পশ্চিমবঙ্গের মিনি ডেনমার্ক শ্রীরামপুর ভ্রমণ গাইড। Mini Denmark 🇩🇰 of West Bengal Serampore Travel Guide

 পশ্চিমবঙ্গের মিনি ডেনমার্ক - শ্রীরামপুর 


ভ্রমণ পিপাসু :- ষোড়শ, সপ্তদশ শতক থেকেই হুগলি নদী হয়ে ওঠে বিদেশী বণিকদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র, পর্তুগীজ, ডাচ, দিনেমার বা ড্যানিস, ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ প্রভৃতি বিদেশী বনিকরা ও তাদের সংগঠন নিজেদের বাণিজ্যিক লাভের আসায় হুগলি নদীর দুপাশে নির্মাণ শুরু করতে থাকে তাদের ব্যবসা কেন্দ্র। ব্যবসা বানিজ্য নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ প্রায় লেগেই থাকত , এই হুগলি নদী হয়ে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে। শেষ পর্যন্ত নৌ শক্তিতে বলিয়ান ব্রিটিশরাই বাকিদের হটিয়ে এই গোটা এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতে পেরেছিল।

আজকের এই ব্লগে আমি আলোচনার করবো আমাদের রাজ্যের মিনি ডেনমার্ক বা পূর্বতন ড্যানিসদের ঘাঁটি বা বাণিজ্য কেন্দ্র শ্রীরামপুর নিয়ে এবং শ্রীরামপুরের কিছু দর্শনীয় স্থান নিয়ে, ড্যানিসরা যার নাম দিয়েছিল ফ্রেডরিকস্ নগর।

শ্রীরামপুর গঙ্গাঘাট। 

১৭৫৫ সালে বাংলার তৎকালীন নবাব আলীর্বদীর খান, কলকাতা থেকে প্রায় ২১ কি.মি দূরে হুগলি নদীর তীরে শ্রীপুর গ্রামে ড্যানিস এশিয়াটিক সোসাইটিকে প্রায় ৩ বিঘা জমি দিয়েছিলেন বাণিজ্য কেন্দ্র নির্মাণের জন্য, তার বিনিময়ে নবাব কে ড্যানিস এশিয়াটিক সোসাইটির দিতে নিয়েছিলো প্রচুর উপঢৌকন। এরপর আশেপাশের আরো এক দুটি গ্রামকে একত্রিত করে তৈরি হয় আজকের শ্রীরামপুর শহর। কিন্তু এর নাম তখন শ্রীরামপুর ছিল না, ডেনমার্কের তখনকার রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকস্ এর নামে তখন এর নাম রাখা হয়েছিলো ফ্রেডরিকস্ নগর। ড্যানিসদের উদ্যোগে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় বন্দর। সেই বন্দরের মাধ্যমে ডেনমার্কের সাথে জিনিসপত্রের ব্যবসা বাণিজ্য চলত। আজকের এই ব্লগে আমি প্রধানত তুলে ধরবো শ্রীরামপুরের কিছু দর্শনীয় স্থান, তাই শ্রীরামপুরের ইতিহাস নিয়ে আর এগোলাম না। চলুন তাহলে এবার একে একে শ্রীরামপুরের কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনার্থী স্থান নিয়ে আলোচনা করা যাক।

মাহেশের রথ। 

শ্রীপুরের রামসীতা মন্দির এবং শ্রীরামপুর নামের উৎপত্তি :- শ্রীরামপুর প্রাচীন কালে অনেকগুলো ছোট গ্রামের সমষ্টি ছিল, সেগুলির কোনো টার নামই শ্রীরামপুর ছিল না। শ্যাওড়াফুলির জমিদার মনোহরচন্দ্র রায়ের পুত্র রামচন্দ্র রায় ১৭৫৩ খ্রিস্টাব্দে এই শ্রীপুর গ্রামে এই রাম মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময় মন্দিরের জন্য কয়েক বিঘা জমি ও দান করেছিলেন শ্যাওরাফুলির জমিদার। পূর্বে ড্যানিস আমলে এই জায়গা ফ্রেডরিকস্ নগর হিসেবে পরিচিত ছিল কিন্তু শ্রীপুরে রাম সীতা মন্দির প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকে এই জায়গা শ্রীরামপুর হিসেবে আসতে আসতে পরিচিতি পেতে থাকে, পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে এই জায়গা পাকাপাকি ভাবে শ্রীরামপুর হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

মাহেশের রথ :- ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম রথের মেলা হল এই মাহেশের রথের মেলা। ১৩৯৬ সাল থেকে মাহেশের জগন্নাথ দেবের আরাধনা শুরু হয় এবং ধুমধাম করে এই মেলা আয়োজন হয়ে আসছে, যা আজ ৬২৬ বছরে পদার্পণ করেছে। এই রথ যাত্রার সূচনা করেছিলেন কমলাকার পিপলাই যিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের শিষ্য, চৈতন্যদেব যখন মাহেশে এসেছিলেন তখন তার অনুরোধেই কমলাকার পিপলাই এই মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব নেন। এই মেলায় চৈতন্যদেব ছাড়াও এসেছিলেল রামকৃষ্ণ দেব সারদাদেবী, বঙ্কিমচন্দ্র, প্রমুখ। বঙ্কিমচন্দ্র তার বিখ্যাত উপন্যাস 'রাধারানি' র বিষয়ই ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।

জগন্নাথ মন্দির, মাহেশ। 


মাহেশের রথযাত্রার পাশাপাশি মাহেশের রথের ও এক বিরাট ইতিহাস আছে। এই রথ অনেকবার, নষ্ট, পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে যে রথটি আমরা দেখতে পাই সেটা তৈরি করা হয়েছিলো ১৮৮৪ সালে বসু পরিবারে দ্বারা। মার্টিন ও বার্ন কোম্পানী এই রথটি তৈরি করে ২০ লক্ষ্য টাকার বিনিময়ে যা নবরত্ন শৈলীতে নির্মিত।

শ্রীরামপুর ভ্রমণ এই মাহেশে দিয়েই শুরু করা উচিৎ। হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেন ধরে শ্রীরামপুর স্টেশন এবং তারপর স্টেশন সামনে থেকেই ১০ টাকার টোটো ভাড়াতে পৌঁছে যান মাহেশ। আর যারা গঙ্গার ওপার থেকে আসবেন তারা ব্যারাকপুর ঘাট হয়ে এপারে আসবেন তারা সবার শেষে এই মাহেশ দর্শনে আসবে সেটাই সুবিধার হবে।

শ্রীরামপুর কলেজ :- ভারতবর্ষের তৃতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম কলেজ এই শ্রীরামপুর কলেজ, যা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ১৮১৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার ঠিক একবছর পর। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শ্রীরামপুর মিশনারীর তিনজন ব্যক্তি - উইলিয়াম কেরী, জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড। যাদের উদ্যোগে প্রথম এই শ্রীরামপুরেই প্রচুর পরিমাণে বই Translate এবং ছাপানো হতে থাকে।

ঐতিহাসিক শ্রীরামপুর কলেজ ।

এবার মাহেশ থেকে ২০ টাকার টোটো রিজার্ভ করে চলে আসুন এই শ্রীরামপুর কলেজে। ঐতিহাসিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই কলেজ অবশ্যই আপনাদের ভিজিট করা উচিৎ। পাশেই আছে উইলিয়াম কেরি মিউজিয়াম।

ডেনমার্ক ট্র্যাভার্ণ : - শ্রীরামপুরের নিশানঘাটের একদম পাশেই যেটা শ্রীরামপুরের প্রধান এলাকায় ১৭৮৬ সালে এখানেই ডেনমার্ক ট্র্যাভার্ণ তৈরি করা হয়েছিলো। এটা ছিল এক ধরণের রিসর্ট, এখানে থাকা খাওয়ার থেকে, মনরঞ্জনের সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা ছিল ঘাটে ব্যবসা করতে আসা বণিক নাবিকদের জন্য। ২০১৫-২০১৮ সালের মধ্যে এই ডেনমার্ক ট্র্যাভার্ণের সংস্কারের কাজ করা হয় পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ডেনমার্ক এর যৌথ উদ্যোগে। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন থেকে এই বিল্ডিং কে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে। বর্তমানে এখানে পার্ক হোটেল আছে একদিনের জন্য শ্রীরামপুর বেড়াতে আসলে অবশ্যই এই ডেনমার্ক ট্র্যাভার্ণ থেকে লাঞ্চ করতে ভুলবেন না।

ডেনমার্ক ট্যাভার্ন। 

ড্যানিস গভর্নমেন্ট হাউস :- এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিলো ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে। এটি ছিল শ্রীরামপুরের ড্যানিস প্রশাসনের প্রধানের বাসভবন ও অফিস। ড্যানিসরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পুরোটা ব্রিটিশদের অধিকারে আসে এবং বৃটিশদের উদ্যোগেই এই ভবনের আরো Extenction করা হয়। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত এই ভবনই ব্যবহার হতো শ্রীরামপুর কোর্ট হিসেবে। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন এবং, ডেনমার্কের ন্যাশনাল মিউজিয়ামের সহযোগিতায় এই বিল্ডিং এর সংস্কার করে। ২০০৬ সালে এই বিল্ডিং কেউ হেরিটেজ কমিশন থেকে হেরিটেজ বিল্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

ড্যানিস গভর্নমেন্ট হাউস 

ডেনমার্ক ট্যাভার্নের একদম পাশেই এই ভবনটি অবস্থিত আপনি ডেনমার্ক ট্যাভার্ন থেকে পায়ে হেঁটেই এটি দেখে নিতে পারবেন।


সেন্ট ওলাভ'স চার্চ :- শ্রীরামপুরের সবচেয়ে পুরোনো এই সেন্ট ওলাভ'স চার্চ, যা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো ১৮০৯ সালে। ড্যানিসরা শ্রীরামপুরের থাকা কালিন যেকটা বিল্ডিং তৈরি করেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম। এটি একটি প্রটেস্ট্যান্ট চার্চ যা উৎসর্গ করা হয়েছিলো সেন্ট ওলাভ কে। চার্চের ওপরে তাকালেই দেখতে পাবেন CR-7 এর নাম অঙ্কিত আছে। CR-7 অর্থাৎ ডেনমার্ক তখনকার রাজা খ্রিষ্টিয়ান-৭।

সেন্ট ওলাভ চার্চের সামনের অংশ। 


২০১৬ সালে এই চার্চের সংস্করণের কাজ শেষ হওয়ার পর এর চার্চকে UNESCO এশিয়া প্যাশিফিক হেরিটেজ award এ ভূষিত করা হয়েছে। এটি ও ডেনমার্ক ট্র্যাভার্ণ এবং ডেনমার্ক Government হাউসের একদমই পাশে, তিনটি জায়গা একদম পাশাপাশি হওয়ার তিনটে জায়গা সাথে গঙ্গার ঘাট দেখে নিয়ে আপনি টোটো করে চলে আসুন শ্রীরামপুর রাজবাড়িতে।

শ্রীরামপুর রাজবাড়ি :- শ্রীরামপুরের আরো একটি জনপ্রিয় পর্যটনস্থল হলো এই শ্রীরামপুর রাজবাড়ি বা শ্রীরামপুর গোস্বামী বাড়ি। 'ভূতের ভবিষ্যৎ' সিনেমার শুটিং হওয়ার পর থেকে এই বাড়িটি পর্যটনস্থল হিসেবে আরো বেশী গুরুত্ব পেয়েছে। এত বড়ো বাড়িযে, এতে ভূত থাকাটা ও অসম্ভব নয়। শ্রীরামপুর রাজবাড়ির পত্তন করেন রামগোবিন্দ আচার্য, নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ সময়ে, পরবর্তীকালে তিনিই গোস্বামী উপাধি পান। এই শ্রীরামপুর জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠা থেকে এক বিরাট ইতিহাস আছে সেটা অন্য একটা ব্লগে আমি আলোচনার করবো, এই ব্লগের প্রধান বিষয় শ্রীরামপুরের কিছু প্রধান প্রধান দর্শনীয় স্থান।

শ্রীরামপুর রাজবাড়ি ।

উইলিয়াম কেরির সমাধি :- শ্রীরামপুরের বটতলায় অবস্থিত শ্রীরামপুরের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি, শ্রীরামপুরের নামকে যিনি গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই উইলিয়াম কেরির সমাধি। যদি ও এখানে বিশেষ কিছু দেখার নেই, চারপাশের এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে গেছে, কিন্তু তবু এত বড় একজন মানুষ, শ্রীরামপুরে যখন এসেছেন ঘুরতে তখন ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গা টাও আপনাদের লিস্টে রাখতেই পারেন।

শ্রীরামপুর রাজবাড়ি ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন