ভ্রমন পিপাসু :- দক্ষিণ ভারত মানেই সত্যি আলাদা একটা অনুভূতি। এখানকার সংস্কৃতি, এখনকার খাওয়ার, এখানকার নেচার সবকিছুই মানুষকে আকৃষ্ট করে। সেরকমই দক্ষিণ ভারতে এতো সুন্দর সুন্দর ওয়াটারফলস্ আছে যে একটা কোনো পোস্টে বলা প্রায় অসম্ভব তার মধ্যে সেরা ১০ টি ওয়াটারফলস্ বাছা তো আরোই অসম্ভব ব্যাপার, কিন্তু তাও চেষ্টা করেছি এই ব্লগে বেছে বেছে সেরা ১০ ফলস্ সমন্ধে বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করেছি তাই বলে আপনি এই ব্লগ পড়েই একবার গেলেন আর সবগুলো ফলস্ দেখে আসলেন, সেটা কিন্তু সম্ভব না, প্রতিটা ফলস্ কিন্তু একটি রাজ্যের মধ্যে না আলাদা আলাদা ৪টি রাজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ, দক্ষিন ভারত কিন্তু বিশাল বড় এলাকা, তাই আপনার পক্ষে এক, দু বারে এগুলো কে দেখা সম্ভব না। তাহলে আসুন দেখে আসি দক্ষিণ ভারতের সেরা ১০টি জলপ্রপাত।
জোগ ফলস্ :- দক্ষিণ ভারত তথা ভারতের সবচেয়ে উচ্চতম ফলস্ হলো এই জোগ ফলস্। যার আরেক নাম গোরসোপ্পা জলপ্রপাত। এটি অবস্থিত কর্নাটকের শিমোগা জেলার পশ্চিমঘাটের পর্বতমালার সরাবতী নদীর ওপরে। উচ্চতা ১৫৪৯ ফিট। এতো ওপর থেকে জল নিচে পড়ে যে এটাই প্রধান আকর্ষন এই জলপ্রপাতের।
এই ফলস্ কর্নাটকের শিমোগা জেলার সাগর ব্লকে অবস্থিত। এখানে আসার জন্য আপনারা বাস ও ট্রেন দুটোই পেয়ে যাবেন। সবচেয়ে কাছের দুটি রেল স্টেশন হলো - সাগর (13 কি.মি), তালাগুপ্পা (30) তাছাড়া ম্যাঙ্গালোর- মুম্বই লাইনের দুটি স্টেশন হননোভার বা ভাটকল ও নামতে পারেন কিন্তু এ দুটি স্টেশন একটু দূর হয়ে যাবে। বাসে আসতে চাইলে আপনাকে সাগর আসতে হবে। আর সবচেয়ে কাছের এয়ারপোর্ট হলো হুবলি।
দুধসাগর ফলস্ :- দক্ষিণ ভারতের যে দু তিনটে ঝর্ণা সবচেয়ে সুন্দর তারমধ্যে এই দুধসাগর ফলস্ টি অন্যতম। এতো সুন্দর এই ফলস্ টি আসল রূপ আপনারা পাবেন কেবলমাত্র বর্ষাতে তার পরবর্তী কালে। এত সুন্দর হওয়া সত্ত্বেও এই ওয়াটারফলস্ টি সবার কাছে অজানাই থেকে গিয়েছিলো কিন্তু বলিউড সিনেমা চেন্নাই এক্সপ্রেসে এত সুন্দর ভাবে এই ফলস্ টিকে দেখানো হয়েছে যে মানুষের আকর্ষন ও উত্তেজনা এই ফলস্ নিয়ে আরো বেড়ে গেছে, এবং পর্যটকদের আনাগোনা আরো প্রচুর পরিণামে বেড়ে গেছে।
এই দুধসাগর ফলস্ এর উচ্চতা ১০১৭ ফিট। এর অবস্থান গোয়া রাজ্যের মাণ্ডভী নদীর ওপরে একদম গোয়া-কর্নাটকের বর্ডারে।বেলগাভী - ভাস্কো রেললাইনের একদম ধারে, এই লাইনেই চেন্নাই এক্সপ্রেস সিনেমার শুটিং হয়েছিলো। আপনি যদি রেল থেকে এই ফলস্ দেখতে চান তাহলে আপনাকে ট্রেনেই যেতে হবে এমন অনেক লোকাল ট্রেন আছে যেগুলো দুধসাগর স্টপেজে এসে স্লো করে বা থামেও, বিভিন্ন এক্সপ্রেস ট্রেন এর পাশ দিয়েই খুব ধীরে ধীরে যায় আপনার উপভোগ করতে তেমন কোনো অসুবিধে হবে না। বর্ষাতে ও জল এত বেড়ে যায় যে জল ট্রেনের ভেতর পর্যন্ত চলে আসে। কলকাতা থেকে গোয়া যাওয়ায় একটাই ট্রেন অমরাবতী এক্সপ্রেস এই ট্রেনে আসলে আপনারা এই দুধসাগর ফলস্ দেখতে পাবেন। আপনারা যদি ভরা বর্ষাতে আসেন তাহলে ট্রেন থেকে যা ভিউ দেখবেন তা জন্ম জন্মানতরেও ভুলবেন না। তাছাড়া গোয়া থেকেও সরকপথে আপনি যেতে পারেন কিছুটা আবার হেঁটে জঙ্গল দিয়ে যেতে হবে তারপর আপনি এখানে পৌঁছতে পারবেন।
শিবসমুদ্রম ফলস্ :- এই ব্লগের তৃতীয় ফলস্ যেটা নিয়ে আমি আলোচনা করবো সেটার নাম হয়তো প্রায় সবাই শুনছেন। শিবসমুদ্রম ফলস্ যার অবস্থান কর্নাটকের মান্ড্য জেলার কাবেরী নদীর ওপরে। এই ফলস্ কিন্তু দক্ষিণ ভারতের প্রাচীনতম ফলস্ যা তৈরী করা হয়েছিলো ১৯০২ সালে তৎকালীন মহিশূরের দেওয়ান এম বিশ্বেশ্বরায়া দ্বারা। যার উদ্দেশ্য ছিল পাওয়ার তৈরী করা, এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে তৎকালীন KGF বা কোলার গোল্ড ফিল্ডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো যা এশিয়ার মধ্যে প্রথম।
এই ফলস্ এ আসার জন্য আপনাকে সড়কপথেই আসতে হবে, ব্যাঙ্গালোর বাস স্ট্যান্ড থেকে আপনি বাস ও পেয়ে যাবেন আপনাকে নামতে সত্যগালা হ্যান্ড পোস্ট স্টপেজে এখান থেকে আপনি অটো ও পেয়ে যাবেন দূরত্ব মোটামোটি ২ কি.মি। বর্তমানে থাকার ব্যবস্থাও নতুন নতুন হচ্ছে ইচ্ছা করলে এখানে থাকতে পারেন। গাড়ি ভাড়া করলে একদিনের ডে ট্যুর হিসেবে এটা ভালই লাগবে। ব্যাঙ্গালোর থেকে এটির দূরত্ব ১২৪ কি.মি সময় লাগবে ৩ ঘন্টা।
আথিরিপল্লী ফলস্ :- কর্নাটক থেকে এবার আসা যাক দক্ষিণের আরেক রাজ্য কেরালাতে। কেরালাতে দেখার মত প্রচুর ফলস্ আপনারা পেয়ে যাবেন তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো আথিরিপল্লী ফলস্। এই ফলস্ ও এতটা জনপ্রিয় ছিল না বেশ কিছু বছর আগে, কিন্তু বাহুবলী-1 এর শুটিং এখানে হাওয়ায় পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়ে চলছে।
আথিরিপল্লী ফলস্ এর অবস্থান কেরালা থিসুর জেলার চালাকুরি নদীর ওপরে। পাশেই আছে ভাজাচাল নামে আরও একটি ফলস্ এন্টি টিকিট ৫০ টাকা দুটো ই include থাকবে। রাজধানী কোচি থেকে এর দুরত্ব ৮০ কি.মি, সময়ে লাগবে ২.৩০ ঘন্টা। সবচেয়ে কাছের রেল স্টেশন হলো চালাকুরি রেলস্টেশন। আপনি কেরালা ট্যুর যখন করবেন তখন এটি দেখে নিলে বেস্ট হবে, কোচি থেকে মুনার যাওয়ার পথে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে নিয়ে এটা দেখে নিলে ভালো হবে ড্রাইভার এক্সট্রা কিছু ২০০০ টাকার মতো চাইতে পারে।
অ্যাবে ফলস্ :- কর্নাটক রাজ্যের আরও একটি সুন্দর ওয়াটারফলস্ হলো অ্যাবে ফলস্। কর্নাটকের মাদেকেরীর কাছে পশ্চিমঘাটের পর্বতমালার ঘন সবুজ ঘেরা প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত এই ফলস্। উচ্চতা কিন্তু বেশি না মাত্র ৭০ ফিট কিন্তু এর সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই, বাহুবলী সিনেমার কিছুটা অংশ এখানে শুটিং হয়েছিলো। কর্নাটকের কূর্গ যারা বেড়াতে আসেন তাদের প্রধান Attraction হলো এই অ্যাবে ফলস্। এখানে পৌঁছতে আপনাকে ১৫-২০মিনিটের ট্রেক করতে হবে কিন্তু, ঘন সবুজ ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে আপনি কখন পৌঁছে যাবেন সেটা আপনি টেরই পাবেন না। নেচার লাভার এবং ফটোগ্রাফারদের কাছে এক স্বর্গরাজ্য এই জায়গা।
এখানে পৌঁছনোর সবচেয়ে কাছের শহর হচ্ছে মাদিকেরি। শহর থেকে মাত্র ১২ কি.মি দূরে এই ফলস্। ব্যাঙ্গালোর, মহিশূর বা ম্যাঙ্গালোর থেকে নিয়মিত KSRTC বাস পেয়ে যাবেন মাদিকেরি আসার। আর সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন হলো ম্যাঙ্গালোর, স্টেশন পৌঁছে একটা গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন এই ফলস্ ও আসে পাশের কিছু জায়গা ঘুরার জন্য । সবচেয়ে ভালো হয় আপনারা যদি কফির রাজ্য কূর্গ ঘুরার প্ল্যান করে থাকেন তাহলে এটাও সাথে করে নিতে পারবেন।
হোগেনাক্কাল ফলস্ :- কর্নাটক রাজ্যে আপনি ওয়াটারফলস্ এর কোনো শেষ নেই দক্ষিণ ভারতের সেরা দারুণ দারুণ ওয়াটারফলস্ গুলোই এই রাজ্যেই অবস্থিত। সেই জন্য একে ল্যান্ড অফ ওয়াটারফলস্ বললে কোনো খারাপ কিছু হবে না, সেরকমই এই রাজ্যের আরো একটি ফলস্ এর কথা এবার বলবো যার নাম হোগেনাক্কাল ফলস্।
এই ফলস্ এর অবস্থান একদম কর্নাটক-তামিলনাড়ু বর্ডারে কর্নাটকের চামরাজনগর জেলার কাবেরী নদীর ওপরে। ব্যাঙ্গালোর থেকে দূরত্ব ১২৭ কি.মি এবং মাইশোর থেকে ১১২ কি.মি। বাসে আসলে অনেকটা ব্রেক জার্নি হবে সবচেয়ে ভালো একটা গাড়ি বুক করে নেওয়া। এর সৌন্দর্যের জন্য একে দক্ষিণ ভারতের নায়াগ্রা ফলস্ হিসেবে ও ডাকা হয়। এখানে এসে আপনি বিশেষ ধরনের বোটিং করতে পারবেন গোল টাইপের এই বোট গুলোকে কানাড়া ভাষায় টেপ্পা বলে, এই দুটো জিনিসই এই ফলসে পর্যটক টানার প্রধান USP। এই বোটিং কিন্তু বর্ষাতে জলের স্রোতের জন্য একদমই বন্ধ থাকে তাই এটা দেখে আসবেন। এখানে আসার সেরা সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।
হেব্বে ফলস্ :- দক্ষিণ ভারতের সেরা ওয়াটারফলস্ এর লিস্টে কর্নাটকের শেষ ফলস্ যেটা নিয়ে এখন আলোচনা করবো সেটা হলো হেব্বে ফলস্। এটি অবস্থিত কর্নাটকের চিগমাগলুর জেলায়। ১৬৮ মিটার উচু এই ফলস্ দুটি ধাপে নিচে নেমে আসে। প্রথমটির নমস্কার চিক্কা-হেব্বে বা ছোটো ফলস্। এবং দ্বিতীয়টি ডোডডা-হেব্বে বা বড় ফলস্।
এখানে আসার উচিত সময় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এখানে আসার সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন হলো তারিকেরে জংশন । ম্যাঙ্গালোর থেকে বাস এবং ট্রেন আপনারা পেয়ে যাবেন।
কুন্তলা ফলস্ :- তেলেঙ্গানা রাজ্যের উচ্চতম ফলস্ হলো এই কুন্তলা ফলস্। এটি তেলেঙ্গানার আদিলাবাদ জেলায় কদম নদীর ওপরে অবস্থিত। উচ্চতা 45 মিটার । এই ফলস্ এর পাশেই আছে ভগবান শিবের মন্দির সোমেশ্বর স্বামী মন্দির। শিব রাত্রির সময়ে এখানে প্রচুর লোকের ভিড় হয়।
কেমন করে আসবেন এখানে, এখান থেকে মানে এই ফলস্ থেকে সবচেয়ে কাছের শহর হল আদিলাবাদ দূরত্ব ৬৪ কিমি। এবং আদিলাবাদের নেরেদিকোণ্ডা গ্রাম থেকে দূরত্ব মাত্র ১৩ কিমি। আপনাকে বাসে করে আদিলাবাদ পৌঁছে সেখান থেকে নেরেদিকোণ্ডা গ্রাম এবং গ্রাম থেকে অটো করে এই ফলস্ ।
কুনচিকাল ফলস্ :- কর্নাটক তথা দেশের দ্বিতীয় উচ্চতম ফলস্ হলো এই কুনচিকাল ফলস্। যার অবস্থান কর্নাটকের শিমোগা জেলায়। মনসুনের অবশ্যই আপনাদের এই ফলস ভিজিট করা একবার জরুরী, সেই সময় এর রূপ দেখে আপনি সত্যি পাগল হয়ে যাবেন।
এই ফলস কিন্তু Restricted ফরেস্ট এরিয়ার মধ্যে অবস্থিত এখানে আসার জন্য আপনাকে স্পেশাল permission নিতে হবে, যেটা আপনাকে নিতে হবে এই ফলস্ থেকে ১৫ কিমি দূরে Hosengadi ভিলেজ থেকে সবচেয়ে কাছের শহর হচ্ছে ম্যাঙ্গালোর।
এথিপোঠালা ফলস্ :- ৭০ ফিট উচু এই ওয়াটারফলস্ অবস্থিত অন্ধ্রপ্রদেশের গুনটুর জেলার কৃষ্ণা নদীর উপনদী চন্দ্রভাঁকা নদীর ওপরে। নদীর তিনটে স্রোত এখানে এসে এক জায়গায় হয়ে এই ফলস্ এর সৃষ্টি করেছে। এই ফলস্ এর পাশেই আছে নাগারজুন সাগর ড্যাম। এই ফলস্ দেখার সাথে সাথে আপনারা এই ড্যাম টাও দেখতে পারেন।এথিপোঠালা ফলস্ মাত্র ১২ কি.মি।
এই ফলস্ দেখতে আপনাকে ট্রেন বা বাস করে গুনটুর পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে আসতে হবে মাছেরলা। এই মাছেরলা থেকে এই ফলস্ মাত্র ১২ কি.মি ।গুনটুর বা মাছেরলা থেকে আপনাকে গাড়ি বুক করতে হবে, ভাড়া নিতে পারে ৪০০ টাকার মতো। একেবারে নাগার্জুন সাগর ড্যাম যাওয়ার পথেই এই ফলস্ টি পেয়ে যাবেন ।পার্কিং থেকে কয়েক মিনিটের পথ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন