মন্দিরের শহর-অম্বিকা কালনা
ভ্রমণ পিপাসু :- কালনা কে বলা হয় মন্দিরের শহরে। বহু প্রাচীন এই শহরের প্রকৃত নাম অম্বিকা কালনা। একদিনে ঘুরে আসার জন্য এই কালনা সেরা গন্তব্যস্থল। কালনা স্টেশন থেকে একটা টোটো রিজার্ভ করে একে একে ঘুরে ফেলুন মন্দির গুলোকে ভাড়া মোটামুটি ১০০ থেকে ১২০ টাকার মতো নেবে। আরো একটা জিনিস বলে রাখা ভালো, কালনার বেশিরভাগ মন্দির সকাল সাতটা, সাড়ে সাতটা থেকে দুপুর ১২.৩০ টা পর্যন্ত আবার বিকেল ৪ টা পর থেকে সন্ধ্যা ৭.৩০ পর্যন্ত খোলা থাকে, তাই এই সময় কে মাথায় রেখে কালনা ঘুরতে আসবেন, এবার কি কি মন্দির এখানে আছে এবং কেমন করে একে একে এই সব মন্দির গুলো ঘুরবেন সেটা দেখেনি, সাথে সেই সব মন্দিরের ইতিহাস গুলোও জেনে নেবো।
আরো পড়ে ফেলুন:- ভারতবর্ষের কেবলমাত্র দুটি ১০৮ শিবমন্দির সেটা আছে পূর্ব বর্ধমান জেলায়
Ambika Kalna |
- ইউটিউব ভিডিও লিঙ্ক। দেখে ফেলুন- মন্দিরের শহর কালনার ভ্রমন ভিডিও
অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মহামায়া মন্দিরঃ- কালনা ভ্রমনের আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল ছিলো অম্বিকা সিদ্ধেশ্বরী মহামায়া মন্দির বা সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দির। অম্বিকা অর্থাৎ যার অর্থ মা কালি।এই মন্দির থেকেই এই শহরের নাম এসেছে অম্বিকা কালনা। 688 খ্রিস্টাব্দে ঋষি অম্বরিষ এই মন্দির টি তৈরি করেন। কালনা স্টেশন থেকে 10 টাকা টোটো ভাড়া করে যে কেউ অতিসহজে চলে আসতে পারেন এই মন্দিরে। মন্দিরে টেরাকোটার কাজ লক্ষ্য করা যায় এতে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি দেখানো হয়েছে বৈষ্ণব ও শাক্ত ধর্মের মিলের কাহিনী। কালি পূজার দিন এখানে প্রচুর লোকের আগমন ঘটে এখানে, উৎসবে মেতে ওঠে সাধারণ মানুষ। মা সিদ্ধেশ্বরী এখানে বামা কালি রূপে বিরাজমান, দেবীমূর্তি এখানে নিম কাঠ দিয়ে তৈরী।
Kalna Siddheshwari Kali Bari. |
গোপালজী মন্দির:- সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দির থেকে কিছুটা এগিয়ে চলে আসুন গোপালজী মন্দিরে। এই মন্দিরে গোপালের বিগ্রহ বিদ্যমান। এই মন্দিরটি পঞ্চবিংশতি রত্ন(২৫) বিশিষ্ট ।মন্দিরের সামনেই দেখতে পাবেন বাংলার নিজস্ব চালা রীতিতে নির্মিত বারান্দা। এই মন্দিরের গায়েও টেরাকোটার কাজ দেখতে পাবেন।
Gopalji Temple, Kalna. |
মহাপ্রভু বিশ্রামস্থান অমলীতলা:- গোপালজী মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে সামনে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখতে পাবেন মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের বিশ্রামস্থান অমলীতলা। মহাপ্রভু নবদ্বীপ থেকে তার গুরুদেবের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য কালনার এই স্থলে এসে একদিন বিশ্রাম করেছিলেন। এখানে মহাপ্রভুর পদযুগলের চিহ্ন বিদ্যমান।
কালনা ১০৮ শিবমন্দির :- এবার চলে আসুন কালনা শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনস্থল কালনা ১০৮ শিবমন্দির যা নব কৈলাস মন্দির হিসেবে পরিচিত। ১৮০৯ সালে আটচালা বিশিষ্ট এই মন্দিরটিকে প্রতিষ্ঠা করেন বর্ধমান রাজবাড়ির রাজা তেজচন্দ্র বাহাদুর। মন্দিরের গঠনশৈলী যদি যদি বলতে চান তাহলে দেখা যাবে মন্দিরটি অদ্ভুত ভাবে এক জ্যামিতিক বিন্যাসে তৈরি করা হয়েছে তাও প্রায় ২০০ বছর আগে, যা দেখে সত্যি অবাক লাগে। মন্দিরটি ২ টি বৃত্তের আকারে বিন্যস্ত। বহিবৃত্তে আছে ৭৪টি শিব মন্দির এবং অন্তবৃত্তে আছে ৩৪ টি মন্দির। এবং মন্দির গুলির মাঝে অবস্থিত একটি বড় কুয়ো, এই কুয়োটিকে শূন্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্ম স্বরূপ শিবের প্রতীক হিসাবে মানা হয়। মনে করা হয় মন্দিরের জলের চাহিদা মেটানোর জন্য ই হয়তো এই কূপটি খনন করা হয়েছিল।প্রতিটি মন্দিরের শিবলিঙ্গ গুলিই উত্তরমুখী। বহিরবৃত্তের ৭৪টি শিবলিঙ্গের মধ্যে একটি শুক্লবর্ণের অর্থাৎ সাদা এবং একটি কৃষ্ণ বর্ণের অর্থাৎ কালো রঙের। কিন্তু অন্ত বৃত্তের ৩৪টি শিব লিঙ্গই সাদা রঙের। মন্দিরের সাদা শিব লিঙ্গগুলো সদাশিবের প্রতীক যার অর্থ চৈতন্য ও জ্ঞান। এবং কালো বর্ণের শিব লিঙ্গ গুলি রুদ্র এর প্রতীক। মন্দিরের প্রতিটি বৃত্তের দুটি করে দরজা বাইরের বৃত্তের দরজা গুলি একটি উত্তরে এবং একটি দক্ষিণে এবং ভিতরের বৃত্তের দরজা গুলি পূর্ব, পশ্চিমে। মন্দিরে দেওয়াল গুলিতে পূরান ও রামায়ণ, মহাভারত কাহিনী খুব ই সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। 200 বছরের পুরোনো এই মন্দিরের টেরাকোটা কাজের পাশাপাশি বাঙ্গলার নিজস্ব মন্দির রীতি আট চালা রীতি লক্ষ করা যায়।
১০৮ শিবমন্দির এবং মাঝের কুয়ো। |
কালনা রাজবাড়ি মন্দির চত্বর:- ১০৮ শিবমন্দিরের ঠিক বিপরীত দিকেই রয়েছে কালনা রাজবাড়ি মন্দির চত্বর, এর ভিতরে অনেকগুলো অসাধারন সব মন্দির দেখতে পাবেন যেগুলোর টেরাকোটার কাজ আপনাকে অবাক করে দেবে। বর্ধমান রাজাদের দৈন্যহাটার মন্দির ও রাজবাড়ি বর্গী আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছিলো তারপর তারা কালনাতে রাজাবাড়ি পত্তন করেন, বিভিন্ন রাজাদের সময়ে বিভিন্ন মন্দির এখানে তৈরি হয়।চলুন তাহলে এক এক করে দেখেনি সব মন্দির গুলো।
প্রতাপেশ্বর মন্দির:- ১০৮ শিবমন্দিরের ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে কালনা রাজবাড়ি ঢোকার প্রধান ফটক এই ফটকের উচ্চতা প্রায় ১৪ ফুট। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই হাতের বাম দিকে দেখতে পাবেন সুউচ্চ প্রতাপেশ্বর মন্দির। ১৮৪৯ সালে রাজকুমার প্রতাপ চন্দ্রের স্ত্রী পিয়ারীকুমারী দেবী এই মন্দিরটি তৈরী করেন। মন্দিরে ভিতরে রয়েছে শিবলিঙ্গ । আর মন্দিরের বাইরে রয়েছে অসাধারন সব টেরাকোটার কাজ।
Pratapeswar Temple, Kalna. কালনা প্রতাপেশ্বর মন্দির। |
রাসমঞ্চ:- প্রতাপেশ্বর মন্দির থেকে সামনের দিকে কিছুটা এগোলেই বাম দিকে দেখতে পাবেন রাসমঞ্চ। খুব সুন্দর এই রাসমঞ্চটি কিন্তু মঞ্চটির মাথায় কোনো ছাদ নেই।রাসের সময়ে লালজী এবং গোপালজীর মূর্তিগুলো এখানে এনে রাখা হয়।
Rashmancha, Kalna. কালনা। |
লালজী মন্দির:- রাসমঞ্চ দেখার পর সামনে দিকে অগ্রসর হলেই লালজী মন্দিরের গেট দেখতে পাবেন, গেট দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ুন লালজী মন্দির প্রাঙ্গণে, পঞ্চবিংশতি রত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরের টেরাকোটার কাজ দেখার মতো। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি তৈরী করেন রাজা কীর্তিচাঁদের মা ব্রজকিশোরী দেবী, তার বৃন্দাবন যাত্রা মানত পূরণ হওয়াতে তিনি এই মন্দিরটি তৈরী করেন । এই লালজী মন্দিরের পিছনে এক ঐতিহাসিক কাহিনী আছে; একবার ব্রজকিশোরী দেবী গঙ্গার স্নান সেরে ফেরার সময়ে ঘাটে দেখলেন এক বৈষ্ণব লালজীকে তার ভিক্ষার অন্ন কিছুটা অর্পণ করছে, তা দেখে ব্রজকিশোরী দেবী বললেন;-"এটুকুতে কি পেট ভরে লালজীর? , তুমি লালজীকে আমাকে দাও, আমি কথা দিচ্ছি পুরির জগন্নাথ দেবের মতো প্রতিদিন ৫২ ভোগ অর্পণ করবো" । এ কথা শুনে সেই বৈষ্ণব হেসে ফেলে বললেন, ভোগ প্রাচুর্যে কি পেট ভরে ঈশ্বরের ভক্তরা শ্রদ্ধাভরে যাই অর্পণ করবেন তাই তিনি গ্রহণ করবেন। এই বলে তিনি লালজীকে ব্রজকিশোরীদেবীকে অর্পণ করেন, সেই থেকে আজও সেই বিগ্রহ মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত আছে।
Lalji Temple, কালনা লালজী মন্দির |
গিরিগোর্বধন মন্দির :- লালজী মন্দির প্রাঙ্গণেই দেখতে পাবেন আরো একটি মন্দির নাম গিরিগোর্বধন মন্দির। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি তৈরী করা হয়। ব্যাবিলনের যুলন্ত উদ্যানের আদলে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়, নির্মাণে ব্যাবহার হয় লাল কালো স্লেট পাথরের।
Rupeswar Mandir. |
Krishnachandraji Temple, kalna. |
কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির:- লালজী মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে হাতের বাম দিকে দেখতে পাবেন কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির। এই মন্দিরটিও পঁচিশচূড়া বিশিষ্ট এবং অনবদ্য টেরাকোটার কাজ। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা তিলকচাঁদের মা লক্ষী কুমারী দেবী এটি তৈরি করান।মন্দিরের ভিতরে রয়েছে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ যা নিত্য পূজা করা হয়।
গিরিগোর্বধন মন্দির। কালনা । |
বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির:- কৃষ্ণচন্দ্রজী মন্দির চত্বরেই আপনারা পেয়ে যাবেন এই বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির টি। এই মন্দিরটি আটচালা শৈলীতে নির্মিত। গর্ভগৃহের সামনে রয়েছে একটি ত্রিখিলান বিশিষ্ট বারান্দা। মন্দিরের সামনের অংশ নানাবিধ টেরাকোটার ফলকে সজ্জিত।
Bijay baidyanath temple, kalna বিজয় বৈদ্যনাথ মন্দির। |
ভবা পাগলার মন্দির:- কালনা ভ্রমনের আরো একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে এই ভবা পাগলার মন্দির বা ভবা পাগলার আশ্রম। ভবা পাগলার প্রকৃত নাম হলো ভবেন্দ্র মোহন চৌধুরী, তার বাড়ি ছিলো ঢাকাতে। ছোট থেকেই এই বালক ভবা নিজেকে মায়ের আরাধনা এবং সঙ্গীত সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন, তিনি প্রায় কয়েক হাজার লোকগানের শ্রষ্ঠা। দেশ ভাগের সময়ে তিনি এদেশে চলে আসেন এবং কালনা তে আশ্রয় নেন, বাকি জীবন এখানেই অতিবাহিত করেন এখানেই তিনি ভবা পাগলা নামে পরিচিত লাভ করেন।
পঞ্চরত্ন মন্দির:- ১০৮ শিবমন্দির এবং রাজবাড়ি চত্বরের পাশেই রয়েছে দুটি পঞ্চরত্ন মন্দির। একটি রত্নেশ্বর মন্দির এবং দ্বিতীয়টি জলেশ্বর মন্দির। এই দুটি মন্দির ও সাথে দেখে নিতে পারেন একদম পাশেই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন