রাধিকাপুরের প্রাচীন উদগ্রামের ইতিহাস এবং 500 বছরের পুরোনো দুর্গাপূজো।

 ভ্রমণ পিপাসু :- কাটা তারের গা ঘেঁষে পিচের রাস্তা, সীমান্ত সড়ক চলছে বিএসএফ এর টহলদারি, ভারী বুটের শব্দে সচকিত চারদিক ।এরই মাঝে রাস্তার ডান দিকে দেশভাগের যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদগ্রাম। উদগ্রাম বা উদগাঁও কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্গত রাধিকাপুর ভারত, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী একটি গ্রাম। গ্রামটি বেশ উচু জায়গায় অবস্থিত বলে উদগাঁও নামে অভিহিত হয়। কোনো এক সময় এই স্থানের ঝোপ জঙ্গলে প্রচুর উদবিড়াল থাকতো তারা পুকুরের মাছ ধরে এনে ঝোপ জঙ্গলে বসে খেত, সেই থেকেও এই জায়গায় নামটি আসতে পারে। 

প্রাচীন দুর্গামন্দির। সৌজন্যে= মৌনব্রত মণ্ডল। 


উদগ্রামের ইতিহাস বলতে প্রায় পাঁচশো বছরের পুরোনো দুর্গাপূজার কথা বলা যায়। অবিভক্ত দিনাজপুর তথা বাংলার প্রাচীন পুজো গুলোর মধ্যে একটি। দেবী দুর্গাকে এখানে চণ্ডী রূপে পূজা করা হয়, গ্রামের একদম মাঝ বরাবর টিন-দালানের চণ্ডীমণ্ডপ টি অবস্থিত যা বর্তমানে পাকা দালানে রূপান্তরিত করা হয়েছে।  দিনাজপুরের মহারাজারা তার পুজোর জন্য জমি দান করেছিলেন। গ্রামের নিঃসন্তান পিতামাতারাও তার পুজোর জন্য জমি দিয়েছিলেন। তাই এখনো এই দুর্গাপূজার নামে বারো বিঘে জমি আছে, কিন্তু দেশ ভাগের ফলে বেশিরভাগ জমি বাংলাদেশের মধ্যে পড়ে যায়, কিন্তু এখনো 5,6 বিঘা জমি এপারে আছে, এই জমির ফসলের টাকা থেকেই মন্দিরের খরচ ও মায়ের পূজা চলে, দুর্গাপূজার জন্য আলাদা ভাবে কোন চাঁদা তোলা হয়না মন্দির কমিটি থেকে, পূজা পরিচালনার দায়িত্ব এখনো বারোয়ারী পূজা কমিটির হাতে তারাই সমস্ত কিছু দেখাশোনা করে । পূর্বে দিনাজপুরের জমিদার বাড়ির কামানের গোলার আওয়াজ শুনে এখানে অষ্টমীর পুজো শুরু হতো, দিনাজপুরের জমিদারবাড়ির নিয়ম ও সূচি মেনেই এখানে পুজো হতো, তাই উদগ্রামের অষ্টমীর দুর্গাপূজার মহাত্ম খুব বেশি স্থানীয় লোকেদের কাছে, যার ফলে অষ্টমীতে এখানে প্রচুর মানুষের সমাগম হয়,উত্তর দিনাজপুর জেলা ছাড়াও পাশের জেলা থেকে ও মানুষ এখানে আসে ।গ্রামবাসীরা এই পুজো ভক্তিভরে দেন এবং দেখানে পুজোর চারদিন চণ্ডীমঙ্গলের গান পরিবেশিত হয়ে থাকে, মন্দিরের সামনে গেলেই দেখতে পাবেন প্রাচীন পাথরের একটি তুলসী গাছের মঞ্চ, এই তুলসী মঞ্চটিই সেই সময়কার চিহ্ন নিয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। উদগ্রামের মানুষদের তাদের মা চন্ডীর ওপরে আগাধ বিশ্বাস তাই গ্রামে কোনো বিয়ে বা কোনো শুভ কাজ হলেই তা দেবী চণ্ডীকে সাক্ষী রেখেই করা হয়, ছাদনাতলা তৈরী হয় মন্দির চত্বরের মধ্যেই। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস চন্ডীর সামনে বিয়ে হলে সংসার সুখের হয় এবং অটুট থাকে দাম্পত্য জীবন।

উদগ্রামের প্রাচীন পাথরের তুলসী মঞ্চ।সৌজন্যে - শুভাশীষ সাহা।


বহু পুরোনো এই গ্রাম, তাই আজও এই গ্রামের মাটি খুঁড়লে বহু পুরোনো বাড়ির ভগ্নাবশেষ উঠে আসে। অতীতে এই গ্রামে এই বিত্তশালী ধর্মপ্রাণ মানুষের বাস ছিল, সেই মানুষটি উদগ্রামের আসে পাশে বাহান্নটি গ্রামের মানুষজন বিপদে পড়লেই ছুটে জেতেন, এবং সুকৌশলে তাদের বিবাদ মিটিয়ে দিতেন। প্রাচীনকালে গ্রাম তলায় বিষ্ণু, লক্ষীনারায়ণ ও মনষার পুজা হত।                   

     বখতিয়ার খিলজি বাংলা আক্রমণ করার দুশো বছর পর্যন্ত বাংলায় এক বিপর্যয়ের তান্ডবলীলা চলছিলো। কারণ মুসলিম ধর্মশাস্ত্রে দেবমূর্তির পূজা যে কেবল অবৈধ তা নয়, মন্দির ও দেবমূর্তি ধংস করা অত্যন্ত পূর্নের কাজ বলে ধরা হয়। তখন এই কারণে হিন্দুদের উপর নিষ্ঠুর, নিপীড়ন, ধর্মানতকরন ও হিন্দুদের মন্দির ও প্রতিমা ভাঙ্গার কাজ চলছিল। আর এই আক্রমনের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য উদগ্রামের দেব মন্দিরের পুঁজিত মূর্তিগুলিকে গ্রামবাসিরা বুড়া দিঘির জলে ডুবিয়ে দেয়, এই কথা ও শোনা যায়।     

দুর্গা পুজো- উদগ্রাম। 2021।

         

  এই উদগ্রামের সাথে বহু অলৌকিক ঘটনার কথা শোনা যায়, এবং মা চন্ডীর পুজো শুরুর ব্যাপারেও এরকম অনেক অলৌকিক ঘটনা কথা। এই পুজো ঠিক কবে থেকে শুরু হয়, তা সঠিকভাবে কেউই বলতে পারে না, কিন্তু এই প্রাচীন পুজো যে বর্তমানে সার্বজনীন পুজোতে পরিনত হয়েছে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। তাই এখন ও যারা এই উদগ্রামে আসেননি তারা অবশ্যই দুর্গাপূজার অষ্টমীর দিন এখানে এসে ঘুরে যাবেন। রাধিকাপুর টাঙন নদী ব্রিজ পার করে হাতের বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে 2,3 কি.মি এগিয়ে গিয়ে হাতের বাঁ দিকে রাস্তা বরাবর আরো প্রায় 3 কি.মি যাওয়ার পরই এই গ্রাম পাবেন। আর যারা ট্রেনে আসবেন, তাদের জন্য স্টেশন থেকে বেরিয়েই উত্তর দিকে সোজা 2, 3 কি.মি গেলেই এই মন্দির পাবেন।

উদগ্রাম যাওয়ার পথে। 


3 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন