রাজা মহেশ এর ঢিপি, কশবা মহেশো, কমলাবাড়ি হাট, রায়গঞ্জ. Kasba Mahasho Kamlabari Hat, Raiganj.

 ভ্রমণ পিপাসু:- মধ্যযুগে বাংলায় সুলতানী আমলে রাজা মহেশ একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তার বংশ পরিচয় নিয়ে বিশেষ কিছু জানা যায়না, তবে যেটুকু জানা যায় যে, তিনি একজন ধর্মপ্রাণ, প্রজারঞ্জন এবং শক্তিশালী রাজা ছিলেন, বেশ কয়েকটি অঞ্চল তার শাসনাধীনে ছিলো। আর এই সমস্ত অঞ্চলগুলি একসাথে "মহেশ পরগনা" নামে পরিচিত ছিলো আর তার প্রাসাদ সংলগ্ন এলাকা যেটা বর্তমানে কমলাবাড়ি হাট ও আসে পাশের কিছু এলাকা, সেটাকে "কশবা মহেশো" বলে অভিহিত করা হয়।

 "কশবা মহেশো" রায়গঞ্জ ব্লকের ১৪ নং কমলাবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ১৭৬ নং মৌজা। সুলতানী আমলে কশবা মহেশো এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিলো। "কশবা" কথার অর্থই হলো সমৃদ্ধ গ্রাম বা জনপদ, যে জনপদ গ্রাম অপেক্ষা বড় কিন্তু নগর অপেক্ষা ছোটো।

রাজা মহেশের প্রাসাদ:- কশবা মহেশো এলাকাতেই তার প্রাসাদ ছিলো। তার এই প্রাসাদ উচু প্রাচীর দ্বারা বেস্তিত ছিলো। সেই প্রাসাদ থেকে এক সুরঙ্গপথ মিরুয়ালের হোসেন শাহ মাজার বা চাঁদ শাহের মাজার (যেটা বর্তমানে মিরুয়ালের বিএসএফ ক্যাম্পের পিছনে এক উচু ঢিপির ওপরে অবস্থিত) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বুঝতে কারোই কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না যে এই সুরঙ্গপথ বহিঃশত্রুর আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্য তৈরি করা হয়েছিলো, কারণ সেই সময়ে শত্রুর কোনো অভাব ছিলনা, গোটা বাংলা জুড়েই সেইসময় মুসলিম শাসন চলছিল। শক্তিশালী আলাউদ্দিন হুসেনশাহ ছিলেন সেই সময়ে ছিলেন বাংলার সুলতান, এই অবস্থায় একজন স্বাধীন তার ওপরে হিন্দু রাজার প্রচুর শত্রু থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তার প্রাসাদ অনেকখানি এলাকা জুড়েই প্রায় ছিল, আমরা ওখানে গিয়ে সেটা স্পষ্ট ভাবে উপলব্ধি করেছি। বর্তমানে সেখানে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। রাজ প্রাসাদের অভ্যন্তরে এক বিশাল দেবমন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো, এই মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে সেইসময়ে প্রচুর অর্থব্যয় হয়েছিলো বলে মনে করাহয়। রাজা মহেশের প্রতিষ্ঠিত এই মন্দিরে গণেশ ও বিষ্ণুর পূজা হতো। বর্তমানে সেই বিষ্ণুমূর্তিটি রায়গঞ্জের খরমুজা ঘাট রোডের কামাখ্যা মন্দিরে রাখা আছে, সেখানেই নিত্য পুজো হয়ে আসছে। মূর্তিটির মস্তকে কিরীট, কর্নে কুন্তুল গলায় হার বাহুতে অঙ্গদ এবং বক্ষদেশে উপবীত।  দুই পাশে আছে লক্ষী ও সরস্বতী। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প নিদর্শন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে পড়ে আছে সঠিক পদ্ধতিতে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যদি উদ্ধারকার্য চালানো যায় তাহলে অনেক কিছুই বের হয়ে আসার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

রাজা মহেশের প্রাসাদের সেই বিষ্ণুমূর্তি। 

রাজা মহেশ এবং আলাউদ্দিন হুসেনশাহ :- বাংলায় সুলতানী আমলে পীর, দরবেশদের যথেষ্ট দাপট ছিলো, তাদের উদ্যোগে বহু নিম্নশ্রেণীর হিন্দু মুসলিম ধর্মগ্রহণ করে, তাই তৎকালীন মুসলিম শাসকদের কাছে এদের খুব গুরুত্ব ছিলো। সেরকমই একজন পীর ছিলো পীর বদরুদ্দিন, তিনি সবসময় বিধর্মী রাজা মহেশ উৎখাত করতে চেয়েছিলেন, সেইজন্য তিনি তখনকার বাংলার সুলতান হুসেনশাহ কে হিন্দু রাজা মহেশকে উৎখাত করার জন্য আমন্ত্রণ জানান, কথিত আছে নাকি যে সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহ তার ডাকে সাড়া দিয়ে মহেশের প্রাসাদ আক্রমন করেছিলেন, তার আক্রমনে মন্দিরে বিষ্ণু মূর্তিও রক্ষা পায়নি, মূর্তিটির চালচিত্র ভেঙে দেওয়া হয়। বলা হয় সুলতান হুসেন শাহের রাজা মহেশের রাজপ্রাসাদ আক্রমনকালে তিনি ঐ সুরঙ্গপথ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সুরঙ্গপথের শেষ প্রান্ত অর্থাৎ মিরুয়ালের কাছে এসে হুসেনশাহের সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান, সেখানেই তাকে হত্যা করা হয়। তারপর ঐ স্থানে হুসেন শাহ তার বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেন যা হুসেন শাহের তখত্ নামেও পরিচিত। বর্তমানে এর কিছুই অবশিষ্ট নেই, বর্তমানে এখানে পীরশাহের মাজার আছে। যার অবস্থান মিরুয়ালের বিএসএফ ক্যাম্পের একদম পিছনে গোবিন্দপুর গ্রামে পঁচিশ ফিট উচু ঢিপির ওপরে, এর পাশেই রয়েছে ফকির দিঘি, যার বর্তমান অবস্থান বিএসএফ ক্যাম্পের একদম ভেতরে। যা রাজা মহেশ তৈরি করেছিলেন তার সুরঙ্গপথের একদম মুখে প্রতিবছর এই মাজার ও ফকির দিঘিকে কেন্দ্র করে উরুস উৎসব হয়ে থাকে। এই উৎসবে বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন ফকিররা স্নান করতো বলে এর নামের সাথে ফকিরদিঘি নামটি যুক্ত হয়ে গেছে।

কমলাবাড়ি মসজিদ :- সুলতান হুসেনশাহ কশবা মহেশো এলাকাতেই দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন, বর্তমানে যেটা কমলাবাড়ি হাটের একদম উত্তরদিকে অবস্থিত। পীর মখদুম জামে মসজিদ নামে এটি পরিচিত। কেউ কেউ বলে থাকেন রাজা গণেশের ছেলে যদু বা জালালউদ্দিন এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তবে ব্রিটিশ ঐতিহাসিক বুকানন হ্যামিলটন উত্তরবঙ্গ ভ্রমণ কালে তিনি এই মসজিদ পরিদর্শন করেছিলেন,তার লেখায় মসজিদের নির্মাতা হিসেবে হুসেনশাহের নামের উল্লেখ আছে। এই মসজিদ উত্তর দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ।

 রাজা মহেশ একজন ধর্মপ্রাণ ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন তার পদাতিক ও হস্তিবাহিনী ও ছিলো, কথিত আছে কমলাবাড়ি হাটের পাশে কিছু পাথরের স্তম্ভ পোতা ছিলো যেখানে হাতিগুলো বাঁধা থাকতো। ধর্মপ্রাণ রাজা মহেশ প্রজাদের স্নানাদি ও জমিতে জল সেচের জন্য এই অঞ্চল ও আসে পাশের পাল আমলের তৈরি দিঘী গুলির সংস্কার সাধন করেন এবং নিজ উদ্যোগে কিছু নতুন দিঘী ও খনন করেছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফকিরদিঘি, সুলতানদিঘি, বড়োদিঘি, মেজোয়ানদিঘি, শিয়ালগাড়া দিঘি উল্লেখযোগ্য। রায়গঞ্জের শশিহার গ্রামে বড়োদিঘি, কমলাবাড়িতে , সুলতান দিঘি এবং শিয়ালগাড়া দিঘি এবং রায়গঞ্জের সোনাবাড়ি গ্রামে মেজোয়ানদিঘি অবস্থিত। যার মধ্যে সুলতানদিঘির আয়তন প্রায় চুয়ান্ন বিঘা প্রায়। বর্তমানে সব দিঘিতেই মাছ চাষ করা হচ্ছে। রাজা মহেশের মৃত্যুর পর এই সমস্ত দিঘিই সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের অধিকারে আছে। 

রাজা মহেশ এর সুলতান দিঘী ।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন