সিঙ্গাবাদ, মালদা। ভারতের শেষ ও প্রথম স্টেশন। Singhabad,Malda.The last & First Station Of India.

ভারতের শেষ রেলস্টেশন সিঙ্গাবাদ, ব্রিটিশ আমলের মালদা জেলার এই ঐতিহ্যবাহী স্টেশন যা অনেক উত্থান পতনের সাক্ষী।



ভ্রমণ পিপাসুঃ- ভারতবর্ষের এরকম অনেক রেলস্টেশন আছে যেগুলো হয় এক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব নয়তো যাত্রী অভাবে একদম প্রায় জনমানবহীন অবস্থায় পড়ে আছে। সেরকমই একটি স্টেশন নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো যার নাম সিঙ্গাবাদ। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এই প্রান্তিক স্টেশনটি তার শেষের অপেক্ষায় দিন গুণছে । বর্তমান এই সিঙ্গাবাদ তার অতীত গৌরব হারিয়ে শুনশান হয়ে পড়ে থাকলেও স্বাধীনতার পূর্বে কিন্তু এই স্টেশনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন ছিলো এমনকি স্বাধীনতা পর দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পরেও এই স্টেশনটি সমান তালে তার গুরুত্ব বজায় রেখেছিলো, কিন্তু কেনো এই স্টেশন এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এবং কিভাবে এই স্টেশন আসতে আসতে তার পুরোনো গৌরব একটু একটু করে তার অতীত গৌরব  হারিয়ে ফেলছে সেইসব কিছুই আজ আমরা আলোচনা করবো।

সিঙ্গাবাদ স্টেশনের ফলকের নিচের দিকে কেউ যদি ভালো ভাবে লক্ষ্য করে তাহলে একটা লেখা জ্বলজ্বল করছে ভারতের শেষ স্টেশন এবং প্রথম স্টেশন। স্টেশন দু প্রান্তের দুদিকের ফলকে সেটা লেখা আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে এপারে পৌছলে প্রথম স্টেশন পড়বে এই সিঙ্গাবাদ,এবং যারা বাংলাদেশ যাবেন তাদের কাছে শেষ স্টেশন হবে এটি।সিঙ্গাবাদ স্টেশনের অবস্থান মালদা জেলার হবিবপুর ব্লকের অন্তর্গত শ্রীরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভারত- বাংলাদেশ বর্ডার লাগোয়া এলাকায়। দেশভাগের আগে উত্তরপূর্ব ভারত তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাথে ঢাকা তথা পূর্ব বঙ্গের যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিলো এই স্টেশন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে, মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডুর মতো এরকম অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল যারা এই সিঙ্গাবাদ স্টেশন হয়েই ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গে পৌঁছেছিলো। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে এই স্টেশনে একবার অগ্নি সংযোগের ঘটনাও ঘটেছিলো এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের আজও সেইসব মনের স্মৃতি কোঠায় রয়ে গেছে।.                                   

Singhabad Rail Station

 মালদা শহরে যে টাউন স্টেশনটি বর্তমানে আছে এই স্টেশন তখন তৈরিই হয়নি, তখন প্রধান রেল স্টেশন ছিলো ওল্ড মালদা স্টেশন। তখন এই ওল্ড মালদা স্টেশন থেকেই সিঙ্গাবাদ হয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত চলাচল করতো যাত্রীবাহী ট্রেন, তখন ওল্ড মালদা থেকে বাংলাদেশ আবদুলপুর পর্যন্ত সরাসরি রেল লাইন ছিলো। দেশ ভাগের পর এই স্টেশন ভারতের অন্তিম স্টেশন হিসেবে থেকে যায়। স্টেশন এর বোর্ডে সেই লেখা জ্বলজ্বল করছে। স্বাধীনতার পর ওল্ড মালদা থেকে সিঙ্গাবাদ পর্যন্ত প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলাচল করতো। তখনও এই স্টেশনের গুরুত্ব খুব একটা কমেনি ,কিন্তু যাত্রী অভাবে সেই প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সংখ্যা একটিতে এসে দাঁড়িয়েছিলো। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর হয়ে গেলো সেই একটি মাত্র প্যাসেঞ্জার ট্রেন ও বন্ধ। বন্ধ হওয়ার আগে 55709/55710 ট্রেনটি যাতায়াত করতো, ভাড়া ছিলো মাত্র পাঁচ টাকা। প্রতিদিন সকাল ৮.৩০ এ সিঙ্গাবাদ থেকে ছেড়ে মালদা পৌঁছতো ৯.৪০ মিনিটে এবং মালদা থেকে ট্রেনটি ৬.১৫ তে ছেড়ে ৭.২০ তে সিঙ্গাবাদ পৌঁছতো, মাঝে পড়তো মালদা কোর্ট, বুলবুলচন্ডীর মতো আরো কয়েকটি স্টেশন।             

ওল্ড মালদা-সিঙ্গাবাদ এই লাইনটি যথেষ্ট ঐতিহ্যবাহী একটি লাইন। বড়ো বড়ো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পায়ের ধুলো পড়েছে এই লাইন তথা এই স্টেশনে। তা সত্বেও এই লাইনে কেনো এতো বছর ধরে প্যাসেঞ্জার ট্রেন পুরোপরি বন্ধ তার কোনো সদুত্তর কেউ দিতে পারেনি, হয়তো যাত্রী হ্রাস পাওয়াই এর প্রধান কারণ হতে পারে। বর্তমানে এই লাইন দিয়ে একটি মাত্র মালগাড়ি সারাদিনে ভারত- বাংলাদেশ- নেপালের মধ্যে যাতায়াত করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কেন্দ্রে রেলমন্ত্রী ছিলো তখন তিনি এই সিঙ্গাবাদ স্টেশনকে হেরিটেজ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই কাজও আর বেশিদিন এগোয় নি।

সিঙ্গাবাদ - মালদা লাইন দিয়ে বর্তমানে সারাদিনে একটি মাত্র মালগাড়ি যাতায়াত করে। বর্ডারের ঐ পারেই আছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুর স্টেশন । ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই আগস্ট দুদেশের মধ্যে যে মৌ স্বাক্ষর হয় তাতে এই রুটকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় যাতে বাংলাদেশ নেপালের সাথে এই রুট দিয়েই পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারে, বাংলাদেশ থেকেই এই রুট হয়েই বিহারের রকসৌল দিয়ে নেপাল পৌঁছায় পণ্যবাহী মালগাড়ি। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ এই ট্রানজিট রুট দিয়েই নেপালে সার রপ্তানির করা শুরু করেছে যার জন্য আলাদা করে কর দিতে হয়না বাংলাদেশ কে। যেমন ভাবে পণ্যবাহী মালগাড়ি এই রুটে চলাচল করছে তেমনি যাত্রীবাহী ট্রেন ও যতো তাড়াতাড়ি এই রুট দিয়ে চলাচল শুরু হবে সেটাই এই রুটের পক্ষে মঙ্গলজনক হবে, এখন দেখার বিষয় সেই সবুজ সঙ্কেত কবে পাওয়া যায়।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন