ভ্রমণ পিপাসু :- আমরা সকলেই জানি উত্তরাখন্ডে অবস্থিত কেদারনাথ মন্দির একটিই আছে। কিন্তু না উত্তরাখন্ডে বাবা কেদারের পাঁচটি মন্দির আছে। যাদের একত্রে পঞ্চকেদার বলে। যাদের অবস্থান উত্তরাখন্ডের গাড়োয়াল পার্বত্য এলাকায়। সেগুলি হলো
১. প্রথম কেদার-কেদারনাথ।
২. দ্বিতীয় কেদার-মধ্যহেশ্বর ।
৩. তৃতীয় কেদার - তুঙ্গনাথ ।
৪. চতুর্থ কেদার - রুদ্রনাথ।
৫.পঞ্চম কেদার-কল্পেশ্বর ।
এই পঞ্চ কেদারের সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবের নাম। এই পঞ্চকেদার সৃষ্টির পেছনে এক বিরাট পৌরাণিক ইতিহাস আছে। এই পঞ্চকেদারের মধ্যে তুঙ্গনাথের উচ্চতা সবচেয়ে বেশি। এবং কল্পেশ্বরের উচ্চতা সবচেয়ে কম। এই কল্পেশ্বর মন্দিরই পঞ্চকেদারের মধ্যে একমাত্র যেটা সারাবছর খোলা থাকে। পঞ্চকেদারের মধ্যে চতুর্থ কেদার রুদ্রনাথ যাত্রা সবচেয়ে কঠিন এবং কল্পেশ্বর যাত্রা সবচেয়ে সহজ।
আরো পড়ুন - কেদারনাথ যাত্রার সম্পূর্ণ তথ্য
পঞ্চকেদার সৃষ্টির পেছনে পৌরাণিক কাহিনী :- আমরা আমরা সকলেই জানি ১৮ দিন ধরে চলা মহাভারতের যুদ্ধের পর পাণ্ডবপক্ষ জয়ী হয়েছিলো। যুদ্ধে পাণ্ডবদের উপর ভ্রাতৃহত্যার পাপ লেগেছিলো সেইজন্য পাণ্ডবরা মহাদেবের দর্শন পেতে চেয়ে পাপ মুক্ত হতে চেয়েছিলেন , সেইজন্য তারা কাশি এসে পৌঁছলেন দেবাধিদেব মহাদেবের আশীর্বাদ পাওয়ার আশায়। কিন্তু মহাদেব পাণ্ডবদের ওপরে রুষ্ট ছিলেন, মহাভারতের যুদ্ধনিয়ে। তাই তিনি কোনো মতেই পাণ্ডবদের দর্শন দিতে রাজি ছিলেন না। তাই তিনি কাশি থেকে চলে আসলেন উত্তরাখন্ডের গুপ্তকাশিতে, পাণ্ডবরাও মহাদেবের পথ অনুসরণ করে চলে আসলেন গুপ্তকাশিতে, এখানে এসেও পাণ্ডবরাও মহাদেবের দেখা পেলেন না। কারণ ততক্ষনে মহাদেব গুপ্তকাশি ছেড়ে কেদারনাথ চলে এসেছিলেন। এদিকে পাণ্ডবরাও নাছরবান্দা, তারাও সেই পর অনুসরণ করে কেদারনাথে এসে উপস্থিত হলেন। কেদারনাথে পাণ্ডবদের আসার খবর শোনা মাত্রই ভগবান শিব মহিষের রূপধারণ করে, ওখানে উপস্থিত বাকি পশুদের সাথে মিশে গেলেন যাতে পাণ্ডবরা তাকে চিনতে না পারে। পাণ্ডবদের এটা দেখে সন্দেহ হয়। ভীম তখন তার বিরাট রূপ ধারণ করে দু পাহাড়ের মাঝে দু-পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পরে। বাকি পশুরা ভীমের পায়ের তলা দিয়ে চলে গেলেও মহিষরুপী শিব ভীমের পায়ের নিচ দিয়ে যেতে রাজি হলেন না। তখন ভীম এই মহিষের পিঠের ওপরে ঝাপটে পড়লেন, কিন্তু সেইসময়ে সেই মহিষরুপী শিব ভূমিতে অন্তর্ধান হতে যাচ্ছিলো, সেই সময়ে ই ভীম সেই মহিষটির ত্রিকোনাকৃতির পিঠের অংশ ধরে ফেলে মহিষরুপী ভগবান শিবকে অন্তর্ধান হওয়া থেকে আটকান। এটা দেখে মহাদেব, পাণ্ডবদের ওপরে খুশি হয় এবং তাদের আশীর্বাদ প্রদান করেন, এবং তাদের ভ্রাতৃ হত্যার পাপ থেকে মুক্তি দেন । তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কেদারনাথে ত্রিকোনাকৃতি পিঠের ওপরিভাগের পুজো হয়ে আসছে । এটা ও বলা হয় ভগবান শিব যখন মাটির মধ্যে অন্তর্ধান হচ্ছিলেন তার তার দেহের ধর থেকে ওপর অংশটি কাঠমানডুতে প্রকট হয়, যেখানে বর্তমানে পশুপতি মন্দির আছে।
একই ভাবে মহাদেবের নাভি মধ্যমহেশ্বরে, বাহু তুঙ্গনাথে, মুখ রুদ্রনাথে এবং জটা কল্পেশ্বরে ।তাই এই পাঁচটি জায়গাকে একসাথে পঞ্চকেদার বলে। এই জায়গা গুলোতে ভগবান শিবের মন্দির অবস্থিত। প্রতি বছর উত্তরাখন্ডে এপ্রিল, মে মাস থেকে পঞ্চকেদার যাত্রাও শুরু হয়।
পঞ্চকেদার যাত্রা :- পঞ্চকেদার যাত্রায় অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হয়, সময় লাগে 10 থেকে 12 দিন। যাত্রা শুরু হবে কেদারনাথ দিয়ে এবং সবচেয়ে কল্পেশ্বর। এবার আমি আপনাদের জানাবো কেমন করে কম সময়ে আপনারা পঞ্চকেদার যাত্রা সম্পূর্ন করতে পারবেন।
কেদারনাথ যাত্রা :- কেদারনাথ নিয়ে আমার একটা সম্পূর্ন ব্লগ আছে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে দেখে নিবেন ।
মধ্যমহেশ্বর যাত্রা :- কেদারনাথ যাত্রা শেষ করার পর আপনাদের দ্বিতীয় গন্তব্যস্থল হবে দ্বিতীয় কেদার মধ্যমহেশ্বর।
কেমন করে পৌঁছোবেন :- কেদারনাথ থেকে নেমেই শোনপ্রয়াগ বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস বা ছোটো গাড়ি করে আপনাদের পৌঁছতে হবে ঊখীমঠ। ঊখীমঠে পৌঁছে এবার আপনাদের আসতে হবে ২০ কি.মি দূরের রাঁসি গ্রামে, এই রাঁসি গ্রাম থেকেই মধ্যমহেশ্বরের ট্রেক শুরু হয়। কিন্তু এই রাঁসি গ্রামে পৌঁছতে আপনারা কোনো বাসের ব্যবস্থা পাবেন না, আপনাকে হয় ছোটো গাড়ি রিজার্ভ করতে হবে নয়তো শেয়ারে যেতে হবে। শেয়ার ভাড়া ১০০ করে, যেটা সবচেয়ে পাওয়া ও যায়না। আপনারা যদি ২,৩জন থাকেন তাহলে একটা গাড়ি রিজার্ভ করে নেবেন ভাড়া ১৫০০ বেশি নেবে না। রাঁসি গ্রাম পৌঁছে সেখানে একটা হোটেল নিয়ে নেবেন, খুব কমেই আপনারা পেয়ে যাবেন হোটেল ৩০০ টাকা থেকে ৬০০ মধ্যে। নাহলে অনেক হোমস্টে ও পেয়ে যাবেন।
পরের দিন সকাল সকাল ট্রেক শুরু করে দিলে ভালো যেতে হবে আপনাকে ১৬ কি.মি পথ। বিকেলের আগেই তাহলে পৌঁছে যাবেন মধ্যমহেশ্বর। মাঝে রাস্তায় ছোটো ছোটো কিছু গ্রাম পাবেন, গ্রাম গুলিতে থাকা ও খাওয়ারের ও ব্যবস্থা থাকে। মধ্যমহেশ্বরে পৌঁছে ওখানে ও খুব কমে ৫০০ টাকার মধ্যে থাকার হোটেল পেয়ে যাবেন যদিও এখানে হোটেল সংখ্যা খুব কম। পরের দিন খুব সকালে দর্শন করে, রাঁসি গ্রাম এবং একই ভাবে উখিমঠে চলে আসুন এবং উখিমঠেই রাতে স্টে করুন।
তুঙ্গনাথ যাত্রা :- পরের দিন উখিমঠ থেকে আপনাদের যাত্রা শুরু হবে তৃতীয় কেদার তুঙ্গনাথের জন্য। তাই আপনাদের পৌঁছতে হবে চোপতা ভ্যালি। এই চোপতা থেকেই তুঙ্গনাথ ট্রেক শুরু হয়। উখিমঠ থেকে বাস পেয়ে যাবেন চোপতা আসার ভাড়া মোটামোটি ৮০-১০০ টাকা নাহলে তো ছোটো গাড়ি আছেই। চোপতা এসে একটা হোটেল নিয়ে সেদিনের মত চোপতাতেই রেস্ট, হোটেল এখানে ৮০০-১০০০ মধ্যে ভালো হোটেল পেয়ে যাবেন। আর একটা কথা বলে রাখি চোপতাতে কিন্তু কোনো ইলেকট্রিসিটি নেই সমস্ত কিছু সোলার নাহলে ব্যাটারী তে চলে।
পরের দিন আপনাকে খুব ভোরে উঠতে হবে, ট্রেক খুব বেশি না মাত্র ৫ কি.মি কিন্তু, খুব সকালে না গেলে চন্দ্রশিলার ভিউটা উপভোগ করতে পারবেন না চন্দ্রশিলা থেকে সানরাইজ এবং 360 ডিগ্রি ভিউ সারাজীবন মনে রাখার মতো। তুঙ্গনাথ থেকে চন্দ্রশিলার দূরত্ব ১ কি.মি হলেও রাস্তা যথেষ্ট খারাপ ও খাড়া। যাওয়া আসা মিলিয়ে সময় লাগবে ৫ থেকে সারে ৫ ঘন্টা মত। আবার চোপতা পৌঁছে ব্যাগপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করুন পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
রুদ্রনাথ যাত্রা :- পঞ্চকেদারের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন এবং বেশী পথ অতিক্রম করতে হবে আপনাদের এই রুদ্রনাথ যাত্রায়। চোপতা থেকে বাস বা গাড়ি রিজার্ভ করে আপনাকে আসতে হবে গোপেশ্বর, বাস ভাড়া নিতে পারে ৮০-৯০ টাকার মতো এবং রিজার্ভ গাড়ি ১৫০০। গোপেশ্বর থেকেই আপনাকে আবার আসতে হবে ট্রেক করার stating point সুগগরে । এই সুগগরের দূরত্ব গোপেশ্বর থেকে ৩,৪ কি.মি হলেও এই রাস্তায় আপনি কোনো বাস পরিষেবা পাবেন না। আপনাকে লোকাল taxy তে যেতে হবে শেয়ার গেলে ৩০,৪০ টাকায় হয়ে যাবে। সুগগরে পৌঁছে ওইদিন ওখানেই থেকে যান রেস্ট নিয়ে নিতে হবে ভাল মত কারন পরের দিনে খুব সকালে আপনাকে যাত্রা শুরু করে দিতে হবে। পরের দিন সকালে সকালে বেরিয়ে পুঙ্গ বুগিয়াল পনার, পঞ্চগঙ্গা হয়ে আপনি পৌঁছে যাবেন রুদ্রনাথ মন্দির। সেদিনকার মত ওখানেই থেকে যান, খুব কমেই হোটেল হোমস্টে পেয়ে যাবেন। পরের দিন একই পদ্ধতিতে চলে আসুন গোপেশ্বর।
কল্পেশ্বর যাত্রা :- পরের দিন সকালে উঠেই গোপেশ্বর থেকে চলে আসুন চামোলি তে। কারণ পঞ্চকেদারের পঞ্চমকেদার কল্পেশ্বর আপনাকে যেতে চামোলি হয়েই যেতে হবে গোপেশ্বর থেকে চামোলিতে আসার বাস পেয়ে যাবেন কয়েক মিনিট পর পরই, নাহলে শেয়ার গাড়িও পেয়ে যাবেন। চামোলি হয়ে দুটো রাস্তা যায় একটা বদ্রীনাথের দিকে এবং একটা কল্পেশ্বর। চামোলি থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে আপনাদের এবার আসতে হবে হেলাং। হেলাং থেকেই কল্পেশ্বর যাত্রা শুরু হয়। যাত্রাপথ একদমই কম ২.৫-৩ কি.মি, পঞ্চকেদারের মধ্যে সবচেয়ে কম । কল্পেশ্বর মন্দির দর্শন করে ওই দিনই ব্যাক করে চলে আসতে পারেন চামোলি। রাতটা চামোলিতে থেকে পরের দিন ইচ্ছা থাকলে বদ্রীনাথ যেতে পারেন নাহলে হরিদ্বার ফিরে আসতে পারেন। ভোর 4 টা থেকেই হরিদ্বারের বাস পেয়ে যাবেন ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ মধ্যে নেবে। আগের দিন চেষ্টা করবেন টিকিট কেটে রাখার। এই ভাবেই ১১,১২ দিনের মধ্যে আপনার পঞ্চকেদার যাত্রা সম্পূর্ন হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন