ভ্রমণ পিপাসু :- গৌড় ছিল অতি প্রাচীন দেশ। পাণিনিসূত্রে এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে তার উল্লেখ আছে। মধ্যযুগে গৌড় দেশ বলতে বোঝাতো বঙ্গদেশ থেকে উড়িষ্যার ভুবনেশ্বর পর্যন্ত এবং বঙ্গদেশ ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে দক্ষিনে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটেছিল বখ্তিয়ার খলজী ১১৯১খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবিজয়ের মাধ্যমে। তারপর বাংলায় চলে প্রায় ৬০০ বছর ধরে মুসলিম শাসন, এই শাসনাকালে ইলিয়াসশাহী, হুসেনশাহী,হাবসী, নবাবী প্রভৃতি বংশের দ্বারা বাংলা শাসিত হয়। এই ৬০০ বছরের মুসলিম শাসনে বাংলার একমাত্র হিন্দু শাসক ছিলেন আজ যাকে নিয়ে আমরা চর্চা করবো তিনি হলেন রাজা গণেশ বা ভাতুরিয়ার জমিদার গণেশ নারায়ণ ভাদুড়ী।
- ভিডিও টি দেখুন - রাজা গণেশ এর গড় ভাতুরা
রাজা গণেশ:- রাজা গণেশ ছিলেন দিনাজপুরের ভাতুরিয়ার জমিদার।তিনি ব্রাহ্মণ বংশীয় ভাদুড়ী বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সম্ভবত ভাদুড়ী থেকেই নামটি (ভাদুড়ীয়া > ভাতুরিয়া) এসে থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ বংশীয় ভাদুড়ী গোষ্ঠী বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই এলাকায় রাজত্ব করে আসছিলো, দিল্লির সুলতানকে বার্ষিক এক টাকা নজরানা দিত বলে এই জমিদারি "একটাকিয়া" নামেও পরিচিত ছিলো। তিনি মুসলিম শাসনের দুর্বলতার সুযোগে মুসলিম শাসককে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেন। নিজ রাজ্যে সুরক্ষার জন্য তিনি বিভিন্নস্থানে কয়েকটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন, উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ ব্লকের বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া ভাতুরাতেও দূর্গ গড়ে তুলেছিলেন। ইলিয়াসশাহী বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজমশাহের রাজত্বকালে রাজা গণেশ তার রাজস্ব ও শাসন বিভাগের প্রধান হয়ে ওঠেন গিয়াসউদ্দিন আজমশাহ হিন্দুদের উচ্চপদ থেকে সরানোর স্বরযন্ত্র করছিলেন। তাই রাজা গণেশের নেতৃত্বে হিন্দু আমিররা গিয়াসউদ্দিন হত্যা করে। এবং সেনাবাহিনীর সাহায্যে গিয়াসউদ্দিন এর ছেলে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহকে সিংহাসনচ্যূত করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন । ভাতুরা সন্নিকটে শমসপুরে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহের ছেলে শমস্উদ্দিনের সাথে তার যুদ্ধ হয় যুদ্ধে গণেশের হাতে শমস্উদ্দিনের মৃত্যু হয়, আর এই শমস্উদ্দিনের নাম অনুসারেই জায়গাটির নাম হয় শমসপুর।
- আরো পড়ুন- Hili mail Robbery Case 1933
তবে ঐতিহাসিক ব্লকম্যানের মতে তিনি নিজে সরাসরি সিংহাসনে আরোহণ করেননি, তিনি শমস্উদ্দিনের ভাই শাহাবদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে (১৪০৯—১৪১৪) নিজেই রাজকার্য পরিচালনা করেছিলেন। রাজা গণেশ বাংলা থেকে মুসলিম ধর্মকে উৎখাতের উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেইজন্য তার আদেশে বহু মুসলিম নিহত হয়। এই জন্য গৌড়ের মুসলিমরা অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়ে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পীর দরবেশরা আন্দোলন শুরু করে । গৌড়দেশে তখন পীর, ফকির, দরবেশদের যথেষ্ঠ দাপট ছিলো তাদের ফলে বহু নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা মুসলিম ধর্মগ্রহণ করে। হেমতাবাদের এই অঞ্চলে তাদের দাপট কম ছিলনা রাজা গণেশ তাদের দমন করার জন্যই ভাতুরাতে বিনা নদীর তীরে এই দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন।
ভাতুরাতে রাজা গণেশের গড়। |
ভাতুরায় রাজা গণেশের ঢিপি:- রাজা গণেশ হেমতাবাদের ভাতুরাতে যে দূর্গ নির্মাণ করেছিলেন তা বর্তমানে মাটির উচু ঢিপিতে পরিনত হয়েছে। এই ঢিপির পশ্চিমে বিনা নদী এবং পূর্বে গামারী নদী। এই গামারী নদীর অংশটি বর্তমানে ঢোডর বিলে পরিণত হয়েছে, পূর্বে এটি গামারী নদীর অংশ ছিলো। দক্ষিণে ছিল একটা বড় পরিখা, আজ ও তার নিদর্শন আছে, সুতরাং এই ঢিপি যে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ছিলো সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গ্রামের উত্তর ও দক্ষিণে সাঁকরাইল ও কাতলাসই নামে দুটি প্রাচীন পুকুর রয়েছে সেখানে বাঁধানো সিঁড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
রাজা গণেশ এর ভিটার ভেতরে। |
শেখ নূর কুতুব আলম রাজা গণেশকে নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে তিনি তখন জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে গৌড় আক্রমণের জন্য অনুরোধ করেন। ইব্রাহিম শর্কি তার অনুরোধে গৌড়ে আসেন ফিরোজপুরে শিবির ও স্থাপন করেছিলেন, সেই সময়ে রাজা গণেশ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা না করে বশ্যতা স্বীকার করে নেন। রাজা গণেশের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয় মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করার, কিন্তু তার স্ত্রীর বাধাতে তিনি তা পারেননি। তখন তিনি তার পুত্র যদুনারায়ণ কে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা দেন এবং জালউদ্দিন নামে গৌড়ের সিংহাসনে বসান। এই অবস্থায় ইব্রাহিম শর্কি আবার জৌনপুরে ফিরে চলে গেলে তিনি তার পুত্রকে আবার সিংহাসনচ্যূত পুনরায় গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন এবং "দনুজর্মদনদেব" উপাধি ধারণ করে পুনরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। "দনুজর্মদন" কথার অর্থ হলো দানবদের দলন। অনেকে বলে থাকেন রাজা গণেশ এবং দনুজর্মদন দেব আলাদা ব্যক্তি, পরিবর্তিতে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে দুজনই এক এবং অভিন্ন। রাজা গণেশকে ফার্সিতে যে "হাকিম দিনওয়াজ" বলা হয়েছে বর্তমান ঐতিহাসিকদের মতে তা দনুজর্মদনদেবের অপ্রভ্রংশ মাত্র। মনে করা হয় এই "দনুজ" থেকেই দিনাজপুর নামের উৎপত্তি । দ্বিতীয়বার সিংহাসনে বসে পাণ্ডুয়ার একলাখি তে প্রসাদ নির্মাণ করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। সেইসময়ে এই প্রাসাদ নির্মাণে এক লাখ টাকা ব্যয় হয়েছিল বলে এর নাম হয়ে যায় একলাখি, পরে তার থেকে জায়গার নাম। প্রাসাদের ডিজাইন দেখে প্রাসাদটিকে গোলঘর নামেও ডাকা হয়। এই প্রাসাদের ভিতরেই গণেশের ছেলে, পুত্র এবং স্ত্রীর সমাধি বিদ্যমান।তিনি তার পুত্র যদু কে পুনরায় আবার হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। তার উদ্যোগে গৌড়ে ও বঙ্গদেশে সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থরচনা ও সংস্কৃতচর্চা আরম্ভ হয়। তিনি শিবের উপাসক ছিলেন, ভাতুরাতে তার দুর্গের ভিতরে শিব মন্দির ছিল নিয়মিত শিবের উপাসনা হতো। সেই মন্দিরটি বর্তমানে একেবারে নষ্ট হয়ে গেলে গ্রামবাসিদের উদ্যোগে সেই মন্দিরকে পুনরায় আবার নির্মাণ করা হয়, সেখানে এখনো শিবের পুজো হয়ে আসছে গ্রামবাসীদের উদ্যোগে।
প্রাচীন শিবমন্দির । |
রাজা গণেশ তার ছেলেকে শুদ্ধিকরণের মাধ্যমে পুনরায় হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করলেও যদু বা জালালউদ্দিন ইসলাম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকেন, এতে রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে ছেলেকে কারাগারে বন্দি করেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই যদু বন্দি থাকাকালিন এক ভৃত্যের সহযোগিতায় এবং স্বরযন্ত্রে পিতাকে হত্যা করে পুনরায় সিংহাসনে(১৪১৮) আরোহণ করেন। জালালউদ্দিন মৃত্যুর পর তার ছেলে শামশউদ্দিন আহমেদ শাহ সিংহাসনে বসেন, রিয়াজ উস সালাতিন থেকে জানা যায় যে ১৪৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সালে ইলিয়াস শাহী বংশের এক বংশধরের দ্বারা তিনি নিহত হন এই ভাবেই রাজা গণেশের বংশের শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
Eklakhi Samadhi. Raja Genesh এখানে গণেশ এর ছেলে যদু, তার স্ত্রী পুত্রের সমাধি আছে। |
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন