ভ্রমণ পিপাসু :- সুন্দরবন একাধারে ভারতের বৃহত্তম ডেলটা বা বদ্বীপ, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য, ভারতের অষ্টম বৃহত্তম জাতীয় উদ্যান এবং তার সাথে UNESCO ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা। এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় রয়াল বেঙ্গল টাইগার। রাজ্য তথা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদে একবার হলেও আমাদের ভিজিট করে দরকার।
ভিডিও টি দেখুন - গুজরাট ভ্রমনের সমস্ত তথ্য ।
সুন্দরবন কিন্তু আমাদের দেশের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশেও মধ্যেও পড়ছে, বলতে গেলে বেশিরভাগটাই, বাংলাদেশের বরিশাল ডিভিশনে সুন্দরবনের প্রায় ৬০% অবস্থিত আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাতে পড়ছে বাকি ৪০% শত শত নদী ও তাদের শাখা ও উপনদী, গহন অরণ্য,জীববৈচিত্র্য, বিশেষ ধরনের ম্যানগ্রোভ গাছ যেমন সুন্দরী গরান গেঁওয়া, এতো কিছু পাবেন এই সুন্দরবনে।
সুন্দরবন ভ্রমণ নিয়ে অনেকে হয়তো ভেবেছেন, অনেকে হয়তো এখনো ভাবেননি, যারা এখনো ভাবেন নি তাদের বলবো তারা চটপট সুন্দরবন ভ্রমণের একটা পরিকল্পনা করে ফেলুন, এখানে যে সময়ই আসুন না কোনো সময়ই নিরাস হবেন না। আর এই ব্লগে সুন্দরবন ভ্রমণ নিয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো যাতে আপনাদের সুন্দরবন ভ্রমণ আরো সহজ হয়। লেখাটা পুরো পড়বেন, সুন্দরবন নিয়ে সমস্ত কিছু আপনাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
সুন্দরবন কেমন করে পৌঁছোবেন :- সুন্দরবন পৌঁছনোর জন্য আপনাদের সবার প্রথমে দক্ষিণ 24 পরগনার ক্যানিং শহরে পৌঁছতে হবে, সুন্দরবন ভ্রমণের ৮০% এই ক্যানিং থেকেই শুরু হয়, ক্যানিং কে সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ও বলে।গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং এর প্রিয় জায়গা ছিল এই ক্যানিং তিনি এখানে প্রায়ই আসতেন তিনি এখানে একটা বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন, যদি ও সেটা আর হয়ে ওঠেনি, ক্যানিং সাহেবের থাকার জন্য এখানে একটা বসতবাড়ি ছিল, সেই জরাজীর্ণ বাড়িটি বর্তমানে হেরিটেজ কমিশন থেকে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করে সংস্কার করা শুরু করেছে, এখানে আসলে এই বাড়িটি অবশ্যই দেখে যাবেন। শিয়ালদা থেকে সকালের ক্যানিং লোকাল ধরে (৫.৪৫,৬.৩০, ৭.৪২) ধরে ১০ টাকার বিনিময়ে চলে আসুন ক্যানিং স্টেশনে, চেষ্টা করবেন ওপরে দেওয়া সকালের এই তিনটি ট্রেনকে ধরার, তারপরেও ট্রেন আছ কিন্তু পরের ট্রেন গুলোতে আসলে আপনাদের লেট হয়ে যাবে। সময় লাগবে পৌঁছতে প্রায় ১ ঘন্টা। ক্যানিং স্টেশন থেকে এবার আপনাদের ঘাটে যেতে হবে এখানে প্রধানত দুটো ঘাট আছে যেখান থেকে সুন্দরবন ট্রিপের লঞ্চ গুলো ছাড়ে, একটা হলো বাসন্তীর কাছে সোনাখালি ঘাট যেখানে অটো করে পৌঁছতে টাইম লাগবে প্রায় ৪০ মিনিট। আর দ্বিতীয়টি গোসাবার কাছে গদখালি ঘাট যেতে প্রায় ১ ঘন্টা। অটো ভাড়া ৩০-৪০ টাকার মধ্যে।
সুন্দরবন ভ্রমণের উপযুক্ত সময় : - খারাপ আবহাওয়া, ঘূর্ণীঝড়, প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত এগুলোকে বাদ দিলে আপনি সারাবছরই সুন্দরবন আসতে পারেন। যদি ও সুন্দরবন ভ্রমনের উপযুক্ত সময় হলো ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত, এই সময় গরমটা কম থাকে, তাছাড়া সুন্দরবন ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষনীয় রয়াল বেঙ্গল টাইগার দেখার সম্ভাবনাও খুব বেশি থাকে, কারণ এই সময় বাঘ রোদ তাপানোর জন্য জঙ্গল থেকে বাইরে নদীর ধারে আসে। যদিও বাঘ দেখার সম্ভবনা পুরোটাই আপনাদের ভাগ্যের ওপরে নির্ভর করবে, আপনার ভাগ্য যদি খুব খুব ভালো হয় তাহলে কিছুটা সম্ভাবনা আছে, সেটা আমি আগেই বলে দিলাম, বাঘ না দেখতে পেলেও বিভিন্ন ধরনের প্রাণী, জন্তু জানোয়ার আপনাদের দৃষ্টিগোচর হবে।
এখন আপনারা মনে মনে ভাবছেন তাহলে শীতেই সুন্দরবন ভ্রমণ উপযুক্ত হবে। এটা ভাবার আগে একবার খালি আপনারা বর্ষাতে সুন্দরবন থেকে ঘুরে যাবেন, আপনাদের কথা দিচ্ছি একদম অভিভূত হয়ে যাবেন। বর্ষাকালের সুন্দরবনের প্রকৃতি শীতকালের চেয়ে, ঢের বেশি সুন্দর। আপনাদের মনে হবে আপনারা একটা আলাদা জগতে আছেন। তাছাড়া বর্ষাতে সুন্দরবনে ইলিশ উৎসব হয় যেটা অন্য সময় পাবেন না, আপনাদের সফরের সাথে খাওয়ার পাতে বিভিন্ন ধরনের ইলিশের রকমারি পদ আপনাদের সুন্দরবন ভ্রমণকে একটা আলাদা জায়গায় নিয়ে যাবে। এবার আপনাদের ই ঠিক করতে হবে আপনারা কোন সময়ে আসতে চান। ডিসেম্বর থাকে পিক টাইম এই সময় ট্যুরের খরচের জন্য একটু বেশি টাকা আমাদের গুনতে হতে পারে।
সুন্দরবন ট্যুর প্ল্যান :- আপনাদের একটা জিনিস জানা দরকার যে আপনারা নিজেদের প্ল্যানে এবং নিজেদের ইচ্ছামতো সুন্দরবন ঘুরতে পারবেন না। আপনাদের ট্যুর প্যাকেজ বুক করতে হবে, কারণ এই জায়গায় অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, অনেক ঝুকি আছে, তাই সরকার থেকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরদের কাছ থেকেই আপনাদের ট্যুর প্যাকেজ বুক করতে হবে তারাই আপনাদের বোটে করে ঘুরিয়ে আবার আপনাদের ক্যানিং এ ছেড়ে দেবে। ট্যুরের সমস্ত ব্যবস্থাপনা তাদের। ক্যানিং স্টেশন থেকে বেরিয়েই দেখতে পাবেন বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরদের অফিস আছে, আপনি সেখানে গিয়ে ও তাদের সাথে কথা বলে আপনারা পছন্দ মত প্যাকেজ বুক করতে পারেন। তাছাড়া ফোনে ও তাদের সাথে কথা বলে বুক করে নিতে পারেন।ফোনে কথা বলে বুক করা যথেষ্ঠ সুবিধাজনক কারণ আগে থেকে আপনারা নিজেদের পছন্দমত তারিখে বুক করে নিতে পারেন । আমি নিচে কয়েকটি ট্যুর অপারেটর এবং তাদের ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি আপনারা দেখে বুক করে ফেলতে পারেন।
1. Travels Destination Sundarban - 9595079963/9093104884 (Bapi Das)
2. Sundarban bhraman Sathi - 9734351502/9064812085/9732545714( Samir Mondal)
3. Baba Loknath Tourist center - 9775159979/9732619755(Ananda Sarkar)
4. Royal Sundarban - 9474007550 (শশধর মান্না)
5. Mohana tour and Travels- 9732523220.
প্রথম দিন :- প্রথম দিন আপনাদের ক্যানিং স্টেশন থেকে পিক আপ করে সোনাখালি ঘাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে অটো করে। তারপর সোনাখালি ঘাট থেকে আপনাদের যাত্রা শুরু হবে। লঞ্চ করে আপনাদের নিয়ে যাওয়া হবে হোগল নদী, কর্তাল নদী হয়ে গদখালির কাছে এসে বিদ্যাধরী নদীর মিলনস্থলে। এরপর গোসাবা ফেরিঘাট হয়ে আপনাদের নিয়ে যাওয়া হবে গোসাবার দুটি জায়গায় একটি হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো এবং কবিগুরুর স্মৃতি বিজোরিত বেকন বাংলো দেখিয়ে আপনাদের আবার নিয়ে যাওয়া হবে পরের স্পটের উদ্দেশ্যে। এরপর গুমদি নদী হয়ে সোজা পাখিরালয়। পাখিরালয় পাখি দেখা ছাড়াও সানসেট পয়েন্টে সানসেট দেখে সন্ধ্যা টা উপভোগ করে আজকের রাত্রিবাস আপনাদের পাখিরালয়েই। এখানেই অনেকগুলো কটেজ এবং হোটেল করা আছে, সবগুলোই প্রায় ঘাটের কাছেই। কেউ চাইলে রাতে লঞ্চ গুলোতেও থাকতে পারেন তাহলে খরচা অনেকটা কম হবে।
- ভিডিও টি দেখুন - সুন্দরবন ট্যুরের প্রথম দিন
দ্বিতীয় দিন :- দ্বিতীয় দিনে আপনাদের প্রথমে নিয়ে যাওয়া হবে সজনেখালি, পাখিরালয়ের ঠিক উলটো দিকেই অবস্থিত সজনেখালি এখানে আছে ফরেস্ট অফিস, যেখান থেকে পারমিট দেওয়া হয়, তাছাড়া এখন আছে একটা ওয়াচ টাওয়ার, ম্যানগ্রোভ ইন্টারপিটেসন সেন্টার এবং কুমির পার্ক। এরপর থেকে আপনারা সুন্দরবনের কোর এরিয়ায় প্রবেশ করবেন। সুধন্যখালি খাড়ি হয়ে আপনি কোর এরিয়াতে এসে ঢুকবেন । কোর এরিয়াতে প্রতিটি এলাকা বাঘের হাত থেকে বাঁচার জন্য নেট দিয়ে ঘেরা থাকে, এমন কি খাড়ি গুলোও, সেজন্য আপনি চাইলেই যেকোনো রাস্তা দিয়ে ঢুকতে পারবেন না। এই কোর এরিয়ার প্রথমে আসবে সুধন্যখালি, তার দোঁবাকি ক্যাম্প ।এই, সব জায়গাতেই আছে ওয়াচ টাওয়ার, আর এই ওয়াচ টাওয়ার যাওয়ার রাস্তা গুলো নেট দিয়ে ঘেরা, ওয়াচ টাওয়ার গুলি থেকে বাঘের দেখা না পেলেও হরিন বা কুমিরের দেখা অবশ্যই পেতে পারেন।
- ভিডিও টি দেখুন - সুন্দরবন ট্যুরের দ্বিতীয়দিন
তৃতীয় দিন : - তৃতীয় দিন ব্রেকফাস্ট করে আপনাদের নিয়ে যাওয়া হবে ঝড়খালি এখানে আছে বাঘের rescue center। লোকালয় থেকে উদ্ধার হওয়ার কিছু বাঘ এখানে রাখা থাকে। এবার আপনাদের বাড়ি ফেরার পালা। লঞ্চ আপনাকে সোজা মাতলা নদী ধরে নিয়ে চলে যাবে সোনাখালি ঘাটে, ক্যানিং পৌঁছতে পৌঁছতে আপনার বিকেল ৪ টা বেজে যাবে, তারপর শিয়ালদা লোকাল ধরে সোজা চলে আসুন শিয়ালদা। এভাবেই আপনাদের ২ রাত ৩ দিনের সুন্দরবন ট্যুরের সমাপ্তি ঘটবে।
ছোটো করে আপনাদের একটা ট্যুর প্ল্যান দিলাম বিস্তারিত টা আপনারা ফোনে আপনাদের ট্যুর অপারেটর দের কাছ থেকে শুনে নেবে সব ট্যুর অপারেটর মোটামোটি একই প্ল্যানে নিয়ে যাবে, আর হ্যাঁ সাথে আপনাদের খাওয়ারের প্লেটে কি কি খাওয়ার থাকবে তিন বেলা সেটাও অবশ্যই শুনে নেবেন।
- ভিডিও টি দেখুন - সুন্দরবন ট্যুরের তৃতীয় দিন
সুন্দরবন ট্যুর প্যাকেজ ও খরচ : - সুন্দরবন ট্যুর প্যাকেজ বিভিন্ন ধরণের আছে। যেমন আছে একটি একদিনের প্যাকেজ, এটা সারাদিনের প্যাকেজ খরচা হবে খুব কম ১৫০০ টাকার মতো ।
দ্বিতীয় যেটা আছে ১ রাত ২ দিনের। এই প্যাকেজে খরচা হতে পারে ২৫০০-৩০০০ টাকার মধ্যে।
তৃতীয় যে প্যাকেজ টা আছে ওটা হচ্ছে ২ রাত ৩ দিনের ট্যুর প্যাকেজ। এই প্যাকেজে খরচ হতে পারে - ৩৫০০-৪০০০ টাকার মধ্যে।
এই প্যাকেজ খরচ লকডাউনের পর কিছু বেশিও হতে পারে। সুন্দরবন ঘুরার জন্য সবচেয়ে বেস্ট হবে এই ২ রাত ৩ দিনের প্যাকেজ কারণ এই প্যাকেজে আপনারা আরো সুন্দরবন এলাকার অনেকটা অংশ কভার করতে পারবেন এবং তার সাথে সাথে আরো কোর এরিয়াতে যেতে পারবেন, তাতে বাঘ দেখার সম্ভবনা ও বেড়ে যাবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন