বাহিন জমিদারবাড়ির সম্পূর্ন ইতিহাস, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর

।। বাহিন জমিদারবাড়ি।।

ভ্রমণ পিপাসু :- উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের 8 নং বাহিন গ্রাম পঞ্চায়েত বিহার সংলগ্ন নাগর নদীর পাড়ে নির্মিত বাহিন জমিদারবাড়ি যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরী। রায়গঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৪ কি.মি দূরে রাধিকাপুর - কাটিহার রেললাইনের পাশে অবস্থিত বাহিন গ্রাম, সেখানে বসবাস, ব্যবসা বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও যাতায়াতের সুবিধার্থে বাহিন জমিদারবাড়ি স্থাপন করা হয়। এই জমিদারবাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে ইটাহারের চুরামন রায়চৌধুরী পরিবারের নাম। প্রায় ৪০০ বছর আগে তৈরি এই জমিদারবাড়ি আজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তার পুরোনো গৌরব হারিয়ে খুবই শঙ্কটজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। এই জমিদারবাড়ির পুরোনো জাঁকজমক আজ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। উত্তর দিনাজপুরের তথা রায়গঞ্জের প্রসিদ্ধ পর্যটনস্থল গুলির মধ্যে একটি, যার সুখ্যাতি জেলার বাইরেও আছে। বর্তমানে এই বাহিন জমিদারবাড়িটি কে পুলিশ ফাঁড়িতে রূপান্তরিত করা হয়েছে।


বাহিন জমিদার বাড়ি তৈরির পেছনের ইতিহাস :- বাহিন রাজবাড়ি বলে এটি সকলের কাছে পরিচিত হলেও আসলে এটি ছিল একটি জমিদারবাড়ি, এবং এই জমিদারবাড়ি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার ইশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী। আমি আগের পয়েন্টেই বলেছিলেন এই জমিদারবাড়ির সাথে জড়িয়ে আছে ইটাহারের চুরামন রায়চৌধুরী পরিবারের নাম। চুরামন রায় চৌধুরী পরিবারের শরিকরাই এই প্রায় ৪০০ বছর আগে এই জমিদারবাড়িটি তৈরি করেন। চূড়ামনে জমিদার মহেন্দ্র প্রসাদ রায়চৌধুরীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না, ভারতবর্ষে চিরকাল দত্তকপুত্র গ্রহনকারীর কাছে আইনসঙ্গত উত্তরাধিকারী রূপে গন্য হয়ে থাকে, তাই জমিদার মহেন্দ্র প্রসাদ রায়চৌধুরী ইশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী কে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এরপর থেকেই চূড়ামন জমিদারবাড়ি অন্তকলহ দেখে দেয়। যার ফলে জমিদারির কিছু অংশ ইশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী কে দেওয়া হয়। ওই চূড়ামন জমিদারবাড়িতে থেকে ইশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরীর পক্ষে আর জমিদারি পরিচালনা আর সম্ভব ছিল না, কারণ অন্তর্কলহ একদম চরমে পৌঁছে গিয়েছিল, তাই তিনি ওই জমিদারবাড়ি ছেড়ে বাহিনে চলে এসেছিলেন, এবং এখানে গড়ে তুলেছিলেন এই ভব্য জমিদারবাড়ি।

আরো পড়ুন - উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের কুলিক নদী ।


জমিদার বাড়ি নির্মাণ ও গঠন :- জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী অনেক ভেবে চিন্তেই এই জায়গাটি কে বেছে নিয়েছিলেন তার জমিদারবাড়ি নির্মাণের জন্য। এই এলাকাটি অনেকটা চূড়ামনের সামঞ্জস্য ছিলো। দুটি জমিদারবাড়িই একদম নদী তীরবর্তী এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছিলো, চূড়ামন ছিল মহানন্দা নদীর তীরে এবং বাহিন নাগরের তীরে। বাড়িটি ছিল পশ্চিমমুখী। তার একদম সামনেই ছিল নাগর নদী। নদীর ওপারেই বিহার রাজ্য। এই নদীর অপর পারে বিহারেরও তাদের জমি ছিল। এই সুউচ্চ দোতলা বাড়িটিতে অনেকগুলোই ঘর ছিল। ঘর গুলোতে ঝাড়বাতি ঝুলানো থাকতো। বাড়ির প্রতিটি ঘরেই বড় দামী দামী কারুকার্য দরজা জানালা ছিল। বাড়িটির দুদিকেই সুদীর্ঘ বারান্দা ছিল। বাড়ির দোতলার বারান্দায় বসে জমিদারবাড়ির লোকেরা নাগর নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতেন। জমিদারবাড়ির অনেকে সুরম্য নৌকায় চড়ে নাগর নদী ভ্রমন করতেন। 

এই জমিদারবাড়িতে একটি ঠাকুরবাড়িও ছিল, সেই মন্দিরে দেবী সিংহবাহিনীর পূজা খুব নিষ্ঠা ও ধুমধামের সহকারে করা হতো। দূরদুরান্ত থেকে বহু মানুষ এই পুজোয় যোগ দিতে আসতো। এখনো এই পূজা হয়ে আসছে। জমিদারবাড়ির লোকেরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে বর্তমানে গ্রামবাসিদের উদ্যোগেই এই মা সিংহবাহিনীর পূজা হয়ে আসছে, যা আজ সার্বজনীন পুজোতে পরিণত হয়ে গেছে।

Bengal - Bihar bordar Nagar river, Bahin.

বাহিনের কাছেই ভাতঘরাতে তাদের আরও একটি নিবাস ছিল। জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রচুর পরিশ্রমের ফসল এই বিশাল জমিদারি। উত্তর দিনাজপুরের রাধিকাপুর, কালিয়াগঞ্জ, গুলন্দর, দক্ষিণ দিনাজপুরের হরিরামপুর এবং মালদা জেলার কিছু অংশ এমনকি বিহারের বিঘোর সংলগ্ন এলাকায় ও তাদের জমি ছিল। গুলন্দর এবং হরিরামপুরের হাট তাদের হাতে ছিলো যে হাট গুলা থেকে কয়েক লাখ টাকা আয় হতো। জমিদার বাড়ির অদূরেই পাইক বা বাড়ির পাহারাদারদের বাসবাস স্থান ছিল, জমিদারদের পক্ষ থেকেই তাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। বাহিন গ্রামেই আছে আমলাপাড়া, যেখানে জমিদারবাড়ির গোমস্তাদের বাস ছিল। তারা এই বিশাল জমিদারীর হিসাব নিকাশ রাখতেন।

Bahin Rail Bridge, Nagar river. 

বংশ পরিচয় : - বাহিন জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা ঈশ্বরচন্দ্র রায়চৌধুরী ছিলেন চূড়ামনের জমিদার মহেন্দ্র প্রসাদ রায়চৌধুরীর দত্তকপুত্র। তার তিন ছেলে ছিল, বড় ছেলে ক্ষিতীশ রায়চৌধুরী শিকার করা খুব পছন্দের ছিল। তিনি ইংরেজ অফিসারদের সাথে বাঘ ও শিকার করেছিলেন। তার মেজো ছেলে হরেন্দ্রনাথ চৌধুরী পুরো জমিদারি দেখাশোনা করতেন। তার উদ্যোগে একটি গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছিল যার বর্তমান নাম বন্দে মাতরম্ লাইব্রেরি। এই জমিদারবাড়িতে ভুবনেশ্বরী নামে একটি থিয়েটার হলঘর ছিল, লখনৌ থেকে বহু বাঈজি এসে নাচগান করতো। জমিদার হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার ছেলে সত্যনারায়ন রায়চৌধুরী এই জমিদারি কিছুদিন পরিচালনা করেছিলেন, তার আমলেই এই জমিদারির অবসান ঘটে।


তথ্য সহযোগিতায় - শ্রী বৃন্দাবন ঘোষ। 

1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন