ভ্রমণ পিপাসু :- ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে যেদুটি ট্রেন ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিলো, তারমধ্যে একটি উত্তর প্রদেশের কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ঘটনা সম্পর্কে আমরা প্রায় কমবেশি সকলেই অবগত, ১৯২৫ সালে সংঘটিত এই ট্রেন লুঠের ঘটনার সাথে যুক্ত ছিলেন বিপ্লবী রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ি, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাক্উল্লাহ খান, শচীন্দ্র নাথ সান্যাল আরো অনেকে, পরে এই ঘটনাকে নিয়ে ১৯২৬ সালে শুরুহয় বিখ্যাত কাকোরি স্বরযন্ত্র মামলা। এই ঘটনার ঠিক সাত বছর পর ১৯৩৩ সালে আরো একটি ট্রেন ডাকাতির ঘটনা ঘটেছিলো, কিন্তু যে ঘটনাটিি বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানাই থেকে গেছে, হয়তো আমাদের জানতে দেওয়া হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছিলো তখনকার অবিভক্ত বাংলার দিনাজপুরের জেলার হিলি স্টেশনের( বর্তমানে বাংলাদেশ) দার্জিলিং মেলে, সময়টা ছিলো ২৭ শে অক্টোবর রাত ২.১৫ তে।বা ২৮ শে অক্টোবর।
Hili Mail Robbery Case 1933. |
- পুরো ডকুমেন্টারি টি দেখুন - Hili mail Robbery Case
আন্দামানে। |
হিলিকে বেছে নেওয়ার কারণ:- হিলি প্রথমে বগুড়া জেলায় অন্তর্ভুক্ত থাকলে এই মামলার সুবিধার্থে রাতারাতি হিলিকে দিনাজপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়। হিলি তখন ছিলো খুবই সমৃদ্ধ এলাকা, প্রায় ৪০টার ওপরে চাল কল আসে পাশে গড়ে উঠেছিলো। সেইসব চাল কলের মালিকরা বেশিরভাগই ছিলো ব্রিটিশদের অনুগত। সেইসময়ে উত্তরবঙ্গের সাথে কলকাতার সংযোগ রক্ষাকারী দার্জিলিং মেল হিলি স্টেশন হয়েই দিনাজপুরের ওপর দিয়ে শিলিগুড়ি ও কলকাতার মধ্যে যাতায়াত করতো, প্রচুর পরিমাণে দিনাজপুর সহ উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলার সরকারি ট্যাক্সের টাকা পোষ্টাল মেলের মাধ্যমে এই ট্রেনের মারফৎ ই কলকাতা পৌঁছাতো। বিপ্লবীদের লক্ষ্য ছিলো সেইসব অর্থ লুঠ করা।
২৭শে অক্টোবরের রাত:- তারিখ ঠিক হয়েছিলো ২৪ অক্টোবর। কিন্তু তারিখ পরিবর্তন হয়ে ২৭ অক্টোবর রাতে ঠিক হয়। ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল ১৫ জন তরুণ বিপ্লবী, তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৭ থেকে ২৩,২৪ বছরের মধ্যে। পুরো পরিকল্পনার সাথে যারা যুক্ত ছিলেন তারা হলেন......
১. প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী( লিডার)
২.ঋষিকেশ ভট্টাচার্য (ডেপুটি লিডার)
৩. প্রফুল্ল নারায়ণ সান্যাল( দিনাজপুর জেলা অনুশীলন সমিতির প্রেসিডেন্ট).
৪. সরোজ কুমার বসু ( দিনাজপুর শহর প্রেসিডেন্ট)
৫.সত্যব্রত চক্রবর্তী।
৬. কিরণ চন্দ্র দে
৭.হরিপদ বসু।
৮. রামকৃষ্ণ সরকার।
৯. কালিপদ সরকার।
১০. বিজয় চক্রবর্তী।
১১. সুবোধ দত্ত চৌধুরী ওরফে অনিল।
১২. শশধর সরকার।( রাজসাক্ষী)
১৩. লালু পাণ্ডে। (রাজসাক্ষী)
১৪. অশোক রঞ্জন ঘোষ( রাজসাক্ষী)
১৫. আবদুল কাদের চৌধুরী (অসুস্থ ছিলেন)
২৩ অক্টোবর ১৯৩৩ রাতে প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী, ঋষিকেশ ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল নারায়ণ সান্যাল, সত্যব্রত চক্রবর্তী, সরোজ বসু, আব্দুল কাদের চৌধুরী তাদের পরিকল্পনা মতো টাঙ্গন নদীর ধারে এক গ্রামে জড়ো হয়, কিন্তু সেদিন তারা হিলি স্টেশনে সন্দেহজনক কিছু মানুষকে ঘোরা ফেরা করতে দেখে তারা সেদিনের জন্য তাদের পরিকল্পনা কে স্থগিত রাখে পরবর্তী ২৭ তারিখের দিন ঠিক করে। এই ২৭ তারিখের পরিকল্পনা ছিলো আরো বেশি গোপনীয়, মাত্র কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া এই পরিকল্পনার কথা আর কাউকেই জানানো হলো না। শরীর খারাপ থাকায় আবদুল কাদের চৌধুরী সেদিনের পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করতে পারেনি, তার পরিবর্তে সুবোধ, বিজয়, শশধর, লালু এদের নিয়োগ করা হয়েছিলো। যেটা ছিলো তাদের পরিকল্পনার সবচেয়ে বড়ো ভুল। দার্জিলিং মেল হিলি স্টেশন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর পরই তারা স্টেশনে প্রবেশ করে। সরোজ বসু এবং সত্যব্রত চক্রবর্তী কে বন্দুক হাতে স্টেশনের দুপ্রান্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় । হরিপদ এবং রামকৃষ্ণের কাজ ছিলো টর্চ লাইট নিয়ে তাদের সাহায্য করা। শশধর এবং অশোক বাকি দুজন কালিপদ এবং বিজয়ের সহযোগিতায় ভল্টের তালা ভেঙে টাকা সংগ্রহ করছিলো।. প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী এবং ঋষিকেশ ভট্টাচার্য এই দুজনই রিভলভার হাতে পুরো কর্মকান্ডকে পরিচালনা করছিলেন। বাকি বিপ্লবীদের হাতে ছিলো লোহার রড, ছুরি তলোয়ার পেলেটগান প্রভৃতি। বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে স্টেশন চত্বর ফাঁকা করবার জন্য কয়েক রাউন্ড পেলেট বুলেট ফায়ার করা হয় স্টেশনের দিকে তাক করে। তার সাথে সাথেই স্টেশনে উপস্থিত পিওন কালিচরণ মাহালি স্টেশন মাস্টার সতীশ চন্দ্র দে কে খবর দেওয়ার জন্য স্টেশন মাস্টারের ঘরের দিকে দৌড়তে থাকেন, স্টেশনে সেসময়, রেল কর্মচারী ও মালবাহক দের মধ্যে হৈচৈ পরে যায়। এই অবস্থায় স্টেশন মাস্টার সতীশ চন্দ্র দে ও গুলি চালাতে শুরু করলে বিপ্লবীরাও প্রত্যুত্তরে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায়, দুপক্ষের এই গুলি চালনাতে পিওন কালিচরণ মাহালি গুরুতর জখম হয়ে পড়ে, এবং পরেরদিন কলকাতার ক্যাম্পবেল হাসপাতালে মারা যায়। বিপ্লবীদের দাবি মতো কালিচরণ মাহালি স্টেশন মাস্টারের গুলিতেই প্রথমে আহত হয়েছিলেন কারণ তার শরীরে যে বুলেট প্রবেশ করেছিল তা সামনের দিক থেকে আর বিপ্লবীরা ছিল পিছনে। এই সুযোগে বিপ্লবীরা ছিনতাই সম্পন্ন করে তিনটি গ্রুপে ভাগ হয়ে স্টেশন ত্যাগ করে। প্রধান গ্রুপটি, তাতে ছিলো, প্রাণকৃষ্ণ, সত্যব্রত, সরোজ, ঋষিকেশ, হরিপদ, অশোক, প্রফুল্ল, তারা কুমারগঞ্জের আত্রেয়ী নদীর সমঝিয়া ঘাট পার করবার সময়ে জমিদার ক্ষিতিশ চন্দ্র দাসের লাঠিয়ালদের হাতে ধরা পড়ে যান। কালিপদ সরকার ফুলবাড়ি এবং লালু, শশধর এবং অসুস্থ আব্দুল কাদের কে পুলিশ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে। এক বছর পর বিজয় চক্রবর্তী ধরা পড়ে, কিন্তু সুবোধ ওরফে অনিলকে পুলিশ ধরতে পারেনি।
হিলি মেল রবারি কেস ট্রায়াল :- ২৭ শে নভেম্বর ১৯৩৩ এক অর্ডারের ভিত্তিতে দিনাজপুর জেলা আদালতে তিন সদস্যের এক স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তিন সদস্যের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত জজ বিপিন বিহারী মুখার্জি, মৌলবী এমদাদ আলি, এবং তৃতীয়জন ই এস সিম্পসন(সভাপতি), উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো ইনি ছিলেন, লালবাজারে বিনয়, বাদল, দীনেশের হাতে অলিন্দ যুদ্ধে খুন হওয়া ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জেনারেল সিম্পসনের ভাই। যায় হোক ১৯৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহনের মাধ্যমে বিচার শুরু হয়, শশধর, লালু, অশোক পুলিসের কঠোর অত্যাচারে এবং ব্রেনওয়াসের ফলে রাজসাক্ষী হয়ে যায় এবং তাদের বিচারে ৫ বছরের জেল হয়। তাদের মিথ্যা বয়ানের ভিত্তিতে ২২/ ০২/১৯৩৪ ট্রাইব্যুনাল যে রায় দেয় তাতে ট্রেনলুঠ এবং পিওন কালিচরণ মাহালির হত্যার দায়ে, প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী, ঋষিকেশ ভট্টাচার্য, সত্যব্রত চক্রবর্তী, এবং সরোজ বসু এই চার জন কে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। প্রফুল্ল নারায়ণ সান্যাল, কিরণ চন্দ্র দে, এবং আব্দুল কাদের চৌধুরীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কালিপদ, হরিপদ এবং রামকৃষ্ণ কে ১০ বছরের সাজা ঘোষণা করা হয়।
স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে কলকাতা হাই কোর্টের স্পেশাল বেঞ্চে আবেদন করে। হাইকোর্টের স্পেশাল বেঞ্চ আগের রায় কিছুটা পরিবর্তন করে - বিপ্লবী প্রাণকৃষ্ণ, ঋষিকেশ এর ২৫ বছরের সাজা হয়। সত্যব্রত, সরোজ, এবং প্রফুল্লের ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়। হরিপদ, রামকৃষ্ণ, আব্দুল কাদেরের ৭ বছর, এবং কিরণ চন্দ্র দে এর ৫ বছর। বিচারে কালিপদ কে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই রায়ের বিপক্ষে গিয়ে ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে প্রিভি কাউন্সিলে স্পেশাল লিভ পিটিসন (SLP) দায়ের করে। সেখানে ১৬/০৪/ ১৯৩৫ এর রায়ে হাইকোর্টের রায়কে বজায় রাখে এবং সমস্ত বিপ্লবীদের আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো নির্দেশ জারি করা হয়। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, জাপানী আক্রমণের ভয়ে সেলুলার জেলে বন্দি থাকা বিপ্লবীদের একে একে ভারতের মূল ভূখন্ডের জেলে পাঠানো শুরু হয়, অনেকের মেয়াদ শেষ হতে থাকলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৪২ সরোজ বসু, সত্যব্রত চক্রবর্তী, প্রফুল্ল সান্যাল জেল থেকে ছাড়া পান, এবং ১৯৪৬ এ প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী এবং ঋষিকেশ ভট্টাচার্য কে ও জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় বাকি রাও তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে ছাড়া পান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন