ঘোষমল্লিক পরিবার থেকে। এই ঘোষমল্লিক পরিবারের তিনটি তরফ আছে এবং এই তিন তরফের তিনটি জমিদারবাড়ি এখানে আসলে দেখতে পাবেন একদম পাশাপাশিই। রাজা নরপতি ঘোষের বড় ছেলে প্রয়াগ ঘোষ নবাবের কাছ থেকে এই মল্লিক উপাধি টি পেয়েছিলেন। সব শেষে দেখে নেমে অধিকারী বাড়ি। পাঁচথুপির যেদিকের আপনি তাকান না কেনো আপনি মন্দির এবং পুরাতন বাড়ি দেখতে পাবেন।
এবার আসি কেমন করে এখানে পৌঁছাবেন, এই পাঁচথুপি গ্রামটি কান্দি মহকুমার বড়ঞাঁ ব্লকে অন্তর্গত। আপনি প্রথমে কান্দি এসে এই পাঁচথুপিতে চলে আসতে পারেন। দূরত্ব মাত্র ২০ কি.মি মতো।
৬. বেলডাঙার মোল্লা বাড়ি :- মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থানার অন্তর্গত মির্জাপুর গ্রাম। এই গ্রামেই অবস্থিত মোল্ল জমিদারবাড়ি। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেরামত মোল্লার বড় ছেলে শাহজাদ মোল্লা। কেরামত মোল্লার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলেই সবচেয়ে বেশি সাহসী ও পারদর্শী ছিলেন। তারা কিন্তু বেলডাঙার আদি বসবাস কারি ছিলেন না।
ব্রিটিশ আমল থেকেই শাহজাদ মোল্লার উত্থান শুরু হয়। তার প্রধান ব্যবসা ছিল রেশমের। এর রেশমের ব্যাবসা করে তিনি যথেষ্ট ধনশালী হয়ে ওঠেন এবং জমিদারির পত্তন করেন। এই মির্জাপুর গ্রামেই তিনি এক বিশাল জমিদারবাড়ি গড়ে তোলেন, যার বর্তমান অবস্থা খুবই ভগ্নপ্রায়। পরিবারের সদস্যরাও অনেকে এখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। জমিদার শাহজাদ মোল্লা খুবই দানশীল ও প্রজা বাৎসল ব্যক্তি ছিলেন। আপদে বিপদে তিনি সবসময় প্রজাদের সহায়তায় এগিয়ে আসতেন। এই পরিবারের জমিতেই গড়ে ওঠে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, তার মধ্যে প্রাইমারী স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, মাদ্রাসা, মসজিদ প্রভৃতি, এরকম বহু জায়গা বর্তমানে দখল ও হয়ে গেছে।
কেমন করে আসবেন - বেলডাঙা শহর থেকে এই মির্জাপুরের জমিদারবাড়ির দুরত্ব প্রায় ৫ কি.মি মতো হবে । বেলডাঙা শহর থেকে ৩৪ নং জাতীয় সড়ক বরাবর দক্ষিণ দিকে কিছুদূর গেলেই পড়বে আনসারের মোড়, এই মোড় থেকে আপনারা এরপর পশ্চিম দিকে কয়েক কি.মি যেতে হবে। তারপরেই আসবে এই মোল্লাপাড়া। গুগল ম্যাপ লোকেশন দেখে আসলে মোল্লাপাড়া বড় মসজিদ দেখে আসলেন এখানে পৌঁছে যাবেন তারপর যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হলো। বেলডাঙা স্টেশন থেকেও সরাসরি একটা টোটো রিজার্ভ করে এখানে চলে আসতে পারেন।
৭. সোনারুন্দি জমিদারবাড়ি :- মুর্শিদাবাদের আজানা অচেনা জমিদারবাড়ি খোঁজে এবার আমরা যাবো জেলার সর্ব দক্ষিণে সোনারুন্দি গ্রামে আরো একটি জমিদারবাড়ির খোঁজে। এই জমিদারবাড়িকে সোনারুন্দি বনওয়ারীবাদী হয়ে থাকে। বনওয়ারী কথাটি এসেছে তাদের কুলদেবতা থেকে। এই জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার নিত্যানন্দ দালাল। নিত্যানন্দ দালানের বাবার নাম ছিল জগমোহন দালাল।
জমিদার নিত্যানন্দ দালাল আরবী ফার্সি ভাষায় খুবই পারদর্শী ছিলেন সেই জন্য দিল্লির সুলতান দ্বিতীয় শাহ আলমের খুবই প্রিয় পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। এবং দিল্লির দরবারে উচ্চপদও পেয়েছিলেন। কালক্রমে মারাঠা আক্রমনের জন্য শাহ আলম কিছুদিন কাটোয়াতে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় এই এলাকা বর্ধমানের রাজার অধিকারে ছিল, শাহ আলম বর্ধমানের রাজার সাথে কথা বলে এই জমিদারি নিত্যানন্দ দালাল কেদেন এই ভাবেই সোনারুন্দি বনওয়ারীবাদী জমিদারবাড়ির পত্তন হয়। অনেকটা এলাকা নিয়ে এই জমিদারবাড়ি। ভিতরে রাধা কৃষ্ণের মন্দিরও আছে। পাশেই একটি স্কুলে আছে বনওয়ারী নামে। যা রাজ পরিবারের জমিতেই তৈরি করা হয়েছে। জমিদার বাড়ির গেট থেকে শুরু অনেকটার অবস্থাই বর্তমানে ভঙ্গুর।
কেমন করে যাবেন এই সোনারুন্দি জায়গাটি মুর্শিদাবাদের সালারের কাছে স্থিত একদম মুর্শিদাবাদ জেলা এবং পূর্ব বর্ধমান জেলার বর্ডারে কাটোয়া থেকেও এটি খুব কাছে। কাটোয়া বা বহরমপুর যেখানে কোনো জায়গা থেকে ট্রেন বা বাইরোডে এখানে চলে আসতে পারেন। ট্রেনে আসতে হলে আপনাকে নামতে হবে গঙ্গাটিকুরী স্টেশনে বা সালারেও নামতে পারেন। তারপর টোটো করে সোজা এই জমিদারবাড়ি।
৮. নশীপুর রাজবাড়ি :- মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর মুর্শিদাবাদ বা লালবাগের একদম উত্তর প্রান্তে অবস্থিত এই নসীপুর রাজবাড়ি। এই রাজবাড়ির সাথে লেগে আছে বহু গরিব, কৃষকের রক্তের দাগ। কারণ এই জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সেই সময়ে বাংলার সবচেয়ে অত্যাচারী নৃশংস জমিদার দেবী সিংহ। এই দেবী সিংহের নাম হয়তো কম বেশি প্রায় সকলেই শুনছি। তিনিই এই জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। এবং বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটি আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা নির্মাণ করেন জমিদার কীর্তি চন্দ্র সিংহ বাহাদুর ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
পলাশীর যুদ্ধের পর থেকেই লর্ড ক্লাইভের আমলে দেবী সিংহের উত্থান শুরু হলেও হেস্টিং আমলে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। তিনি ইজারাদার থেকে বাংলার Tax Collector পদে বসেন কারন তিনি খুবই অত্যাচারী ছিলেন এবং তিনি তার নৃশংস অত্যাচারের মাধ্যমে চাষিদের বাধ্য করতেন রাজস্ব জমা করার জন্য। যারা কর দিতে পারতো না, সোনা যায় তাদের জমিদারবাড়ির অভ্যন্তরেই ফাঁসিতে ঝোলানো হতো। তার ট্যাক্স আদায়ে ব্রিটিশ সরকার খুবই খুশি ছিলো তাকে বিভিন্ন অংশে জমিদারি অর্পণ করে ব্রিটিশ সরকার। তার এইসব অমানবিক কাজ কর্মের ফলে সেইসময়ে রংপুর ও দিনাজপুরে প্রজা বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিলো। সেই অত্যাচারী দেবী সিংহ আর নেই কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিতো বাড়িটি (পুরাতন জমিদারবাড়ি) এখনো রয়ে গেছে, রয়ে গেছে ফাঁসির সেই ঘর।
মুর্শিদাবাদ ঘুরতে আসলে এই জমিদারবাড়ি অবশ্যই একবার ঘুরে যেতে পারেন ।কাঠগোলা বাগান বাড়ির খুব কাছেই এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত, প্রবেশ মুল্য মাত্র ১৫ টাকা।
৯. কাশিমবাজার বড়ো রাজবাড়ি :- মুর্শিদাবাদ গোটা বাংলা, বিহার ওড়িশার রাজধানী হওয়ার আগে থেকেই কাশিমবাজার ছিল বড়ো ব্যবসায়িক কেন্দ্র। বাব্যসা বানিজ্যের জন্য বিভিন্ন বনিক নাবিকরা এই কাশিমবাজারে আসতো, তাই প্রাচীনকাল থেকেই এই কাশিমবাজার একটি সমৃদ্ধ এলাকা ছিল। পরবর্তীতে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে এই কাশিমবাজারের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পায়। এই কাশিমবাজারের শ্রীপুর এলাকায় কৃষ্ণকান্ত নন্দী ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে একটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন যাকে স্থানীয়রা কাশিমবাজার বড় রাজবাড়ি বা শ্রীপুর রাজবাড়ি হিসাবেও ডেকে থাকে। কাশিমবাজার নামের উৎপত্তির পেছনে বিভিন্ন মতামত আছে, তবে সংখ্যা গরিষ্ঠের মত অনুযায়ী তখনকার সুবা বাংলার প্রধান কাশিম খাঁ থেকেই এই নামটি এসেছে, তিনি সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে পর্তুগীজ দলদস্যুদের দমন করেছিলেন।
কৃষ্ণকান্ত নন্দী ইতিহাসে কান্তমুদি নামেও পরিচিত ছিলেন, কৃষ্ণকান্ত নন্দীর পিতার একটি মুদির দোকান ছিলো একদম ব্রিটিশ কুঠির সামনে। নবাব সিরাজ যখন কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করেছিলো তখন এই কৃষ্ণকান্ত নন্দী হেস্টিংস আশ্রয় দিয়েছিলো এবং এবং তাকে কলকাতা পালিয়ে যেতে সাহায্যও করেছিলো। পরিবর্তীতে হেস্টিংস যখন বাংলার গভর্নর হোন তখন হেস্টিংস কথা মত দিল্লির সম্রাট কান্তবাবুর পুত্র লোকনাথ রায় বাহাদুরকে জমিদারির বন্দোবস্ত দেন এভাবেই এই জমিদারির সূত্রপাত হয়।
বহরমপুর শহরের উপকন্ঠেই এই কাশিমবাজার অবস্থিত। সেইজন্য সর্বপ্রথম আপনাকে বহরমপুরে পৌঁছতে হবে, এছাড়া কাশিমবাজারে একটি রেলস্টেশনও আছে আপনি সরাসরি কলকাতা থেকে ট্রেন এই কাশিমবাজারে চলে আসতে পারবেন। এই রাজবাড়ি ছাড়াও আরও একটি রাজবাড়ি আছে যা বয়সে নতুন যা এখন বিলাসবহুল হোটেলে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
১০. কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ি :- কাশিমবাজার বড় রাজবাড়ির পাশেই আছে আরো একটি রাজবাড়ি যাকে স্থানীয়রা কাশিমবাজার ছোটো রাজবাড়ি হিসেবে অভিহিত করে থাকে। আলিবর্দি খার আমলে এই রাজবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করেন দীনবন্ধু রায় ১৭৩৫ খ্রিস্টাব্দে। তাদের প্রকৃত উপাধি ছিল চট্টোপাধ্যায় কিন্তু এই রায় উপাধি টা তাদের পাওনা। দীনবন্ধু রায়ের পর কমলা রঞ্জন রায় এবং তার ছেলে প্রশান্ত রায় বর্তমানে জীবিত আছেন।
এই রাজবাড়িটি বর্তমানে খুবই ভালো অবস্থায় আছে সেটা আপনার দেখলেই বুঝতে পারবেন, তার কারণ ই হলো এই বাড়িটিকে বর্তমানে একটি হেরিটেজ হোটেলে রূপান্তরিত করে দেওয়া হয়েছে। তাই একমাত্র বুকিং থাকলেই আপনি ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন তাছাড়া কোনো পারমিশন নেই। আপনি অনলাইন সাইটে গুলো থেকে এখানে বুকিং করতে পারবেন। এখানে আসার ব্যাপারটা আমি আগের পয়েন্টেই বলেছি দেখে নেবেন।
১১. কাঠগোলা বাগান বাড়ি :- এখন যেটা নিয়ে আলোচনা করবো সেটি কোনো জমিদারবাড়ি বা রাজবাড়ি নয়, বা কোনো জমিদারের প্রতিষ্ঠিত নয়। এই কাঠগোলা বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জিয়াগঞ্জের মারওয়ারী লক্ষ্মীপদ সিং দুজ্ঞার। এই মারওয়ারী ব্যাবসায়ীরা খুবই ধনশালী ছিলেন, তাদের ব্যবসা ভারতের প্রতিটি অঞ্চলে এমনি কি বিদেশের সাথেও ছিল, মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী হলে এই ব্যাবসায়ীরা মুর্শিদাবাদের আসে পাশে তাদের ঘাঁটি গাড়ে, বর্তমানে আজিমগঞ্জ জিয়াগঞ্জ এলাকায় এখনো জৈন সম্প্রদায় ভুক্ত এই মারওয়ারী অবাঙালিদের দেখতে পাবেন। তাদের কাছে এত অর্থ থাকতো যে তারা সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী থেকে শুরু করে নবাবকেও অর্থের দরকার পড়লে তা যোগান দিতো। তাদের বাগান করার খুবই সখ ছিল সেই উদ্দেশ্যেই লক্ষ্মীপদ সিং দুজ্ঞার এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। তবে বাড়ি কবে নির্মাণ হয়েছিলো সে ব্যাপারে অনেকেরই ভিন্ন মত আছে।
এই বাগান বাড়িতে একটি গোপন সুরঙ্গপথও আছে যেসুরঙ্গপথ দিয়ে সরাসরি জগৎশেঠ প্রাসাদের সাথে যুক্ত ছিল। অর্থের লেনদেন এবং ব্যাবসায়িক কাজের জন্য এই পথটি ব্যবহৃত হতো। লক্ষ্মীপদ সিং দুজ্ঞার তার বাড়িতে একটি সুন্দর বাগান গড়ে তুলেছিলেন তার সাথে প্রতিদিনই বাইজিদের নাচের আসর বসতো এখানে। দেখতে ভারি সুন্দর এই বাড়িটি একবার হলেও ঘুরে যেতে পারেন ।
এটি মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তরে হাজারদুয়ারী প্যালেস থেকে ৩ কি.মি উত্তরে নসীপুর রাজবাড়ির খুব কাছেই এটি অবস্থিত। আপনারা যখন মুর্শিদাবাদ আসার প্ল্যান করবেন তখন এই কাঠগোলা বাগান বাড়িটিও দেখে নিতে পারবেন একসাথে।
১২. সালারের চৌধুরী জমিদারবাড়ি :- মুর্শিদাবাদের দক্ষিণে কান্দি মহকুমার অন্তর্গত সালার। এই সালার নামটি এসেছে আরবি বা ফার্সি শব্দ থেকে। সালার শব্দের অর্থ সেনাপতি বা প্রধান। এই সালারেই আছে প্রভাবশালী চৌধুরী পরিবার ও তাদের একটি পুরনো জমিদারবাড়ি। এই চৌধুরী বাড়ির একজন বংশধর এখনো জীবিত আছে যিনি এখনো এই বাড়িতেই বসবাস করছেন।
এই জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এনায়েতুল্লা। এই এলাকা পূর্বে রানী ভবানীর অধিকারের ছিল রানী ভাবানীই এই এলাকা এনায়েতুল্লার হাতে দিয়েছিলেন, যার ফলেই এই জমিদারির যাত্রাপথ শুরু হয়। এনায়েতুল্লার সাথে ব্রিটিশদের বিরোধও যার জন্য ব্রিটিশরা এনায়েতুল্লা কে কামানের সামনে বেঁধে তাকে হত্যা করেন।
বিরাট এই জমিদারবাড়ির অনেকাংশই আজ শেষের পথে দিন গুণছে কিছু অংশে এখনো জমিদারবাড়ির বংশধরেরা বসবাস করছে। আপনি সালাল কেমন করে আসবেন। আপনি বহরমপুর থেকে ট্রেন বা সড়কপথে এই সালার চলে আসতে পারেন, যারা কলকাতা দিক থেকে আসবেন তাদের প্রথমে কাটোয়া পৌঁছতে হবে এবং কাটোয়া থেকে সড়কপথে বা ট্রেনে এই সালার খুব কাছেই।
১৩. তালিবপুর জমিদারবাড়ি :- এখন যে জমিদারবাড়ি টির কথা এখন আপনাদের বলবো সেটা সমন্ধে হয়তো অনেকেই জানেন না, হ্যাঁ ছোট্ট একটি গ্রাম তালিবপুর সেই গ্রামেই আছে বিরাট এক জমিদারবাড়ি, যা মুর্শিদাবাদের সালারের খুব কাছেই অবস্থিত। ষোড়শ শতকে মৌলানা ফুসি মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রতিনিধি হিসেবে এই গ্রামে বসবাস শুরু করেন তার হাত দিয়েই এই জমিদারির সূত্রপাত হয় তারপর তার ছেলে দীন মহম্মদ এবং তার ছেলে পীর মহম্মদ এই বংশের নামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান তারা বিভিন্ন জনহিতকর কাজের সাথেও যুক্ত ছিলেন।
বর্তমানে এই জমিদার বাড়িটির অনাস্থা যা দেখলাম, তা শেষের অপেক্ষায় দিন গুনছে, জমিদার বাড়ির অনেক অংশ ই আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে আধুনিক বাড়ি নির্মাণ হয়ে গেছে। এবার আসি এখানে কেমন করে আসবেন বহরমপুর শহর থেকে এর দুরত্ব ৬০ কি.মি। আপনি চাইলে ট্রেনেও আসতে পারেন আজিমগঞ্জ - কাটোয়া লাইনের যেকোনো ট্রেন ধরে চলে আসুন সালাল স্টেশনে সেখান থেকে টোটো বা পাশেই তালিবপুর - মালিহাটী বলে একটি স্টেশন আছে সেখানে নামলে আরো কাছে হবে, একইরকম ভাবে আপনি চাইলে কাটোয়ার দিক থেকেও এই তালিবপুর গ্রামে চলে আসতে পারেন।
১৪. ভগীরথপুর জমিদারবাড়ি :- শোনা যায় মুঘল আমলে বানিজ্যিক সূত্রে ভগীরথ শাহু নামক বণিক ওই স্থানে আসেন, এবং মনোরম পরিবেশ তাকে আকর্ষিত করে। ফলে তিনি সেখানেই থেকে যান। যার জন্য এই গ্রামের নাম হয় ভগীরথ পুর । তথ্য সূত্র অনুসারে ১১৬৮বঙ্গাব্দের ১৭ ই ফাল্গুন বাড়ি নির্মাণ শেষ হয় । জমিদারবাড়িটি এখনো এখানে আছে কিন্তু বর্তমানে জমিদার বংশের কেউ নেই। শোনা যায় তারা নাকি সবাই এই স্থান ছেড়ে চলে গেছেন।
জমিদারী ছিল খাগজানা , কুমিরদহ , লালবাগ বর্ডার , গৌরিপুর , শিবনগর । এই জমিদার বংশের প্রখ্যাত জমিদারগন -- নীলকৃষ্ণ চৌধুরী , শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী , চারুকৃষ্ণ চৌধুরী , সুব্রহ্মণ্যকৃষ্ণ চৌধুরী (বঙ্কুবাবু) , শ্যামলাল চৌধুরী ও গায়ত্রী চৌধুরী।
কেমন করে আসবেন :- বহরমপুর - জলঙ্গী রাজ্য সড়ক ধরে ডোমকল এবং সেখান থেকে দক্ষিণে মাত্র ৯ কিমি পথ। অন্যদিকে বহরমপুর- আমতলা সড়ক ধরে স্বরূপ পুরের পথ এবং সেখান থেকে সুন্দল পুর ঘাট পাড় হয়ে চলে যেতে পারেন ভগীরথপুর।
১৫. জজান জমিদারবাড়ি :- গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলায় সেইসময় আদিশূরের রাজত্ব চলছিলো, সেই আদিশূরের রাজসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সোম ঘোষ। তিনিই তার রাজধানী হিসেবে জজান কে বেছে নেন এইভাবেই জজানের উত্থান ঘটে। প্রাচীনকালে এই জজান একটি সমৃদ্ধ নগরী ছিল। যা মুর্শিদাবাদের কান্দি শহর থেকে মাত্র ৭ কিমি দূরে অবস্থিত।
সোম ঘোষের বংশধরের দ্বারাই এই জমিদার বাড়ির পত্তন ঘটে। কেনারাম ঘোষ ছিলেন এই বংশের একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। তার পুত্র কৃষ্ণধর ঘোষের সময় থেকেই এই জমিদারির উত্থান ঘটে তার আমলেই এই বাড়ি নির্মিত হয়। তার সাথে কান্দি জমিদার বাড়ির বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই জমিদারবাড়ির অবস্থাও বাকি বাড়ি গুলোর মত জরাজির্ণ সংকটজনক, এখনো এই বাড়িতে জমিদারবাড়ির কেউ কেউ বাস করে। এখানে এই জমিদারবাড়ি ছাড়াও কিছু সুন্দর সুন্দর মন্দির ও আছে দেখার মত।
এই জমিদার বাড়িতে পৌঁছতে আপনাকে সবার আগে কান্দি পৌঁছতে হবে। কান্দি থেকে টোটো করে আপনি এই জজানে পৌঁছে যেতে পারেন। এই কান্দি কে কেন্দ্র করে আপনারা কিন্তু প্রায় অনেক গুলোই জমিদারবাড়ি দেখে ফেলতে পারেন, তাই একদিন কান্দি তে থেকে আপনারা অনেকটা কভার করে নিতে পারবেন। এই ব্লগে আমি অনেকগুলো জমিদারবাড়ির খোঁজ আপনাদের দিলাম।
১৬. আজিমগঞ্জ রানী ভবানীর রাজবাড়ি :- রানী ভবানী ছিলেন বাংলাদেশের নাটোরের মহারানী। নাটোরে তার এক বৃহৎ রাজবাড়ি আছে। যেটা বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলায় অন্তর্গত। ১৭৫৩-১৭৬০ এই সাতবছর তিনি আজিমগঞ্জ বড়নগরে ভাগীরথীর পশ্চিম পারে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় তিনি এই বড়নগরকে দ্বিতীয় বারানসী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রায় ১০৮ খানা টেরাকোটার শিব মন্দির গড়ে তুলেছিলেন, যার বেশিরভাগ ই এখন ভাগীরথীর গ্রাসে চলে গেছে, এছাড়াও তিনি এখানে থাকার জন্য একটি বাড়ি ও নির্মাণ করেছিলেন।
যেই বাড়িটি বর্তমান স্থানীয় মানুষেরা রানী ভবানীর রাজবাড়ি বলে থাকে। এখনো এই বাড়িতে লোক বসবাস করছে। আপনারা যারা আজিমগঞ্জে ঘুরতে আসেন তারা এই বাড়িটিকে না দেখেই চলে যান। রানী ভবানীর সৃষ্ট এতো মন্দির যখন দেখবেন তখন এই রাজবাড়ি টাও একবার দেখে যেতে পারেন।
১৭. ভাবতা জমিদারবাড়ি :- মুর্শিদাবাদের জেলা সদর বহরমপুর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরে বেলডাঙা ব্লকে অন্তর্গত এই ভাবতা গ্রাম। এই ভাবতা গ্রামেই আছে ভাবতা জমিদারবাড়ি। এই জমিদারবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজী আব্দুল আজিজ।
হাজী আব্দুল আজিজ মুর্শিদাবাদের একজন স্বনামধন্য ব্যাবসায়ী ছিলেন তার সাথে সাথে তিনি বহু জনহিতকর কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি তার পরিবার রেশমের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন, ব্যবসা থেকে অনেক অর্থ উপার্জনের পর তিনি এই জমিদার শুরু করেন। এই ভাবতা গ্রামে আসলে এই জমিদারবাড়ি এখনো দেখতে পাবেন।
বহরমপুর থেকে প্রায় ১৫ কি.মি দূরে এই ভাবতা গ্রাম যা ৩৪ নং জাতীয় সড়কের ওপরে অবস্থিত। ভাবতা মোড় থেকে এই জমিদারবাড়ির দুরত্ব মাত্র ১ কি.মি। ট্রেনে চাইলে ভাবতা স্টেশন ও আছে সেখানে ও নামতে পারেন।
১৮. কুঞ্জুঘাটা জমিদারবাড়ি :- বহরমপুর শহরের একদম উত্তরপ্রান্তে কুঞ্জুঘাটাতে ভাগীরথী নদীর তীরে মহারাজা নন্দকুমারের এক সুবিশাল রাজবাড়ি ছিলো। কালের কড়াল গ্রাসে যার অল্প কিছুই এখন অবশিষ্ট আছে। এটি কুঞ্জুঘাটা রাজবাড়ি নামেই খ্যাত।
মহারাজা নন্দকুমারের আদি বাসস্থান বীরভূম জেলাতে, মির্জাফরের সময়ে তিনি তার দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। পরিবর্তীতে তিনি রাজা উপাধিও লাভ করেন। সেইজন্য মুর্শিদাবাদে ভাগীরথীর পাশে তিনি এই রাজবাড়ি নির্মাণ করেন ।এখানে আসতে চাইলে কুঞ্জুঘাটা ঘাটের কাছে এসে যে কাউকে বললেই দেখিয়ে দেবে।
এবার আরো দুটো জমিদারবাড়ির সন্ধান দেবো যেগুলো কিন্তু মুর্শিদাবাদে কিন্তু অবস্থিত না, কিন্তু মুর্শিদাবাদের একদম লাগোয়া। পুরোনো দিনে হয়তো এক জায়গা গুলোও মুর্শিদাবাদের অংশ ছিল। মুর্শিদাবাদ এই জমিদারবাড়ি গুলো অবস্থিত না হলেও, এই জায়গা গুলোতে আসতে হলে মুর্শিদাবাদের প্রাণকেন্দ্র বহরমপুর হয়েই প্রধানত আপনাকে আসতে হবে। বহরমপুর শহর থেকে খুবই সহজে এই জমিদারবাড়ি দুটোতে আসতে পারেন। প্রথমেই আসি...
১৯. করিমপুরের জমশেরপুর গ্রামের বাগচী জমিদারবাড়ি:- এই জমিদারবাড়িতেই বল্লভপুরের রূপকথার শুটিং হয়েছিলো। "কাজলা দিদি" খ্যাত কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর জন্মভিটে।
জায়গাটি হলো নদিয়া জেলার করিমপুর ব্লকের জমশেরপুর গ্রামের বাগচী জমিদারবাড়ি। এখানে দুটো জমিদারবাড়ি আছে একটা নতুন একটা পুরনো আরো কিছু স্থাপত্য, মন্দির এখানে আসতে দেখা যাবে।
ভিডিও লিঙ্ক - বাগচী জমিদারবাড়ি
২০. গঙ্গাটিকুরী জমিদারবাড়ি :- একদম মুর্শিদাবাদের বর্ডার লাগোয়া দ্বিতীয় জমিদারবাড়িটি হলো এই গঙ্গাটিকুরী জমিদারবাড়ি বা রাজবাড়ি। এটির অবস্থান পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম-2 ব্লকের অন্তর্গত গঙ্গাটিকুরী গ্রাম। এই গ্রামের রাস্তার এপার পূর্ব বর্ধমান এবং ওপার মুর্শিদাবাদ জেলা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন